১
স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোর কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। কষ্ট করে স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে মুছে যাওয়া কিছু স্মৃতি অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে মানসপর্দায় ধরা পড়ে।
কবে কখন কোথায় কীভাবে এবং কেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কিংবা অতর্কিতে, যুদ্ধ শুরু হয়েছিল পরে ইতিহাস পড়ে জানতে পেরেছি। কিন্তু সেদিন জানতে পারি নি, কারণ জানার মতো বয়স, জ্ঞান এবং বোঝার ক্ষমতা তখনও আমার হয় নি। কেননা, তখনও আমি চালতে কিংবা বটের শুকনো পাতার ঘুড়ি উড়িয়ে দল বেঁধে ছুটে বেড়াই মাঠ থেকে মাঠে। প্রচণ্ড ঝড়েও সাথিদের সংগে আম কুড়োতে যাই, হাতে থাকে পাখি মারার গুলতি, দিগম্বর হয়ে খালে ও পুকুরে ঝাঁপ দিই।
তখন আমার বয়স কত, তা আমি জানি না। হতে পারে ৪, ৫, ৬ বা ৭- এর বেশি হবে না নিশ্চিত। কিন্তু সেই সময়ে ঘটে যাওয়া, আমার চোখের সামনে দেখা বিস্ময়কর অনেক কিছুই আমার ভাসা ভাসা মনে পড়ে।
শৈশব, কিংবা সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ বয়সের এমনি একদিন। দুপুরের ঝাঁঝালো রোদে আমরা একদল শিশু-কিশোর লাংগলচষা ক্ষেতের উপর দৌড়ে ঘুড়ি উড়ানোর মহোল্লাসে মেতে উঠেছিলাম। হঠাৎ প্রলয়ংকারী শব্দে পশ্চিমাকাশ বিদীর্ণ করে প্রায় মাথা ঘেঁষে উড়ে গেলো একঝাঁক বোমারু বিমান। আমরা অবুঝ কিশোরের দল ভয়ে প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে দু হাতে কান বন্ধ করে বাড়ি অভিমুখে ছুট দিয়েছিলাম। কেউ কেউ ক্ষেতের ইটায় হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সারা গ্রামে শোরগোল। হন্তদন্ত হয়ে আমার মা বাড়ি থেকে ছুটে এলেন, এলেন আরো অনেকে। শক্ত ঢিলার উপর আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমিও। বুক ছুলে গিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। মা আঁচলে বুক মুছে দিয়ে ত্রস্ততার সাথে বাড়ি নিয়ে গেলেন। সবাই তখন কী এক আতংকে ভুগছিলাম।
সেদিন থেকেই শুনতে পেলাম এবং কিছুটা বুঝতে পারলাম দেশে গণ্ডগোল চলছে। তবে কীসের গণ্ডগোল চলছে সে বিষয়ে ততটা স্পষ্ট না। কেবল শুনতাম, মিলিটারিরা গ্রামের পর গ্রাম, হাটবাজার পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মেরে শহরগ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে। এই মিলিটারির লোকেরা যে কারা সে বিষয়ে আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। এবং কেনই যে তারা শহরগ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, কেনই যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল তা কিছুতেই আমার ধারণায় আসতো না।
একদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আমাদের গ্রাম থেকে আধ-মাইল দূরে পশ্চিমের দু’ গ্রাম গাজিরটেক ও সুতারপাড়ায় গোলাগুলির শব্দ শোনা গেলো। গোলাগুলির শব্দ ক্রমেই নিকটতর ও প্রকটতর হতে লাগলো। সমস্ত কাজকর্ম ফেলে বাবা ও চাচা আমাদের সবাইকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের বাড়ির পুবদিকে অবস্থিত একটা ঘন জংগলের ভিতর, যেটাকে গ্রামের মানুষ ‘বাগ’ বলতো। আমাদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে বসিয়ে কোনোরকম টু-শব্দটি পর্যন্ত করতে নিষেধ করে দিলেন। বাবা আমার শরীর জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন এবং তাঁর সর্বাংগ থরথর করে কাঁপছিল। কী জানি কেন, আমার তখন একটুও ভয় পাচ্ছিল না। গোলাগুলির শব্দটাকে ইদের পটকা ফোটানোর মতোই রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল।
একসময় গোলাগুলির শব্দ থেমে গেলো। আমরা জংগলের ভিতর গুঁটিসুটি করে বসে - চারদিকে এক রহস্যময় স্তব্ধতা। অনুভব করতে লাগলাম, বাবার শরীরের কম্পন আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবার ডাকে যথন ঘুম ভাংগলো তখন সকালে সূর্য উঠে গেছে। আমরা বাসায়।
এরপর প্রতিদিনই খবর আসতো, আজ এ গ্রামে মিলিটারি আসবে। অতএব, সকাল সকাল রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, অতঃপর সপরিবারে জংগলের ভিতর আত্মগোপন ও রাত্রিযাপন। অবশেষে এ কাজটি আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের একটি অংশবিশেষে পরিণত হয়ে গেলো। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় কিংবা সন্ধ্যার কিছু পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে গোলাগুলি শুরু হতো। সে শব্দ ক্রমশ বিকট হতে থাকতো, আবার একসময়ে তা ধীরে ধীরে মিলিয়েও যেতো। তবে আল্লাহ্র আশ্চর্য রহমত, আমাদের গ্রামটিতে কখনো মিলিটারিদের আক্রমণ সংঘটিত হয় নি।
একদিন সকাল থেকেই গ্রামময় হৈহৈ রৈরৈ রব পড়ে গেলো, আজ মিলিটারিদের সাথে মুক্তিবাহিনীর লড়াই হবে। লড়াইটা হবে গ্রাম থেকে আধমাইল উত্তরে দোহারের খালে। দোহারের খাল পার হবার জন্য বানাঘাটা গ্রাম থেকে আমাদের ডাইয়ারকুম গ্রামে আসার একটাই মাত্র জায়গা আছে। সেটি হামিদ মোল্লার ভিটা বরাবর। ঐ জায়গা পার হয়ে আমাদের গ্রাম আক্রমণ করতে আসবে মিলিটারিরা। আর তখনই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
আমি সেদিনই প্রথম জানতে পেরেছিলাম গেদা ভাই, রজব মামা, তোতা কাকা, এঁরা হলেন আমাদের ডাইয়ারকুম গ্রামের মুক্তিবাহিনীর নেতা। আর সেদিনই এসব নেতাদের আমি প্রথম দেখি এবং সেদিনই প্রথম একটা স্পষ্ট বিভাজনরেখা চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম - মিলিটারিরা আমাদের শক্র, মুক্তিবাহিনীরা আমাদের নিজস্ব মানুষ, যাঁরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য মিলিটারিদের বিরুদ্ধে লড়ছেন।
আক্রমণ-স্থানে যাবার রাস্তাটি আমাদের বাড়ির ৫০ গজ পশ্চিম থেকে শুরু হয়েছে। ক্রমে ক্রমে সেখানে মানুষের ভিড় জমতে থাকলো। আমাদের গ্রামসহ পাশের অন্যান্য গ্রাম থেকেও মানুষ ছুটে আসতে লাগলো। কেউ বড়ো, কেউ ছোটো - সকল শ্রেণির সকল পেশার মানুষ। কারো হাতে দা, রামদা, কারো ঢালশুর্কি, কারো হাতে লাঠি ও বাঁশ। কেউ হাতে নিয়েছে জুঁতি, কেউ কুঁচি, কেউবা কাঁচি। কুড়াল, খুন্তি এসবও। দুপুর হতে না হতেই আমাদের বাড়ির উত্তর দিকের চকটি জনে জনারণ্য হয়ে গেলো। এত মানুষ আমি এর আগে দেখি নি।
আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠছিল; ঐখানে কী ঘটছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম আমি। ঘরের ভিতরে জানালার পাশে বসে দেখতে লাগলাম - খালপাড় ধরে কেবল মানুষ আর মানুষ। তারা অপেক্ষা করছে মিলিটারিদের জন্য, একটা লড়াইয়ের জন্য, একটা প্রতিরোধ গড়ার জন্য, তারা ডাইয়ারকুম গ্রামে শক্রর আগমন ঘটতে দেবে না।
আমিও ঘরে বসে একটা লড়াই দেখার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছিলাম। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও লড়াইটা শুরু হচ্ছে না। একসময় সন্ধ্যা হলো। অত দূরে আর কিছুই দেখা যায় না। মা-ও একবার বাড়ির বাইরে, আবার ঘরের ভিতর চিন্তিতভাবে পায়চারি করছিলেন। আমাদের দু ভাইবোনকে মা ভাত বেড়ে খেতে দিলেন। আগেভাগেই খেয়ে নেয়া ভালো, কখন কী হয় কে জানে।
শেষ পর্যন্ত ওখানে মিলিটারিরা এসেছিল কিনা, বা দু-পক্ষে কোনো যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তা আমি জানি না। আমাদের বা শত্রুবাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল কিনা, বা হলেও কতখানি ছিল, তা জানার কোনো উপায় ছিল না আমার। বা তখন জেনে থাকলেও এখন আর সেটা মনে নেই। তবে, এটা আমার ছোটো চোখে দেখা একটা বিরাট বিস্ময়কর ঘটনা। এখনো চোখে ভাসছে, দোহারের খালপাড়ে হামিদ মোল্লার ভিটা বরাবর মানুষ থৈ থৈ করছে। (ঐ সময়ের কেউ যদি আমার ফেইসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে থেকে থাকেন, যাঁরা এ ঘটনাটি জানেন, দয়া করে অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। অন্য কোনো ঘটনাও শেয়ার করতে পারেন।)
প্রাচীন পাণ্ডুলিপির প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়া যায় না - ধুলোবালি জমে থাকে, পোকায় কাটে - লেখা অস্পষ্ট থাকে। আমার অস্পষ্ট স্মৃতিগুলোর কিছু কথা এতক্ষণ ভাবছিলাম। এখন আরো অনেক কিছু মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, যুদ্ধ শুরু হবার ক'মাস পরই আমার একমাত্র চাচা বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। আমার বুড়ো দাদি ছেলের জন্য কেবলই কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে চাচির চোখ সারাক্ষণ ফুলে থাকতো। ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ সালের সন্ধ্যায় আমার চাচির সাথে মোবাইলে আলাপকালে চাচি জানালেন, চাকরির উদ্দেশ্যেই চাচা বাড়ি থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন। কোনো এক রেললাইনের পাশেই নাকি তার চাকরি হবে বলে চাচা বলে গিয়েছিলেন। চাচি বললেন, চাচা চলে যাওয়ার পর বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছিলেন, চাচা আর বেঁচে নেই। কারণ, বাড়িতে চাচার কোনো খবর আসে নি।
আমার আরো মনে পড়ছে, যুদ্ধ শুরু হবার পরপরই ঢাকায় বসবাসরত আমার ফুফা-ফুফুসহ অনেকেই সপরিবারে গ্রামে ফিরে এলেন। তাদের সংগে এলো বেশ কয়েকটা হিন্দু পরিবার। সেই পরিবারকে প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করে জায়গা করে দেয়া হলো। তাদেরকে টুপি, জায়নামাজ দেয়া হল। ভেংগে ভেংগে তারা বলতে শিখলো, লাই ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
দোহারের খালের উত্তর পাড়ে হামিদ মোল্লার ভিটার পশ্চিম কাছ ঘেঁষে আমাদের একটি জমি ছিল। প্রতিবারের মতো সে-বছরও জমিতে আউশ-আমন ধান বোনা হয়েছিল। ভরা বর্ষায় প্রায় প্রতিদিনই আমি বাবার সাথে নৌকায় করে সেই জমি দেখতে যেতাম। বর্ষার পানিতে খালের দুই পাড় ডুবে গেছে। ভিটা বরাবর একটা বাঁক থাকায় পানির স্রোত সরাসরি ভিটায় এসে লেগে ডানে-বামে বাঁক নেয়। দোহার গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য লাশ পানিতে ভেসে আসতো; ভিটায় বাড়ি খেয়ে কিছু লাশ আমাদের ধানক্ষেতে ঢুকে পড়তো। বাবা সেই লাশগুলো নৌকা দিয়ে ঠেলে খালের মূল স্রোতে ভাসিয়ে দিতেন।
দুপুর বা বিকেলে মায়ের সাথে আমাদের বাড়ির উত্তর পাশের খালে গোসল করতে নামতাম। মা পূর্ব দিকে আমাদের দেখাতেন- পুড়িয়ে দেয়া ঢাকা শহরের সাদা-কালো ধোয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। তখনো আমরা ঢাকা শহরে যাই নি। এতদূর থেকে ঢাকা শহরের ধোয়া দেখাও আমাদের জন্য বিস্ময়কর ছিল। এবং এ দৃশ্য দেখাও আমাদের একটা দৈনন্দিন রুটিনের মতো হয়ে গেলো।
অবশেষে একদিন আমাদের গ্রামে মিলিটারিদের দেখা গিয়েছিল। ‘মিলিটারি’ বলতে আমরা পাকিস্তান আর্মিকেই বুঝতাম। কিন্তু যাঁদের দেখা গেলো, তারা পাকিস্তানি আর্মি নয়, পাকিস্তান আর্মির পোশাক ছিল খাকি রঙের (পুলিশের পোশাকের মতো)। একদিন দুপুরের দিকে দেখা গেলো কালো চক্রাপাক্রা রঙের পোশাক পরা বিরাট একটা মিলিটারির দল গ্রামের ভিতর থেকে বের হয়ে আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে যাচ্ছে (চলতি ভাষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চার-রঙা কম্ব্যাট পোশাককে আমরা বড়ো হয়েও চক্রাপাক্রা বলতাম)। সম্ভবত আমাদের দক্ষিণের গ্রাম ঘাড়মোড়া, ঝনকি বা আরো দক্ষিণে শিমুলিয়া গ্রামে তাঁদের ঘাঁটি ছিল। তাঁরা ধীর পায়ে চকের রাস্তা দিয়ে হামিদ মোল্লার ভিটা বরাবর উত্তর দিকে হেঁটে যেতে লাগলেন।
এখন যত সহজে লিখছি বা বলছি, ঐ সময়ের অনুভূতিটা এরকম ছিল না। ‘মিলিটারি’ বলতেই যেহেতু পাকিস্তান আর্মিকে বুঝতাম, এই শব্দটার মধ্যেই একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছিল। এই মিলিটারি দলটাকে দেখেই আমি আতঙ্কিত এবং যুগপৎ অবাক হলাম। যে মিলিটারির ভয়ে আমরা এতদিন জঙ্গলে গিয়ে রাত কাটিয়েছি, যারা গ্রাম-শহর পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, পাখি মারার মতো মানুষ মেরেছে, তারা আজ আমাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, অথচ গ্রামে কোনো আতঙ্ক, হৈচৈ নেই, সবকিছু খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। বাড়ির পশ্চিম পাশের একটা হিজল গাছে উঠে বসলাম আমি; আমার শরীর কাঁপছিল ভয়ে। মিলিটারিদের লম্বা সারিটি চকের রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া বিরাট একটা কালো সাপের মতো লাগছিল।
আমি আজও নিশ্চিত নই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো প্লাটুন বা কোম্পানি আমাদের দোহারে মোতায়েন হয়েছিল কিনা। যদি হয়ে থাকে, তাহলে এটা নিশ্চিত, এই মিলিটারি দলটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ। না হয়ে থাকলে এ সন্দেহ দূর হতে মনে হয় আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আমার ফেইসবুক লিস্টে আমাদের দোহারের কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি থেকে থাকেন, এ লেখাটি পড়লে এ ব্যাপারে মতামত দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো; বিশেষ করে আমাদের সুতারপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোহাম্মদ বায়েজীদ মীর স্যারের প্রতি অনুরোধ থাকলো- লেখাটি আপনার নজরে এলে দয়া করে জানাবেন, বাংলাদেশ আর্মির কোনো কোম্পানি বা প্লাটুন আমাদের দোহারে মোতায়েন হয়েছিল কিনা।
তখন হয়ত বুঝি নি; এখন এটা সহজেই অনুমেয় যে, সময়টা হয়তো ১৬ ডিসেম্বর বা এর আগে-পরের কোনো একদিন হয়ে থাকবে, যখন পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘোষণা হয়ে গেছে এবং মুক্তি বাহিনীরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে একত্র হচ্ছেন।
আরো একটি দিনের কথা অনেক বেশি মনে পড়ছে। সেদিন দুপুরে এক মিছিল এলো। ছেলেবুড়ো, যুবক সবাই সেই মিছিলে। তাদের কণ্ঠে উদাত্ত শ্লোগান। তাদের কারো কারো হাতে পতাকা। দৌঁড়ে যাচ্ছে মিছিল- প্রচণ্ড আবেগ আর উত্তেজনায় টগবগ করছে সেই মিছিল।
যখন গাঁয়ের রাস্তা জনস্রোত আর গগনবিদারী স্লোগানে টলমল করছিল, মানুষের হাতে ছিল পতাকা - কী মহোল্লাসে আমারও চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছিল- এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা, এক দুর্দমনীয় নেশা হাতে একটা পতাকা ধরার জন্য। কিন্তু ন্যাংটো শ্রীযূতকে কে দেবে পতাকা?
আমার মতো আরো অনেকের হাতেই এমন পতাকা ছিল- তাই আর মুহূর্ত দেরি নয়, হাতের নাগালেই ছিল খড় নাড়ার কাড়াল, আর ছিল আমার প্রিয় গামছাটি। আমি কাড়ালের মাথায় গামছা বেঁধে এক পলকে বানিয়ে ফেললাম বাংলাদেশের পতাকা- আর দৌড়ে মিশে গেলাম রাস্তার মিছিলে।
মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো আমাদের গ্রামের স্কুলের ময়দানে। চারদিক থেকে ছুটে আসতে লাগলো মানুষের ঢল। বিরাট মাঠ মানুষে ভরে গেলো। মাইকে অনবরত বেজে চলছে ‘আমার সোনার বাংলা’’ গানটি।
এটি ছিল সম্ভবত বিজয় দিবসের আনন্দোৎসব, গণ সমাবেশ। ১৯৭১-এ আমার প্রকৃত বয়স কত ছিল জানি না। আর যেদিনটার কথা বললাম তখন বুঝি নি, শুধু জ্ঞান হবার পরই সুনিশ্চিত ধারণায় বুঝেছিলাম ওটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর বা এর আগে-পরের কোনো একদিন।
যুদ্ধ শেষ হবার পর একদিন বিকালে হঠাৎ চাচা বাড়ি ফিরে এলেন। আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে – চাচা দুয়ারে পা দিতেই আমরা সবাই সেদিকে ছুটে গেলাম। পুলিশের পোশাক গায়ে চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। দাদি সেই চাচাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। চাচি কাঁদছেন। পুলিশকে খুব ভয় পেতাম বলে চাচার গায়ে পুলিশের পোশাক দেখে আমি ভয়ই পেয়েছিলাম। আসলে পুলিশ নয়, বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকা গিয়ে চাচা আনসার বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।
উত্তাল ১৯৭১ শেষ হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন। যদিও তখন আমরা এর অনুভূতি সম্বন্ধে কিছু বুঝি না। বুঝি শুধু চাচার গল্প। সন্ধ্যায় খাওয়া দাওয়ার পর পরই দুয়ারে বিছানা বিছিয়ে চাচাকে ঘিরে বসে পড়তাম আমরা। চাচা যুদ্ধকালীন ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতেন একনাগাড়ে। চাচার বর্ণনা এমন ছিল যে, অনেক সময়ই তার কথা শুনে আমাদের গা শিউরে উঠতো। কুর্মিটোলা থেকে পাকিস্তান আর্মি বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যায় – এরকম লিরিকের একটা গান গাইতেন চাচা। যুদ্ধ শেষ হবার ৪/৫ বছর পর পর্যন্ত প্রায় নিয়মিতই চাচার গল্প শুনতাম এভাবে।
বড় হয়ে পড়ালেখা ও জীবিকার জন্য বাড়ি ছাড়লাম। বাড়িতে গেলে কোনো কোনো অবসরপূর্ণ সন্ধ্যায় আগের মতোই চাচার মুখে সেই যুদ্ধের কাহিনি শুনতে বসে পড়তাম। ২৫-৩০ বছর আগের কথা কী ঝলমলে ভাষায় বলে যেতেন চাচা, যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদ্য ফেরত এলেন। চাচার মুখে সেই যুদ্ধের কাহিনি শুনি বাল্যকালের মতোই গা শিউরে উঠতো।
২
একটা আশ্চর্য ভাবনা মাত্র কয়েক মাস আগে থেকে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। চাচার কাছে তো কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ছিল না- মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় কি তাহলে চাচার নাম অন্তর্ভুক্ত হয় নি?
মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, নামীয় তালিকা হালনাগাদকরণ- বড়ো হয়ে এই বার্নিং ইস্যুগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হবার অনেক সুযোগ হয়েছে আমার- কিন্তু আশ্চর্য, একটি দিনের জন্যও আমার মনে হয় নি, দেখি তো চাচার নামটা কোন সেক্টরে দেখানো হয়েছে- দেখি তো চাচার নামটা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা- আশ্চর্য, ঘুণাক্ষরেও এ বিষয়টি আমার মনে উঁকি দেয় নি। এমনকি আমার চাচাকেও কোনোদিন বলতে শুনি নি- আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। শুধু যখন যুদ্ধের দিনগুলোর কথা আলোচনা প্রসঙ্গে কোথাও উঠে আসতো- দেখতাম অনর্গলভাবে চাচা বলে যাচ্ছেন- কীভাবে জঙ্গলে জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়েছে- গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধাদেরকে কীভাবে তাঁরা শুশ্রূষা করেছেন- এসব।
নিজেকে যখন খুব অপরাধী মনে হলো- তখন একবার মনে মনে ভাবলাম খুঁজে দেখি চাচার নামটা সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আছে কিনা। পরক্ষণেই ভাবলাম- কী লাভ, চাচার নামটা কোথাও খুঁজে না পেলে তো শুধু আমার কষ্টই বাড়বে, আর কিছু না তো। আমার দরিদ্র চাচা জীবিতাবস্থায় জীবিকার জন্য অনেক কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হয়তো জানতেনও না 'দরিদ্র' মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার থেকে কী কী সুবিধা দেয়া হচ্ছে, এ নিয়ে তাঁকে কোনোদিন একটা কথাও বলতে শুনি নি - যুদ্ধ করলাম, অথচ সরকার আমারে কিছুই দিল না।
আমার চাচার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় না থাকলে এমন কীই বা ক্ষতি আমার বা চাচার পরিবারের? তাতেই তো আর প্রমাণিত হলো না যে আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। আমার চাচা যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার সবচেয়ে বড় দলিল তো আমি নিজে- এখনো চোখের সামনে উজ্জ্বল ভাসে- যুদ্ধ শেষ হবার পর কোনো এক বিকেলে চাচা বাড়ি ফিরে এলেন- আমার দাদি 'আনছের আনছের' বলে চাচার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন- সেই দৃশ্য আজও এতটুকু ম্লান হয় নি।
আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর ২০০৬ সনের ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। আপনারা আমার চাচার রুহের মাগফেরাত কামনা করবেন প্লিজ।
(১ নম্বর সিকোয়েলটি ১৯৯১ সনে লেখা এবং পরবর্তীতে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত। ১ নম্বর সিকোয়েলের ঘটনা অবলম্বনে আমার প্রথম উপন্যাস ‘স্খলন’-এ একটা পরিচ্ছেদ রয়েছে। ২ নম্বর সিকোয়েলটি ২০০৯ সালের দিকে লেখা)
(১৫ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে এডিট করা হলো)