ঐ ব্যাটা ফাজিল, তুই এখানে কেন? করিম কাছে এসে আমার বাহুতে ধাক্কা দিতেই সম্বিৎ পাই। রাগে শরীরটা জ্বলে উঠলো। শালা লোচ্চা, এতক্ষণ এতগুলো মেয়ের মনের ভিতরে ঢুকে নাচানাচি করছিলি। এই মাত্র বেরিয়ে এসে আবার কথা বলছিস, না?
কিন্তু বাস্তবে রাগতে পারলাম না। মুখটা হাসি হাসি করে বললাম, তুই এখানে আর তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান।
করিম ধমকে উঠে বললো, আমিও যে চান্দু তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান জানো? তোমাকে দেখবার জন্য মেয়েরা পাগল হয়ে গেছে।
করিমের কথায় আমি দারুণ বিস্মিত হই, মেয়েরা আমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে? চাপা মারবার আর জায়গা পাস না বুঝি?
তুই বিশ্বাস করছিস না? করিম খুব সিরিয়াস হয়ে বলে, জানিস, তোর কবিতা পড়ে প্রায় এক ডজন মেয়ে তোর প্রেমে পড়ে গেছে, জানিস?
আমি মনে খুব কষ্ট পেলাম। করিমের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে মেয়েগুলোর সাথে আমার কোন পরিচয় হওয়া সম্ভব নয়। পরিচয় হওয়ার পর ওদের মনেও প্রচুর কষ্টের সঞ্চার হবে নিশ্চয়। অদেখা প্রিয় মানুষটিকে ওরা যতখানি আকর্ষণীয় ভাবছে, আমি তার কিছুমাত্র না।
আমি বললাম, চল্, তোর রুমে যাব।
করিম বললো, আমার রুমে পরে যাওয়া যাবে। আগে চল্ পরিচয় করিয়ে দিই। বলেই করিম আমার হাত ধরে টানতে লাগলো।
আমি বললাম, আমি যাব না।
করিম ক্ষেপে গিয়ে বললো, তুই যাবি না, তোর বাপে যাবে, চৌদ্দ গুষ্টি যাবে --
আমি বললাম, না যাব না --
করিম বললো, হ্যাঁ যাবি, যাবি ----
না, না ---
হ্যাঁ, হ্যাঁ ---
করিম আমাকে সামনের দিকে টানা হেঁচড়া করে টানতে লাগলো, আমি পেছনের দিকে বেঁকে থাকলাম।
আমাকে টেনে সামনে নিতে না পেরে করিম মেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো, ঐ দাড়াঁরে --- ঐ ---- ইয়ে -- ঐ --- । এরূপ ঐ ঐ ইয়ে ইয়ে ডাকতে ডাকতে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
করিমের এহেন পাগলামী দেখে আমি না হেসে পারলাম না। ঐ ঐ বলে সে কাকে যে ডাকছে বোঝা গেল না। হতে পারে সে এই মুহূর্তে সবার নামই ভুলে গেছে, হতে পারে সে কারো নামই জানে না, হতে পারে অতি আবেগে মেয়েগুলোর কারো নামই ওর মুখে আসছে না, হতে পারে সে সবার নামই জানে, কিন্তু কার নাম ধরে ডাকবে আর কে অখুশী হবে, এটা চিন্তা করেই হয়তো আপাত-পাগল, কিন্তু সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন করিম মিয়া ঐ ঐ ইয়ে ইয়ে নামটাকেই বেছে নিয়েছে।
আবদুল করিম মেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে কোথায় চলে গেল - আম-কাঁঠালের অন্ধকারে ওর গলার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো - মেয়েগুলোর সাথে ওর মোলাকাত হলো কিনা বোঝা গেল না। আমি বেকুবের মত আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থেকে আবদুল করিমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
মিনিট পাঁচেক পর আবদুল করিমকে ফিরে আসতে দেখলাম।
তুই একটা মস্ত বড় পাগল। আমি বললাম।
আর তুই একটা ভেড়া - একটা ছাগল - মস্ত বড় একটা রাম ছাগল। বলেই আবদুল করিম বাতাসের ঝাপটা দিয়ে আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল। ওর পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে আমি ডাকলাম, এই দাঁড়া না, দাঁড়া, কথা আছে।
যা বেটা ফাজিলের বাচ্চা ফাজিল। বলে আবদুল করিম হনহন করে ছুটে চলে গেল।
আরো কিছু দেরি হয়ে গেল। রুমে ফিরতে মন চাইছিল না। আসলে আমার ভালো লাগছিল না কিছুই। মন যে কি চাইছিল তা আমি নিজেও স্থির বুঝতে পারছিলাম না, এই বয়সে যা হয় আর কি। এমনি উৎক্ষিপ্ত মনে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
প্রায় আটটা বেজে গেছে। রুমে ঢুকে দেখি পুরো ঘর অন্ধকার। মশাগণ মহানন্দে ভণভণ করছেন। বাইরের আবছা আলোয় দেখতে পেলাম, চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখ হাঁ করে বিভোরে ঘুমোচ্ছে প্রজাপতি দেখার জন্য সদ্য পাগল হওয়া আমার বন্ধুবর জনাব শেরখান। আমি অবাক হলাম, ওর তো এভাবে ঘুমোবার কথা নয়। ওর মাথায় পোকা ঢুকেছে। মাথায় কোন পোকা ঢুকলে কেউ কখনো এভাবে ঘুমোতে পারে? আমি ভাবলাম, হয়তো এমনও হতে পারে সে আজ তার পরম আরাধ্য প্রজাপতির সন্ধান পেয়েছে, দেখে দেখে সাধ মিটেছে বলেই এখন সে পরম তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছে। আহ্, কি যে সুখ, কি যে শান্তি, প্রশান্তিতে শেরখানের বুক ভরে আছে। এমন সুখের সময়ে পড়ালেখা করে কোন্ পাগলে? তাই তো এখন পড়ালেখার কথা ভুলে গিয়ে শেরখান পরম শান্তিতে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। পরীক্ষা পাশের সুখ কি এর চেয়ে বড়?
বাতি জ্বালতেই শেরখান ধড়মড় করে উঠে হাত-ঘড়ির দিকে তাকালো। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর প্রচণ্ড রেগে গেল। আমার দোষ হলো, আরো আগে ওকে আমি ঘুম থেকে ডেকে তুলিনি কেন। কাল পরীক্ষা, অথচ এখনো বইয়ের চারি আনাও রিভিশন দেয়া শেষ হয়নি। এক নাগাড়ে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসা অবস্থায়ই শেরখান ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমার প্রতি ওর অভিযোগ হলো, এই যে সে অনিচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে পরীক্ষার পূর্বরাত্রে মূল্যবান তিন ঘন্টা সময় নষ্ট করলো, তার জন্য একমাত্র আমিই দায়ী। পড়তে পড়তে কেউ ঘুমিয়ে পড়লে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার পবিত্র দায়িত্ব একমাত্র রুমমেটেরই। আমি সেই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। আজকের এই তিন ঘন্টা সময় অপচয় করার ফলে যদি শেরখান পরীক্ষায় ফেল করে বসে তাহলে সে আমার বিরুদ্ধে কেসও করে বসতে পারে। শেরখানকে এর আগে এতখানি বিদ্রোহী এবং উত্তেজিত হতে দেখেছি বলে মনে পড়লো না।
আমি শেরখানকে বললাম, ওরে চান্দু, আমি কি এতক্ষণ ঘরে ছিলাম? আসলামই তো কেবল?
এ কথা শুনে সে আরো ক্ষেপে গেল। বললো, কে তোকে বাইরে যেতে বলেছিল? ঐ বেটা নিমক হারাম, আমার মা তোকে বারবার পিঠে হাত দিয়ে বলে দেয়নি যে আমি টেবিলে বসে ঘুমাই, তুই যেন আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে রাখিস? বল্, তুই জানিস না?
আমি ওর কাছে হাত জোড় করে মাফ চাইতে গেলাম। শেরখান 'মাফের গুষ্টি' কিলিয়ে চুপ হয়ে গেল। আমি দু-ঠ্যাং ছড়িয়ে খাটের ওপর শুয়ে পড়লাম। দেখলাম, শেরখান ঘন ঘন পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। চোখ মুখ দারুণ গম্ভীর তার।
আমি শোয়া থেকে উঠে বসি। তারপর হেসে হেসে জিজ্ঞাসা করি, প্রজাপতির খবর কি রে?
শেরখান কোন জবাব দিল না। আমি আবার জিঞ্চাসা করি, খবর কি রে দোস্তটি?
শেরখানের গলার স্বরে কোন পরিবর্তন হয়নি। সে বললো, পড়ার সময় পেঁচাল পারিস না।
আমি অবাক হলাম, বাব্বাহ্, এ দেখি রামের সুমতি!
কাল পরীক্ষা। হেলায় সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। ভবিষ্যতে কবি হবো তাতে কি, পরীক্ষার পড়াও পড়া উচিত, কি বলেন? আমি বই খুলে পড়তে বসলাম। কয়েক ছত্র পড়েই মনে হলো কালকের পরীক্ষার জন্য আমার রিভিশনের আর দরকার নেই। তবু আনমনে বই খুলে পাতা নাড়তে থাকলাম। এক সময় লক্ষ্য করি যে ঘুমে আমার চোখও ঢুলু ঢুলু। আশ্চর্য, আমার তো আগে কখনো এমনটি হয়নি। তাহলে কি আমি শেরখান কর্তৃক আবেশিত হয়েছি?
প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়া মাত্রই আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করলাম - অর্ধেক প্রশ্নও কমন পড়েনি। দেখি, গতবারের প্রশ্নপত্র থেকেই অধিকাংশ প্রশ্ন সেট করা হয়েছে। আগের বারের প্রশ্ন কি কেউ কখনো পড়ে? আমিও পড়িনি। আমার সর্বাঙ্গে কম্পন শুরু হয়ে গেল। বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা, টেনে টুনে বড় জোর পঞ্চাশ নম্বরের উত্তর দেয়া যাবে। পঞ্চাশ নম্বরের উত্তর থেকে কি পাশ নম্বর পাওয়া সম্ভব? তা-ও হয়তো টেনে টুনে পাশ নম্বর পেলাম, কিন্তু আমার না একটা রেকর্ড সৃষ্টিকারী রেজাল্ট করার কথা ছিল? প্রথম পরীক্ষায়ই যদি এরকম গোল্লা মারি, আর গুলো তো পড়েই আছে, তার মধ্য থেকেও যদি আরো দু-চারটের ভাগ্য এমন হয়, তাহলে তো রেকর্ড সৃষ্টি দূরে থাক, ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়াই একান্ত দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
আমি লিখতে শুরু করলাম, কিন্তু কলম সরে না। সব প্রশ্ন কমন না পড়ায় মনের জোর একেবারে ভেঙ্গে গেছে। অত্যধিক চিন্তায় জানা প্রশ্নগুলোও এখন মনে পড়ছে না ঠিক মত। আমার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল। অন্যদের অবস্থা কি? আমার যেহেতু অর্ধেক প্রশ্নও কমন পড়েনি, বাকিদের ব্যাপারে বলাই বাহুল্য, ওরা আজ কেউ-ই পাশ করতে পারবে না। ওদের শোচনীয় করুণ চেহারা দেখার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে এক নজর ডানে বামে তাকালাম। কিন্তু আশ্চর্য, কারো চোখে মুখে দুশ্চিন্তার বিন্দু মাত্র ছাপ নেই, বরঞ্চ সবাই কি সুন্দর হাসি হাসি মুখটি করে এক মনে দ্রুত লিখে যাচ্ছে। আমি কেবলই অবাক হচ্ছি, অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে আমার চেয়েও ভালো পরীক্ষা দেয়ার কেউ আছে এই জয়পাড়া কেন্দ্রে, এটা কিভাবে হয়? আমার মনের দুরবস্থা আরো বেড়ে গেল বহুগুন। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম, আমি যেন এখন সবই ভুলে গেছি।
এমন সময়ে হাসতে হাসতে হলে ঢুকলেন মাবুদ স্যার, তাঁর প্রথম দৃষ্টি পড়লো আমার ওপর। আমার সামনে এসেই পিঠে হাত বুলিয়ে জিঞ্চাসা করলেন, কি রে ফাগলা, আঁশি ফাবি তো? আঁশি না ফেলে তোর মাথা কিন্তু ফাডিয়ে ফেলবো। (স্যার সচরাচর প-কে ফ উচ্চারণ করেন। কখনো একেবারে 'ঘরের' ভাষা ব্যবহার করেন, আবার কখনো খাঁটি ও শুদ্ধ উচ্চারণ করেন। এসব নির্ভর করে তাঁর মেজাজ-মর্জির ওপরে। কিন্তু তাঁর এ মর্জি আমরা কখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না)।
আমি হাঁউমাঁউ করে কেঁদে দিলাম। মাবুদ স্যার কিছু বুঝে উঠতে না পেরে জিঞ্চাসা করলেন, কি রে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে, কাঁদছিস কেন?
আমি আরো জোরে কেঁদে উঠলাম। বললাম, আমি ফেল করবো স্যার, ফেল করবো, ফেল করবো, একটা প্রশ্নও কমন পড়েনি, ও স্যার, আমি ফেল করবো --
এভাবে ঘুমালে তো ফেলই করবি। ও--ই-- ঘুমাচ্ছিস কেন, পণ্ডিত, ওঠ্, ওঠ্---
আমি লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। মাবুদ স্যার আর শফিক স্যার আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
মাবুদ স্যার বললেন, মাত্র তো নয়টা বাজলো। ঘুমাচ্ছিস কেন? সব রিভিশন শেষ করেছিস?
আমি কাচুমাচু করে বললাম, করেছি স্যার।
স্যার বললেন, গুড। তাহলে আর খামাখা রাত জাগিস না। খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়। ভোরে উঠে নামাজ পড়বি, তারপর আরেকটা রিভিশন দিবি, ব্যস।
আমি বললাম, জ্বি স্যার।
মাবুদ স্যার শেরখানের দিকে ঘুরলেন। শেরখান অতি সুবোধ বালক, সে মাথা নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল খুঁটছিল, বোধ হয় গত মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওখানে একটা চুলকানির মত হয়েছে।
মাবুদ স্যার জিঞ্চাসা করলেন, ফোলা, ফার্স্ট ডিভিশন ফাবি তো? না ফেলে কিন্তুক আমি তোর মায়রে কমু, আফনে শেরখানরে তেইজ্য ফুইত্র কইর্যা দেন। তেইজ্য ফুইত্র অইলে না বুইজবি বাফের হোডেলে কত বাকি খাইছস। (এটি স্যারের 'ঘরের' ভাষা)
শেরখান জানতো মাবুদ স্যার এখন এই প্রশ্নটিই করবেন, প্রশ্নের উত্তরও তার কাছে সর্বদা রেডিমেড থাকে, তা যে কোন প্রশ্নই হোক না কেন। সে ঝটপট জবাব দিল, স্যার, ফার্স্ট ডিভিশন কোন ব্যাপারই না। আপনে দেখবেন, মালিকান্দা হাইস্কুল থেকে যদি মাত্র একটা ফার্স্ট ডিভিশনও কেউ পায় তবে সেটা হবে শেরখান। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার নিচু মুখটা যেমন উঁচু হয়, তার বুকটাও তেমনি উন্নত হয়ে ওঠে।
ছেলের আত্মবিশ্বাসে অভিভূত হয়ে মাবুদ স্যার শেরখানের পিঠ চাপড়ে বলে উঠলেন, সাব্বাস, সাব্বাস। এই তো ছাই। তুই বেডা দেখিস, যদি এখটু ছেষ্টা করস তয় তর স্টার মার্ক্স ঠেকায় কে, আমারে না ক দেখি?
স্যারেরা এরপর মাত্র মিনিট দুয়েকের মত থাকলেন। পরীক্ষার রাতে ছাত্রদের সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।
দরজা পর্যন্ত গিয়ে মাবুদ স্যার ফেরত এলেন। প্যান্টের পকেট হাতড়ে দুটি চকোলেট বের করে একটা আমার দিকে, আরেকটা শেরখানের দিকে ছুঁড়ে মেরে বললেন, নে নেবুনচুস খা। তারপর মুচ্কি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
স্যারেরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ধপাস করে পা ছড়িয়ে খাটের ওপর শুয়ে পড়লাম, আর শেরখান ঘঁপাৎ করে চেয়ারে বসে গভীর মনোনিবেশে অধ্যয়ন শুরু করে দিল।
মিনিট পাঁচেক পর অলস স্বরে টেনে টেনে ডাকলাম, শে ....র ....খা .....ন।
শেরখান নিরুত্তর।
আবারও ডাকলাম, ও বাবা শেরখান, শে ....র ....খা ....ন।
শে ....র ....খা ....ন।
শে ....র ....খা ....ন।
এই শালার শেরখান। আমি শেষ বার একটু জোরে ডাকতেই শেরখান ধমকে উঠলো, ডিস্টার্ব করছিস কেন?
আমি বললাম, চল্, খেয়ে নিই। ---- চল না খাই।
হঠাৎ ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ষাঁড়ের মত তেড়ে এসে শেরখান আমাকে এলোপাথাড়ি লাথি শুরু করে দিল। বললো, বল শালার ফাজিলের হাড্ডি, বল্ এত ডিস্টার্ব করছিস কেন, বল্, বল্, বল্ ----
আমি প্রতিরক্ষা নেবার আগেই আমার স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে গোটা পাঁচেক লাথি বসিয়ে দিয়ে শেরখান পূর্ববৎ পাঠোধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করলো। আমি বললাম, তুই শালার একটা বে-আক্কেল, এমন জায়গায় কেউ লাথি মারে? আরেকটু হলেই তো গেছিলাম। কিন্তু শেরখান নির্বাক ও নিরুত্তর, যেন সে কিছুই করেনি, আমারও কিছুই হয়নি।
আমি ঐ অবস্থায়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘরঘর শব্দে ঘুম ভাংলো। দেখি শেরখান চেয়ারের পেছনে মাথা ঠেকিয়ে মুখে বিশাল একটা হাঁ বানিয়ে ঘর-ঘর-র-র করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
আমি উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি হাতে নিলাম। তারপর ওর সামনে গিয়ে ওর মুখের চোঙ্গায় পানি ঢালতে শুরু করলাম। ঘঁৎ ঘঁৎ করে সে কয়েক ঢোক গিলে ফেললেও বাকিটুকু আর পারলো না। চেতন হয়েই সে বাথরুমে ঢুকলো। বাথরুম থেকে এসে সোজা বিছানায়। আমি ডাকতে থাকলাম, চল খেয়ে নিই। চল্ খাই। শেরখান কি আর আমার কথা শুনতে পায়? সে এখন স্বপ্নে প্রজাপতিদের সাথে উড়তে শুরু করে দিয়েছে।
আমি আর কি করবো? ভাতের হাঁড়ি খুলতেই ফক করে পঁচা ভাতের উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগলো। তরকারীর অবস্থাও তাই। কিন্তু আমার অবস্থা এখন যে রকম খাই খাই, তাতে পঁচা হোক আর যা-ই হোক পেটে একটা কিছু দিতে হবেই। আমি সেই পঁচা-ধচাই পরম তৃপ্তির সাথে খেয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ফজরের আজানে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পরে খেয়াল হলো, আজান শেষ হয়েছে বেশ আগেই, সেটা স্বপ্নের ভিতরে কানে এসে লেগেছিল। আসলে শেরখান ওর বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে ডাকছে, নাহিদ, না..হি..দ, ওঠ্, আজান পড়ে গেছে। না...হি...দ।
আমি উঠে পড়লাম। শেরখানও। সারা রাত লাইট জ্বলেছিল ঘরে। বিছানায় বসে দুজনে কিছুক্ষণ চোখ ডললাম।
শেরখান বললো, চল্, আজ নামাজ পড়তে হবে।
আমি বললাম, হ্যাঁ রে দোস, আজকের নামাজটায় অনেক বরকত পাওয়া যাবে। তুই দেখিস, আজ কম পক্ষে ১০টি নম্বর আমরা বেশি পাব।
শেরখান খুব উৎফুল্ল হয়ে বললো, একদম ঠিক। চল্ তাড়াতাড়ি যাই।
জয়পাড়া হাইস্কুলের মসজিদে আমরা ফজরের নামাজ পড়লাম। আমাদের মত আরো অনেক অনিয়মিত নামাজীদের দেখলাম মসজিদে। নামাজ শেষে মোনাজাতের আগে জনৈক ছাত্র হুজুর সমীপে আর্জি পেশ করলো, আজ যেন আমাদের মত অবলা ছাত্রদের জন্য আল্লাহ্র কাছে বিশেষ মোনাজাত প্রার্থনা করা হয়, যাতে আমরা ছহী ছালামতে পরীক্ষা শেষ করতে পারি, যেন সবার মনের বাসনা আল্লাহ্ তা'য়ালা পুরা করে দেন।
সহৃদয় হুজুর আমাদের জন্য সেদিন এক দীর্ঘ মোনাজাত করেছিলেন। হুজুরকে আমরা অনেকেই চিনতাম না। আমাদের জন্য যতখানি দরদ দিয়ে তিনি সেদিন মোনাজাত করেছিলেন, তার প্রতিদান হয়তো কোনদিনই দেয়া সম্ভব হবে না।
পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রায় এক ঘন্টা আগে ফুরফুরে মনে কেন্দ্রের দিকে ছুটলাম। শেরখান গেল না। সে বললো, মাত্র তো পাঁচ মিনিটের পথ। এত আগে হলে গিয়ে কি ঘোড়ার ঘাস কাটবো? যাওয়ার পথে কবির উদ্দিনের ওখানে ঢু মারলাম। সে বললো, ইনশাল্লাহ্, আর আধ ঘন্টার মধ্যেই আমার রিভিশন শেষ হবে, শেষ হলেই আসবো। আমার আসলে সকাল বেলা, সেই ফজরের নামাজের পর পরই হলে যেতে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু অত আগে তো আর হলে ঢুকতে দিবে না, আর দিলেও হলে বসে তো আর ঘুমোবার কোন মানে হয় না। তাই এক ঘন্টা আগেই বেরিয়ে পড়লাম। আমি মনে করলাম, আজ যেহেতু প্রথম পরীক্ষা, তাই একটু আগে আগেই হলে যেতে হবে। কোথায় সীট পড়েছে সেটা দেখতে হবে, তা ছাড়া পরীক্ষার আগে আগে সবার সাথে এক-আধটু মোলাকাত হওয়ারও তো প্রয়োজন আছে।
দূর থেকেই স্কুল গেইটের কাছে চার-পাঁচটা মেয়ের একটা জটলার মত দেখতে পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, ওদের আবার কি হলো যে ঘন্টা খানেক আগেই হলে চলে এসেছে? আমার মত ওদেরও ভূতে ধরেনি তো? ওদেরও বোধ হয় ঘরে মন টিকছিল না। আমি বেশ উৎসুক হয়েই ওদের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কাছাকাছি হয়ে দেখি ও-গুলো সব আমাদেরই (দুই ভাগ অধিকার সংরক্ষিত)।
সর্ব প্রথম ঘাড় ঘুরিয়ে যে মেয়েটি আমার দিকে তাকালো তার নাম প্রমীলা। তখনো পর্যন্ত আমি 'বনলতা সেন' পড়িনি। কিন্তু প্রমীলার চোখে আমি দেখতাম অথই সাগরের তীরভাঙ্গা উত্তাল ঢেউ, ওর চুলের অরণ্যে হারিয়ে যেত অসংখ্য দিশেহারা যুবক। কিন্তু প্রমীলার সাথে আমার কোনদিন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। অথচ আমার অবস্থান, ব্যক্তিত্ব ও মেধা সব মিলিয়ে সেদিন কি দারুণ সম্ভাবনাময় ছিল আমাদের প্রেম!
প্রমীলার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বদলে সব সময় একটা প্রতিযোগিতার ঠাণ্ডা যুদ্ধ বিরাজমান ছিল। আমার মনে হতো, ওর মত অহংকারী কোন মেয়ে হতে পারে না, রূপ ও মেধার দাম্ভিকতায় যার চরণ কখনো মাটি স্পর্শ করে না। সে যখন ঘাড় দুলিয়ে হাঁটতো, আপামর ছাত্রকুল তন্ময় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। সে যখন ঈষৎ বাঁকা চোখে এক নজর তাকিয়ে এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিত, সেই হাসিতে বুক ঢিভ ঢিভ করা ছাত্রগুলো যেন নিমেষে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেত।
প্রমীলা খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল এবং এটাই ছিল ওর সবচাইতে বড় অহংকার। দেশে তো আর সুন্দরী মেয়ের অভাব নেই, কিন্তু কটা সুন্দরী মেয়ে আর প্রমীলার মত এত মেধাবিনী? এ ব্যাপারে প্রমীলার সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, মেধাবিহীন সুন্দরী মেয়েদেরকে সুন্দরী না বলে বলা যেতে পারে ফর্সা, গায়ের চামড়া কালো নয়, এমন। ওরা মাকাল ফলের মত।
যখন মেয়েদেরকে আলাদা শিফ্টে পড়ানো হতো তখন ওর রোল নম্বর বরাবরই এক হতো। আমরা যে বছর সপ্তম শ্রেণীতে উঠি সে বছর কবি নজরুল গার্ল্স হাইস্কুল চালু হলো। মেয়েরা দলে দলে মালিকান্দা হাইস্কুল ছেড়ে কবি নজরুলে চলে গেল, আমাদের স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা একেবারে কমে গেল। মুষ্টিমেয় কয়েক জন মেয়েকে নিয়ে পৃথক শিফ্ট চালানো লাভজনক হয় না। অতএব মেয়েগুলোকে ছেলেদের সাথে মিলিয়ে দিয়ে এক শিফটে সহশিক্ষা চালু করে দেয়া হলো।
প্রমীলা যদি এ স্কুল ছেড়ে কবি নজরুলে গিয়ে ভর্তি হতো তবে নতুন স্কুলটির সুনাম বৃদ্ধির জন্য সে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারতো। কিন্তু কেন যেন প্রমীলার মনে হয়েছিল, মাবুদ স্যারের কাছ থেকে শোনা কথা, ছেলেদের সাথে একত্রে পড়লে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এবং তাতে প্রমীলার মেধা বিকাশের সুযোগ বরং বেড়েই যাবে। প্রমীলার নাকি আরো একটা প্রচণ্ড খায়েশ ছিল এবং এতে ওর নাকি প্রচুর আত্মবিশ্বাসও জন্মেছিল যে, স্কুলের পরীক্ষায় সম্মিলিতভাবে প্রথম স্থান অধিকার করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দেবে যে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, এ স্কুলের ছেলেগুলো সব ভেড়া এবং ওর কাছে অতি তুচ্ছ।
সপ্তম শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় মেয়েরা আগাম ঘোষণা দিয়ে দিল, এবারের পরীক্ষায় ছেলেদেরকে পেছনে ফেলে প্রমীলাই প্রথম স্থান অধিকার করতে যাচ্ছে।
স্কুলের কোন পরীক্ষায় আমি কখনো দ্বিতীয় হইনি। এবার কি প্রমীলার কাছে আমার পরাজয় ঘটতে যাচ্ছে? আমার মনটা দুর্বল হয়ে গেল।
যথাযোগ্য ভাব-গাম্ভীর্য্য এবং ছাত্রীদের প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। পরীক্ষা চলাকালে কয়েকটি ছেলে অবশ্য টিটকিরি দিয়ে খোঁচা মারতে ছাড়লো না, এতদিন তো বেশ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছ। সেদিন শেষ।
পরীক্ষার পর গ্রীষ্মের ছুটি। ছুটিতে আমার মনমরা ভাব কাটলো না।
ক্লাস শুরু হওয়ার তিন দিনের মাথায় অংক খাতা দেখানো হলো। অংক আমার সবচাইতে প্রিয় বিষয়, সঙ্গত কারণেই অংকে আমি সবচাইতে ভালো নম্বর পেয়ে থাকি। অংক স্যার রাধেশ্যাম বাবু একে একে সবাইকে ডেকে খাতা দিচ্ছেন আর প্রাপ্ত নম্বর ঘোষণা করছেন। শেরখান হলো ছেলেদের মধ্যে আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, তারপর ইমরান, তারপর কবির উদ্দিন, জাহিদ। ওরা কেউ ৮০-র ঘর ছুঁতে পারলো না, আর কেউ-ও না। স্যারের হাতে আর মাত্র দুটি খাতা দেখতে পাচ্ছি - একটি আমার, অন্যটি প্রমীলার। আসন্ন পরাজয়ের আশংকায় ও লজ্জায় আমার বুক দুরু দুরু করছে। এমন আতঙ্কের মধ্যে যখন স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি, তখন তিনি আমাকে ডাকলেন, আমার কলজে আঁতকে উঠলো। খাতা হাতে দেয়ার আগেই স্যার প্রাপ্ত নম্বর ঘোষণা করলেন, ৬৮।
আমার চোখে পানি এসে গেল, আমি এর আগে কোনদিন অংকে এত কম নম্বর পাইনি। কাঁপতে কাঁপতে স্যারের হাত থেকে খাতা এনে সীটে বসে পড়লাম। আমার হাত কাঁপছে প্রচণ্ড। বেঞ্চির ওপরে খাতাটি পড়ে আছে। আমার কান্না পাচ্ছিল, পৃষ্ঠা খুলে খাতার ভিতরে দেখতে ইচ্ছে করছিল না। আমার এতগুলো অংক কাটা গেল? এত খারাপ পরীক্ষা তো আমি দিইনি!
হঠাৎ সারা ক্লাসের মধ্যে একটা গুঞ্জরণ ছড়িয়ে পড়লো। সামনে তাকিয়ে দেখি মেয়েরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে, প্রমীলাকে দারুণ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে।
আমার বাম পাশে বসা ছিল জসীম। ওকে ঠেলা দিয়ে নরম স্বরে জিঞ্চাসা করি, ব্যাপার কি রে?
প্রমীলা হাইয়েষ্ট মার্ক পেয়েছে। জসীম বললো।
আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি ছেলেদের মধ্যেও হাইয়েষ্ট মার্ক পাইনি তাতে আমার কোন দুঃখ নেই, মনোকষ্ট নেই; যদি শেরখান, কিংবা জাহিদ, কিংবা ইমরান, কবির উদ্দিন ওরা প্রত্যেকেই ১০০-তে ১০০ নম্বর পেত, তা-ও আমার আত্মা শান্তি পেত, কিন্তু আফসোস, ঐ যে প্রমীলা, দেমাগে যার মাটিতে পা পড়ে না, ওর কাছে আমার এ পরাজয় কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এ যে প্রমীলার কাছে নাহিদের পরাজয় নয়, পুরো মেয়েজাতির কাছেই ছেলেজাতের পরাজয়। আমার অন্তরের ভিতরে দাউ দাউ আগুন জ্বলতে লাগলো, হায়, আমি প্রমীলার চেয়ে কম নম্বর পেলাম!
মিনিট দশেক পর স্যার খাতা জমা দিতে বললেন। আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন, সবার কাছ থেকে খাতা সংগ্রহ করে জমা দিলাম।
কিন্তু হায়, আমি যে আমার নিজের খাতাটা চেক করিনি! আমি দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলাম। বেশ কিছু অংক কাটা গেছে বটে। খুব খারাপ লাগতে লাগলো।
টিফিন পিরিয়ডে সেদিন মেয়েদের মধ্যে কি যে আনন্দ-ফুর্তি আর উত্তেজনা! প্রমীলা মেঘুলা বাজার থেকে প্রচুর রসওয়ালা রসগোল্লা আনিয়ে ক্লাসের মেয়েগুলোকে খাওয়ালো। সারা ক্লাসে ধন্য ধন্য পড়ে গেল - হ্যাঁ রে, বাপের বেটী থাকলে একজনই আছে, এ স্কুলের নাম একদিন সেই জাগাবে।
প্রমীলার দেমাগ অবশ্য আকাশ ছুঁতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ছুঁতে পারলো না। অন্যান্য খাতাগুলো যখন দেখানো হলো, দেখা গেল প্রমীলা প্রত্যেকটা বিষয়ে অত্যন্ত ভালো নম্বর পেয়েছে, তবে সর্বোচ্চ নম্বরধারীর স্থান বহাল তবিয়তে আমার দখলেই আছে। আরেকটি কথা অবশ্য না বললেই নয়, প্রমীলার মনে আঘাত দেয়ার কোন ইচ্ছে অন্তত আমার মনে ছিল না, কোনদিনই না - অংক খাতা দেখানোর পাঁচ-ছয়দিন পর রাতে ঘুমোবার আগে হঠাৎ আমার মনে পড়েছিল, আরে, অংক পরীক্ষায় তো আমি অনেকগুলো অতিরিক্ত খাতা নিয়েছিলাম, কিন্তু খাতা দেখানোর সময় কি মূল খাতার সঙ্গে অতিরিক্ত পাতাগুলো সংযুক্ত ছিল? আমি বাড়িতে সে রাতে শুয়ে শুয়ে ঠিক মত মনে করতে পারলাম না।
পরদিন রাধেশ্যাম স্যারকে বিনয়ের সাথে সে কথা বলতেই তিনি এক গাল সরল হাসি হেসে দিয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ রে পাগল, আমি তো তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসায় সেদিন ড্রয়ার খুলতেই দেখি সেখানে তোর পরীক্ষার খাতার অতিরিক্ত পাতাগুলো পড়ে আছে। খাতা দেখার সময় পিন খুলে ছুটে গিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল। তখন তো আর দেখিনি, পরে যখন চোখে পড়েছিল তখন ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। ও নিয়ে ভাবিস না। নম্বর আমি ঠিকই যোগ করে দিয়েছি। ৮৪ পেয়েছিস।
প্রমীলা ৭৭ নম্বর পেয়ে তার আগে পর্যন্ত সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার গৌরবে উদ্ভাসিত ছিল। আমার অতিরিক্ত নম্বর পাওয়ার কথাটা ক্লাসে অবশ্য কেবল কবিরকেই বলেছিলাম। আমার ধারণা ছিল রাধেশ্যাম স্যার নিজেই হয়তো এটা সবাইকে জানিয়ে দিবেন। কিন্তু তিনি বোধ হয় ব্যাপারটা আর মনে রাখেননি। পরে অবশ্য আমি নিজেই প্রমীলার জন্য কিছুটা ছাড় দেয়ার কথা ভাবি; সহশিক্ষার জীবনে অন্তত একটা সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির সুখটুকু ওর মনের মধ্যে গেঁথে থাক।
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:১৮