মালবিকার সাথে আমার বয়সের বিস্তর ব্যবধান। বোধ করি অর্ধেকের কম হইবে। বয়সণ্ধি কালের পর কিছু বছর অতিক্রম করিয়াছে। তাকে আর ষোড়শী বলা যাইবেনা। কেহ কেহতো আমার বয়স নিয়াও সংশয় প্রকাশ করেন। তাদের এই সংশয় অমুলক নহে। তার দেহের গঠনও বয়সের সাথে সামঞ্জস্য পুর্ন নহে। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছাত্রীটিকে এখনো স্কুল পড়ুয়া বলেই অনুমিত হয়। ছোট্ট গোলাকার সুন্দর মুখশ্রীর অধিকারীনি কোমলতা এখনো পুর্ব ষোড়শীর ন্যায়। ত্বকে উজ্জ্বল লাবন্য। ছিপছিপে দোহারা নিরেট পেটানো শরীরের গঠন। মেঠো পথ ধরিয়া বন হরিনী ন্যায় ভীরু চঞ্চল পায়ে পথ অতিক্রম করিলে দিবাকরের আলোতে তাহাকে একখানা উড়ন্ত প্রজাপতি বলিয়া মনে হয়। কখনো মৃদু কিংবা কখনো উচ্চস্বরে হাসে। গালে টোল পড়েনা বটে তবে এ হাসি যে কারো কর্ন কুহরে প্রচন্ড আঘাত করিতে পারে যাহা কিনা কর্ন অতিক্রম করিয়া হৃদয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষ গুলিকে আলোড়িত করিয়া তোলে। আমি তার এরুপ কর্ম কান্ডে মুগ্ধ হই। হাসির তোড়ে আমার সকাল সন্ধ্যা গঙ্গায় বিসর্জিত হয়। তার চপলা চঞ্চলা বাহিত দিনের চিত্র তার অনুপস্তিতিতেও আমাকে আলোড়িত করিয়া তোলে। তবে এ আমি নিশ্চিত জানি তার কোন প্রদর্শন যেমন আমার জন্যে নহে তেমনি নিরেট হাসিও তাও সে আমার জন্য হাসেনা। তাই কখনো কখনো মনে হয় যাহা আমার জন্যে নহে তাহা দেখিয়া উপভোগ করাটা অপরাধ নয় কি? তাই মাঝে মধ্যে নিজেকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু কারনে অকারনে তাহাকে দেখিতে হয় বলিয়া চাইলেও নিজেকে লুকাইয়া রাখা সম্ভব পর হইতেছেনা বিধায় নিরন্তর অপরাধ করিয়া চলিতেছি।
প্রেমের রসায়ন অতিশয় জটিল। প্রেমের কোন নিয়ম নাই। কোন ধরা বাধা কোন সংজ্ঞাও নাই। তবুও মানুষ অনায়াসে প্রেমের আভাস গুলিকে উপলব্ধি করিতে পারে। কেহ কেহ বলেন মানব প্রেমের চাইতে পশু প্রেম অনেক গুনে উত্তম। মানুষ প্রতারনা করে। যদি কেহ বুঝিতে পারে উক্ত ব্যক্তি তাকে ভালবাসে আর মনে কুটকৌশল থাকে তাহলে সে তার মাথায় চড়িয়া বসে। পরগাছা মতো আবদ্ধ করিয়া মগজের তেল আহরন করিতে থাকে। যতক্ষন অব্দি তার বিনাশ না ঘটিবে ততক্ষন অব্দি তাকে ছাড়িবেনা। তাহার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আকন্ঠ পান করিয়াও তাহার জন্য মরা কান্না কাদিয়া তবেই শোধ তুলিবে। বিনা শর্তে ভালবাসা পাওয়ার কৃতজ্ঞতাবোধ সহসা জন্মায়না। আর নারী প্রেমতো আরো ভয়াবহ। তার জীবনে প্রেম প্রাপ্তির পুর্বে সে যতটা মুক্ত বিহঙ্গ হইয়া থাকে ঠিক প্রেম প্রাপ্তির সাথে সাথে সে ডিমে তা দেয়া পাখির ন্যয় একটা কেন্দ্র অবস্থান করিয়া চারিপাশে ভালবাসার বৃত্তাকার বলয় তৈরী করিয়া ফেলে। ফলে বলয়ের সীমানায় যেই অতিক্রম করুক না কেন সে তাহাকে কেন্দ্রের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতে থাকে। নারী স্বভাবতই আত্নকেন্দ্রিক, কেন্দ্রস্থিতু এবং আত্নসংকোচিত। কখনো কখনো তাহা ভালবাসা ব্যপ্তিকে সে এমনভাবে প্রকাশ করিতে আরম্ভ করে উক্ত পুরুষ নিজের স্বাধীনতা হারাইয়া ফেলে। মুলত সে তার সঙ্গীর তাবৎ স্বাধীনতা হরন করিয়া কেন্দ্রস্থিত করিয়া ফেলে। এমনও হয় সে যখন কাউকে ভালবাসে জীবন দিয়াই ভালবাসে অপর দিকে যাহাকে প্রত্যাখান করে তাহাতে নিজ জীবন বাজি ধরিয়া ফেলে।
বেশ কয়েকদিন যাবতই চরম অস্থিরতায় সময় অতিক্রান্ত করিতেছিলাম। পরিবারকে ঠিক মত সময় দিতেছিনা। আসলে নিজেকে নিজের মধ্যে কোথায় খেই হারাইয়া ফেলিতেছিলাম। অর্ধাঙ্গিনী তাহার খানিক আচ করিলো বটে কিছু বলিবার সুযোগ কিংবা সাহস পাইলোনা। মেয়েদের খুব একটা বুঝাইয়া লাভ হয়না। তাহারা যুক্তি মানিতে নারাজ। তাহাদের কথার শেষে হারজিত একটা মুখ্য বিষয় হইয়া দাড়ায়। তাহাতে হাসিয়া কিংবা কাদিয়া নয়তো অন্য কোন আবেগ প্রকাশ করিয়া নিজেকে জয়ী করিবেই।
কারনে অকারনে সেই স্বপ্ন কন্যার মুখশ্রী আর তার ভুবন ভুলানো হাসি বার বার মনের মধ্যে উকি মারিতেছিল। স্মরনে পড়িতেছে যেদিন হইতে আমাকে স্মরন করাইয়া দেওয়া হইল আমি তার প্রতি অনুরক্ত হইয়াছি সেই দিন হতেই তাকে ভুলিবার নাম করিয়া বার বার স্মরন করিতেছি। ইহাতে আমার কোন অংশগ্রহন নাই। তার কাছে আমার প্রাপ্তির কোন বিষয়ও জড়িত নাই। তাই আমি স্বাভাবিক ভাবেই পুলকিত আমোদিত দর্শকের ন্যায় দিনযাপন করিতেছিলাম। কিন্তু এই কথা কোন নারীই মানিতে চাহিবে না। তারা ভুবন দখল করিতে চায়, আবার কাউকে কোন ভাগ ছাড়িতে রাজি নহে এমনকি তার স্বীয় পুরুষটির অস্থিত্বে ও চিন্তায় শুধু তার হইয়া থাকুক মনে প্রানে ইহাও চায়। এই জন্য সে যে কোন কান্ড করিয়া বসিতে পারে। সে মুক্ত হইতে চায় কিন্তু ভালবাসার নাম করিয়া পুরুষটিকে আরো বন্দি করিয়া তোলে। নিজে সহাস্যে পথ অতিক্রম করিতে ভালোবাসে কিন্তু সে চায় পুরুষটি কেবল মাত্র তাহার জন্যই হাসিবে। এইরকম ভালবাসা একচ্ছত্র অভিযান নিজেকে হিংসুটে করিয়া তোলে। সে নিজ ব্যতিত পৃথিবীর তাবৎ নারীকে হিংসা করে। এমনকি চারিপাশে কাউকে না পাইলে নিজের অতীতকে হিংসা করিতে আরম্ভ করে। যদি তার একখানা পুরনো ছবি দেখাইয়া বলেন,“তোমার এই ছবিটা বেশ সুন্দর”। তখনি এর প্রতিক্রিয়ায় যাহা পাইবেন তাহাই সকল প্রশ্নের সমাধান মিলিবে,” আমি কি তবে এখন অসুন্দর হয়ে গেছি?“
রাতে ঘুম আসিতেছিলনা। মধ্য রাত পার করিয়া শেষের দিকে গড়াইল। তবুও ঘুম আমার নিরাশ্রিত আখিতে আশ্রয় গ্রহন করিলনা। শেষ প্রহরের আগাম বার্তা চলিতেছে। নানান চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাইতে খাইতে দিশেহারা হইয়া পড়িলাম। হঠাৎ কি মনে হইলো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়া বসিলাম। সকাল হইল বটে ততক্ষনে তাহার চতুস্কোন উপন্যাসটি শেষ করিলাম। তারপর একসময় মনের অজান্তে ঘুমাইয়া পড়িলাম। হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গিয়া দেখিলাম কর্মস্থলে আসিবার সময় অতিক্রান্ত হইতেছে। শেষ অব্দি মানিক বাবুর দুটি লাইন আমার মনে ধরিল। “যুক্তির দাম মেয়েদের কাছে নাই, একটু খানি আবেগের বন্যায় বিশ্বের সমস্থ যুক্তি তর্ক উচিত অনুচিত ভালো মন্দ ভাসিয়া যাইতে পারে।“ মনে পড়িল মালতী, কালী, সরসী আর রিনির কথা। রাজকুমার কোন কালেই কাউকে ভালবাসার কথা বলে নাই, এমন কোন আচরনও করেনাই। তবুও তাহার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে তাহারা প্রত্যেকেই ধরিয়া নিয়াছিল রাজকুমার তাহাদের প্রতি অনুরক্ত। তাহারই জের ধরিয়া রিনি একেবারে অসুস্থ হইয়া পড়িল যা কিনা কেবল মাত্র রাজকুমারের উপস্থিতিতে কিছুটা প্রশমিত হয়। অন্যদিকে রাজকুমারের জন্য সরসী অপেক্ষায় বসিয়া রহিল। সরসী প্রেম প্রতিদ্বন্ধীর জন্য রাজকুমার কে কোন যুক্তিতে ভাগ করিল তাহা আমার বোধগম্য হয় নাই। বোধ করি তাহারা নিজের সুখের জন্যে সকল যুক্তি, সকল অবস্থা সহজেই মানিয়া লয় তাহাতে অন্য কাহারো যুক্তি চলেনা? কিন্তু অপর দিকে নিজের ভাগের সুতোতে টান না পড়িলে সঙ্গিনীর ভাললাগায় তারা কর্নপাত করেনা। সারাজীবনতো নয়ই তাহা এক মুহুর্তের জন্য জন্যে হলেও নহে। এমনকি নিস্কলুষ নিরপাধ হইলেও নহে। তারা এই ক্ষেত্রে হিংসার বেড়াজালে চিরকালের মত আবদ্ধ করিয়া রাখে। অধিকারের নাম করিয়া মনের সুখ শান্তিকে চিরকালের মত কাড়িয়া লইতেও দ্বীধাবোধ করেনা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৩