মনটা আজ খুব ভালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকে কর্মরত রায়হানের। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরও ক্লান্তির পরিবর্তে তার মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। নিজস্ব কম্পিউটারটা বন্ধ করে শীষ দিতে দিতে ব্যাংক থেকে বের হয়ে এলো রায়হান সন্ধ্যার একটু পর পর। আনন্দের আতিশয্যে স্থান ভুলে তার মুখ দিয়ে শীষ বের হয়ে গেছে। গতকাল যে পাত্রীটি সে দেখত গিয়েছিল মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে আজ সে মেয়ে গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছে।
সন্ধ্যার এইসময়টাতে অফিস ফেরত যাত্রীর ভিড়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরটা গমগম করে - বাসে উঠা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। রায়হান মোহাম্মাদপুরগামী এ.টি.সি.এল বাসের কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়ে লম্বা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। একসময় এই রুটে সব বাসই কাউন্টারভিত্তিক চলাচল করত কিন্তু এখন একমাত্র এই বাসটিতে টিকিটের ব্যবস্থা আছে- তাও আবার ঢিলেঢালা।
বেশী সময় দাঁড়িয়ে থাকলে রায়হানের কোমরে ব্যথা করে,বিয়ের পরেও যদি এই ব্যথা থাকে তাহলে উদ্ভূত সমস্যার কথা চিন্তা করতে করতে মোবাইলে ম্যাসেজ এলো মেয়েটির যাকে গতকাল মামা আর খালাতো ভাইসহ দেখতে গিয়েছিল। খুব সুন্দরী না হলেও বেশ ঢলঢলে চেহারা মেয়েটির, বিশেষ করে চোখ দুটো -যেন এখনি ঝর্ণাধারা শুরু হয়ে যাবে। এটি ছিল রায়হানের এগারতম মেয়ে দেখা। অবশ্য সবক্ষেত্রে যে সে মেয়ে পছন্দ করেনি তা নয়, অনেকক্ষেত্রে মেয়েরাই তাকে পছন্দ করেনি। এই মেয়েটিকে দেখতে যেতে প্রথমে সে রাজী ছিলনা, অনেক অনুরোধের পর তার মতি হয়েছিল। এখন বুঝতে পারছে, না গেলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যেত।
বাস আসামাত্র লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল, ব্যস্ত হয়ে গেল সবাই উঠার জন্য। রায়হানও বাসে উঠে একটা খালি আসন পেয়ে বসে গেল, ঠিক তার সামনের আসনটিতে বসল দুজন যুবতী আর একজন বৃদ্ধ মহিলা।
রায়হান সীট পেয়ে স্বস্তির সাথে সাথে কিছুটা অস্বস্তিও অনুভব করল, তার লম্বা পা দুটোকে বাঁকিয়ে রাখতে হল। বেশী ব্যবসায়ের আশায় বাস মালিকরা সীট বসানোর ক্ষেত্রে কোন নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। মানুষরূপী যাত্রীরা তাদের কাছে যেন একেকটা গরু, একে সীটগুলো সংকীর্ণ তার উপর গাদাগাদি করে যাত্রী উঠানো হয়।
ভ্যাপসা গরম,ঘামের গন্ধ আর মানুষের বকবকানিতে বাসের ভিতরটা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠল,কিন্তু রায়হানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই - সে ব্যস্ত মেয়েটির সাথে মোবাইলে ম্যাসেজ আদান প্রদানে। এই আদানপ্রদানের মাধ্যমে দুজনের ভাবাবেগ যখন চরমে ঠিক তখনই বাসটা করল ব্রেক আর তাতে রায়হানের বাঁকা হয়ে থাকা পা গিয়ে লাগল সামনে বসা যুবতীর শরীরে।
মানুষের বাহিরের রূপটা নকল, আসল রূপ লুকিয়ে থাকে হৃদয়ের গভীরে, যখন রাগ উঠে তখন ব্যবহারের মাধ্যমে তা মুখায়বে এসে ধরা দেয়। সামনের যুবতীর কদর্য আক্রমণ সেটাই প্রমাণ করল। রায়হান অবাক হয়ে দেখল সুন্দরী যুবতীটি তার কোন কথা না শুনে কিভাবে হিংস্র হয়ে উঠল, সঙ্গে যোগ দিল সাথের আরও কয়েকজন। লজ্জা, অপমান আর ঘৃণায় সে মাথা নীচু করে রইল।
"আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে? "- কোলের উপর রাখা মোবাইলের পর্দায় এর মধ্যে আসা অনেকগুলো ম্যাসেজের মধ্যে এই লাইনের উপর চোখ পড়ল ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল রায়হানের। মেয়েদের উপর প্রচণ্ড ঘৃণার উৎপত্তিতে মুহূর্তেই বিয়ে না করার চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে এর উত্তরে "না" লিখে দিল গতকাল দেখে আসা মেয়েটিকে।
বাসটি ছিল পুরাতন, অধিকাংশ জায়গায় স্টিলের ধারালো কোনা বের হয়েছিল। মানসিক কষ্টকে শারিরীক যাতনা দিয়ে লাঘবের জন্য রায়হান স্টিলের বেরিয়ে থাকা অংশে আঙুল বসিয়ে দিল এক টান - সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল। হৃদয়ের সব কষ্ট রক্তের রূপ নিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়তে লাগল চলন্ত বাসের জানালার বাহিরে মেলে ধরা হাতের আঙুল দিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:১৮