"এই সংসারে থেকে জীবনটা একদম কয়লা হয়ে গেলো"
-"তাহলে বসে আছো কেন? যাও যাও, চলে যাও বাপের বাড়ী"
"হ্যা হ্যা তাই যাবো"
-কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর ঝনঝন শব্দে জিনিষপত্র ভাংচুর হতে থাকল।
সাত সকালে দোতলায় বাবা-মায়ের ঝগড়ার এই তাণ্ডবে নীচতলায় আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। স্বপ্নে সবেমাত্র সামনের বিল্ডিং এর দোতালার সুন্দরী মেয়েটা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মেজাজ একেবারে তিতা হয়ে গেলো। আর শুয়ে থাকতে পারলামনা। বাধ্য হয়ে উপরে যেতে হল রেফারীর ভূমিকা পালন করতে। যেয়ে দেখি রুমের মধ্যে একটু আগে তুফান বয়ে গেছে, সবকিছু লণ্ডভণ্ড। বাবা বসে আছেন সোফায় মুখ কালো করে, মা বিছানায়। আমাকে দেখামাত্র মা বললেন "দেখ খোকা, তোর বাপের নাক ডাকায় সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি, জঘন্য" -"আমি নাক ডাকি? কেউ এইপর্যন্ত বলতে শুনিনি, শুধু তোর মা---" -বাবা উত্তরে বললেন। আবার ঝড়ের আলামত দেখা দিলো, কোনমতে বাবা-মাকে শান্ত করে নীচে নেমে এলাম।
জ্ঞান হবার পর থেকে দেখে আসছি বাবা-মায়ের ঝগড়া।সামান্য বিষয় নিয়েও ঝগড়া বেঁধে যায়। কিভাবে যে তাঁরা এতগুলো বছর এভাবে পার করে আসছেন ভাবতে অবাক লাগে। বাবা অবসর নিয়েছেন প্রায় পনর বছর হয়ে গেল। সবসময় বাসায় থাকেন, আর দুজনে মিলে ঝগড়া করেন।
বাবা ছিলেন ডিবির অফিসার, স্বভাবের মধ্যে সবসময় একটা 'জেরা জেরা ' ভাব আছে। চোর-ডাকাতের পিছনে থাকতে থাকতে এই ভাবটা প্রকট হয়ে উঠেছে। মার প্রতিটা কাজে খুঁত ধরেন যা ঝগড়ার একটা অন্যতম কারণ। মাও জমিদার বংশের -চলাফেরায় জমিদারী ভাব আছে। পণ্ডিত নানার সহায়-সম্পত্তির কমতি ছিলনা। দীর্ঘদিন এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন যার প্রভাব মায়ের উপর পড়েছে।
পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে আকর্ষণ সেটা একটা সুতার আকর্ষণ নয়-সেটা দুটো সুতোর আকর্ষণ। দুটো সুতো একসঙ্গে পাকিয়ে আকর্ষণটা সম্পূর্ণ হয়। একটা আকর্ষণ মনের, আরেকটা দেহের। দুটো সুতা একসঙ্গে পাকিয়ে যে টান দেয় সেটাই সত্যিকারের টান। আমার বাবা-মায়ের মধ্যে সম্ভবত কোন সুতোই ছিলনা, তাই টানও ছিলনা। যার পরিণতিতে এই ঝগড়া।
এত ঝগড়ার পরও দুজনের কেউ একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারেননা। একবার মা দুদিনের জন্য খালার বাড়ী বেড়াতে গেছেন। রাত পার হতে না হতেই বাবা সকালে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মাকে নিয়ে আসার জন্য। মা বাসায় আসা মাত্রই ঝগড়া শুরু হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে। তখন আমার মনে হচ্ছিলো বেঁচে থাকার জন্য যেমন আমাদের আহারের প্রয়োজন তেমন মা-বাবার জীবনধারনের জন্য ঝগড়ার প্রয়োজন।
পাশের বিল্ডিং এর আকরাম ভাই একজন ব্যাংকার। দুদিন আগে বিয়ে করেছেন। বিয়েতে সারাদিন হৈচৈ হল। আমরা সবাই মিলে অনুষ্ঠানের তদারকি করলাম, বাসরঘর সাজালাম। রাতে আকরাম ভাই বাসরঘরে রোমান্টিক মুডে যখনই নতুন বৌ -এর কাছে গেলেন তখনই শুরু হয়ে গেলো মা-বাবার ঝগড়া। বাসরঘরটা ছিল মা-বাবার রুমের একেবারে পাশে। নতুন দম্পতির রোমান্টিক মুহূর্তগুলো তখন পরিণত হল মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো -এই আলো,এই অন্ধকার।
কর্মব্যস্ত দিন রবিবারে অফিসে কাজে ডুবেছিলাম, এর মধ্যে মোবাইলে রিং হল, ব্যস্ততার কারণে না দেখেই মোবাইল কানে দিলাম। মার কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনতে পেলাম-" খোকা তোর বাবা হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে "। প্রথমে বুঝতে একটু দেরী হল, কারণ মা প্রায়শই বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, একই ধারার অভিযোগ মনে করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, পরে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে সাথে সাথে এম্বুলেন্সে ফোন করলাম।
চারদিন পর বাবা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন। ডাক্তার বলে দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে, উত্তেজিত হওয়া চলবেনা। দোতলায় উঠতে সমস্যা হবে তাই বাবাকে নীচ তলায় রাখা হল। মা আর আমি যথাসাধ্য বাবার সেবা করতে লাগলাম। দুজনের আন্তরিক সেবায় বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলেন।
সকালে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা আমার প্রিয় কাজগুলোর একটি। সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে ঘুম থেকে উঠা সবচেয়ে বিরক্তিকর। রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়-ঘুম বনাম আমি। অবশ্য সেই যুদ্ধে সবসময় আমিই জয়লাভ করি, না হলে এতোদিনে চাকুরীতে লালবাতি জ্বলত। চাকুরী রক্ষার্থে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা-বাবার সাথে দেখা করে যাওয়া আমার ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। সেই অভ্যাসের বশে বাবার সাথে দেখা করতে যেতেই দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালাম-কি অভূতপূর্ব দৃশ্য, যে দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিটি সন্তানের বুক হাহাকার করে,যে দৃশ্য অন্তরকে করে বড়, মনকে করে মহান।
বাবা বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন, মা সামনে বসে সুপ খাইয়ে দিচ্ছেন চামচ দিয়ে, বাবার দুচোখ বেয়ে পানি পরছে, মা সেই পানি মুছে দিচ্ছেন শাড়ির আঁচল দিয়ে। বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি,বাবার কান্না আমাকেও সংক্রামিত করল। আর থাকতে পারলামনা। অফিসে না যেয়ে নিজের রুমে ফিরে এলাম।
ধিক্কার দিতে লাগলাম নিজেকে মা-বাবা সম্পর্কে ভুল ধারনার জন্য। দুজনের ঝগড়ার আড়ালে যে এত গভীর ভালবাসা লুকায়িত ছিল তা বোঝার অক্ষমতাকে ক্ষমা করতে পারছিলামনা কিছুতেই নিজেকে। আসলে দুজনের মধ্যে যে ভালবাসা, যে আকর্ষণ ছিল তা দুই সুতার ছিলনা, ছিল তিন সুতার আকর্ষণ। তৃতীয় সুতাটি হল ঝগড়ার।