লাল রংয়ের টয়োটা করোলা গাড়ীটা যখন গাছপালা বেষ্টিত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করলো তখন তাতে বসা শাম্মীর কাছে মনে হলো সে যেনো এক জ্যোৎস্না রাজ্যে চলে এসেছে। কোলাহলময় ঢাকার এজায়গাটায় জ্যোৎস্না রাতে এর মায়াবীরূপ ভালোভাবে ফুটে উঠে। শাম্মী চিন্তা করছিলো বসুন্ধরা সিটি থেকে সদ্য কেনা স্মার্ট ফোনটা উপহার হিসাবে হাতে পেলে তার মনের মানুষের কি অবস্থা হবে, সে কি তাকে জড়িয়ে ধরবে? নাকি ফোনটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এসব এলোমেলো চিন্তার মধ্যে হঠাৎ গাড়ীটা বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই দুপাশ থেকে দুজন ছেলে এসে ড্রাইভারকে চেপে ধরলো, ঝিলিক দিয়ে উঠলো তাদের হাতে থাকা চাকু। শাম্মী বাহিরে তাকিয়ে দেখলো ভিসির বাসভবনের সামনে গাড়ীটা থেমেছে। চাঁদের আলোয় পিস্তল ধরা একটা হাত পরিচিত মনে হলো, তার মুখের দিকে চোখ যেতেই সে এত অবাক আর বিস্মিত হলো যেনো এমুহূর্তে জ্ঞান হারাবে।
গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে উঠে আসা টগবগে জোয়ান ছেলে হাসান। চোখে তার রঙিন স্বপ্ন, বুকভরা আশা, ভার্সিটিতে পড়ালেখা করে একজন সত্যিকারের মানুষ হবে সে। আশা বিফল হয়নি তার। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয় কঠোর পরিশ্রম করে।
গ্রামীণ পরিবেশ থেকে হঠাৎ বিশাল পরিসরে এসে সবার সাথে খাপ খাওয়াতে বেশ কিছুদিন সময় লাগলো তার, কিন্তু সে ছিলো মেধাবী আর ব্যবহার ছিলো অমায়িক। তাই অল্পকিছুদিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। প্রথম বছর ভালো মেধার পরিচয় দিয়ে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলো।
কৃতিত্বের সহিত পাশ করায় কিছু সিনিয়র ছাত্রনেতার নজরে পড়লো সে, বিভিন্ন মিছিল মিটিং-এ ডাক পড়লো তার, সবজায়গায় সমাদর বেড়ে গেলো, নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবা শুরু করলো সে। এভাবেই শুরু হলো তার রাজনীতিতে পথচলা। ভার্সিটির সূর্যসেন হলের একটি পুরো কক্ষ দখল করে নিলো সে, ক্যান্টিনে খাওয়া ফ্রি হলো তার, চেলা-পেলা যুক্ত হলো তার সঙ্গে, সবমিলিয়ে একটা নেতাভাব চলে আসলো তার মধ্যে।
ছয়ফুট উচ্চতার সুঠাম শরীরের অধিকারী স্মার্ট হাসানের কিছু বিশেষ গুনের কারণে ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়র সুন্দরী মেয়ের নজর কাড়লো সে। একসময় তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিলো। মেয়েটা চাইতো হাসান রাজনীতি ছেড়ে পড়াশুনায় মনযোগ দিক,যাতে ভালোভাবে পাস করে সন্মানজনক একটা চাকুরী পায়। কিন্তু হাসান ধীরে ধীরে রাজনীতির কালো জগতে প্রবেশ করতে থাকলো। এরমাঝে সে ড্রাগস নেওয়াও শুরু করলো, ড্রাগসের টাকা জোগাতে চাঁদাবাজি আর ছিনাতাইয়ের মতো কাজ করাও আরম্ভ করলো।
সেদিন সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো, এমন দিনে তার নেশাটা পেয়ে বসে বেশী। ক্যান্টিনে নাস্তা সেরে নিলো বিনে পয়সায়, কিন্তু নেশার জন্য টাকার দরকার, পকেট একেবারে শূন্য। তাই সে সঙ্গীদের সাথে প্ল্যান করলো রাতে কিছু একটা করার। বিকালের দিকে আকাশ একেবারে পরিস্কার হয়ে গেলো। সন্ধ্যার দিকে চারিদিক আলোকিত করে বিশাল চাঁদ উঠলো। সে তার সঙ্গীদের নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় ওত পেতে থাকলো। জ্যোৎস্নার আলো বার বার তার মনকে গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। মাঠের শেষে তাল গাছের মাথায় যখন চাঁদ উঠতো তখন সে আর ঘরে থাকতে পারতনা, দৌড়ে স্কুলের বারান্দায় যেয়ে সেই চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকত। হঠাৎ গাড়ীর ব্রেক করার আওয়াজে তার ভাবনায় ছেদ পড়লো, দেখলো তার সঙ্গীরা একটা লাল গাড়ী থামিয়ে ড্রাইভারকে চেপে ধরছে। আর দেরী না করে সে গাড়ীর পিছনে বসা টার্গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। পকেট থেকে পিস্তল বের করে গাড়ীতে বসা যাত্রীর দিকে তাক করা মাত্রই অবাক বিস্ময়ভরা দুটো চোখের দিকে নজর পড়লো তার।
সেরাতের পর অনেক চেষ্টা করেও সে আর শাম্মীর সাথে যোগাযোগ করতে পারলোনা। বিস্ময়ভরা চোখজোড়া তাকে প্রচন্ডভাবে ঝাঁকুনি দিল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনেক সাধনা করে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো কিন্তু শাম্মীকে হারিয়ে ফেললো।
ব্যবসায়িক কাজে হাসানকে প্রায় ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম যেতে হয়। ভ্রমণে সে বাসের চেয়ে ট্রেনকে প্রাধান্য দেয় বেশী। সেদিনও সে ট্রেনের টিকেট কেটে নির্ধারিত আসনে যেয়ে বসে। নিজের জীবনের একাকীত্বের কষ্টের ভাবনার মাঝে সামনের সীটের দিকে দৃষ্টি যেতেই তার চোখ আটকে যায় তিন বছর আগে এক রাতে দেখা বিস্ময়ভরা একজোড়া পরিচিত চোখের উপর যে চোখজোড়াকে পাহারা দিচ্ছে পাশে বসা আরেকজোড়া অপরিচিত শীতল চাহনির চোখ।