এক
মতিন মিয়া দেখলো মাঝবয়সী শীর্ণ মহিলাটি এখনো মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটছে। এক হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে মুখ চেপে ধরে রেখেছে, আরেক হাতে একটা প্লাস্টিকের কোকের বোতল। কাঁদছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অপ্রয়োজনে কান্নাকাটি মতিন মিয়া পছন্দ করে না, সে বললো, টেকা কম দিবার চাইলে তো ভক্তি আইবো না। ভক্তি না আইলে কি কাম হইবো?
মহিলা বললো, আমরা গরীব মানুষ, আমরার বেশি টেকা নাই। কী করুম? অনেক দূর থাইকা আইছি, আপনে আমাগোরে উদ্ধার করেন।
মতিন মিয়া আশেপাশে তাকায়।
মহিলার সাথে দশ-বারো বছর বয়সী একটি বালক এসেছে। সে মহিলার শাড়ির একটি অংশ চেপে ধরে আছে। এই ছেলেটি কি রোগী? হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সে বললো, রুগি কে? কার লাইগা পানি লইবেন?
মহিলা ছেলেটিকে দেখিয়ে বললেন, আমার পোলা। ছুডো থাইকাই ডাইন পায়ে সমইস্যা। ঠিক মতোন হাঁটতে পারে না। বাজান এট্টু হাইটা দেহাও তো।
বালকটি উঠে দাঁড়ায়। হাঁটার কোনো লক্ষণ ওর মধ্যে নেই। মহিলাটি আবার বলে, বাজান হাঁটো না ক্যান? হাঁটো।
বালকটি এবার দশ বারো কদম হেঁটে দেখালো। ডান পা বাম পায়ের তুলনায় একটু ছোট। সঠিক সময়ে পোলিও-এর টিকা না দেওয়ার ফল। মতিন মিয়া বালক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। খানিকক্ষণ আগে মহিলার দেয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটা এখনো ওর হাতে ধরা। সে একবার টাকার দিকে তাকায়, তারপর মহিলার দিকে তাকায়। হতদরিদ্র এই মহিলা ছেলের চিকিৎসার জন্য এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু সকাল থেকে আজ ব্যবসা মন্দা। সূর্য মাথার উপর উঠার অপেক্ষা অথচ এই মহিলা ছাড়া আর কেউ আসেনি। কাজেই মতিন মিয়া দ্বিধান্বিত হয়। তবে এক বোতল পুকুরের পানির দাম পঞ্চাশ টাকা নেহাত মন্দও নয়।
গত শুক্রবারে কাসেম নগরে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান সাহেব মতিন মিয়াকে ডেকে পাঠান। চেয়ারম্যান বাড়ির বৈঠকখানায় পৌঁছালে তিনি মতিন মিয়াকে পুকুর পাড়ের জোড়া নারিকেল গাছ কাটার দায়িত্ব দেন। পাড়ের মাটি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গাছ দুটো প্রায় পানির কাছাকাছি চলে এসেছে। এ অবস্থায় হয় গাছ কেটে ফেলতে হবে নতুবা পুকুরের পাড় বাঁধাতে হবে। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ফলন হয় না এমন গাছ রাখার দরকার কী? কী বলো মতিন মিয়া?
মতিন মিয়া বলে, জ্বে চাচা। আপনে ঠিকই কইছেন। গাছ দুইটা আরো আগেই কাটন দরকার আছিল।
চেয়ারম্যান করিম সরকার মুচকি হাসেন। বলেন, তাইলে কাল সকালেই কাজ শুরু করে দাও।
- জ্বে চাচা।
- দেলোয়ার, মতিনের যা খরচাপাতি লাগে হিসাব কইরা দিও।
চেয়ারম্যান সাহেবের ডানহাত দেলোয়ার হোসেন মাথা নাড়ে। মতিন মিয়া বিদায় হয়।
পরদিন সকালে তিনজন কাঠুরে নিয়ে সে হাজির হয় পুকুর পাড়ে। গ্রামের মাঝবরাবর আড়াআড়িভাবে যে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে, তার থেকে সামান্য দূরে চেয়ারম্যান সাহেবের পুকুর। দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে জোড়া নারিকেল গাছ। মতিন মিয়া কাঠুরেদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রাস্তার পাশে প্রায় শতবর্শী আম গাছের মোটা শেকড়ে বসে বিড়ি জ্বালায়। কাঠুরেরা দড়ি দিয়ে নারিকেল গাছ দুটোকে বাঁধে যেন কাটার পর পুকুরে না পড়ে। এরপর ওদের একজন অপেক্ষাকৃত বড়ো গাছে একটা কোপ দেয়। দ্বিতীয়জন ঐ গাছে আরেকটা কোপ দেয়ার সাথে সাথেই ঘটে- অলৌকিক ঘটনা!
গাছ দুটো পুকুরের পাড় থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে প্রায় পনের ফুট ভেতরে চলে যায়। কাঠুরেরা ব্যাপারটা বুঝতে মিনিট খানেক সময় নেয়। এরপর তারা ভয়ে পেয়ে ছুটে আসে মতিন মিয়ার কাছে। একজন দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করে। মতিন মিয়াও দূর থেকে ঘটনাটা দেখে। সে বিড়ি টানা ভুলে যায়, ফলে বিড়ি পুড়ে ওর হাতের আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগে। ইতিমধ্যে যে কাঠুরে গাছে প্রথম কোপ দিয়েছিল সে পালিয়ে গেছে। মতিন মিয়া বলে, আল্লাহর কুদরত দেখছো মিয়ারা। আল্লাহ খোদার নাম নেও।
সে বাকী দুইজনকে নিয়ে আবার পুকুর পাড়ে যায়। দেখে, গাছ দুটো পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেছে। সেখানেও বহাল তবিয়তে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাথায় কোনোভাবেই এর ব্যাখ্যা আসে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামবাসী জমায়েত শুরু করে। নিজের চোখে না দেখলে এরকম ঘটনা কেউ বিশ্বাস করে না। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু পুকুরের মাঝখানে গাছ দুটোকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ অবিশ্বাসও করতে পারছে না। মতিন মিয়া গল্প বানাতে শুরু করে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ওর কথা তো সহজে কেউ ফেলতে পারে না। ওর মূল বক্তব্য হলো, গাছ দুটোতে নিশ্চয় আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে তা না হলে ওদের কাটতে গেলে ওরা জীবন বাঁচাতে পুকুরের মধ্যখানে হেঁটে যাবে কেন? এরকম গাছ একশো বছরে একবার জন্মায়।
খবর পেয়ে দেলোয়ার হোসেন আসে। গাছ দেখে মতিন মিয়াকে বলে, মতিন গাছ তো কাইটতে পারলি না, তোর টেকা তো গেল!
মতিন মিয়া ব্যাপারটা নিয়ে তখনো ভাবার সুযোগ পায়নি। দেলোয়ার হোসেনের কথা শুনে ওর মনে হলো, সত্যিই বুঝি আর টাকাটা পাওয়া হলো না। কিন্তু সে কিছু বলে না। মনে মনে ফন্দি আঁটে, চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে আর্জি জানানোর।
কিছুক্ষণ পর কাসেম নগর জুনিয়র হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক মোজাম্মেল হক আসেন। তিনিও যার পর নাই অবাক হন, কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। তিনি বিশ্বাস করেন এ ঘটনার নিশ্চয় একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।
অলৌকিক ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আশে পাশের দুই তিন গ্রাম থেকে মানুষজন গাছ দেখতে আসে। মতিন মিয়া ঘটনায় আরো রং চড়াতে থাকে। ওর কাছে এটা একটা সুযোগ মনে হয়। সে পাশের গ্রামের রহমত আলীর সাথে একটা গোপন চুক্তি করে।
পরদিন জানা যায়, পাশের গ্রামের রহমত আলী গতদিন পুকুরের পানি নিয়ে গিয়েছিল। ওর পরিবার কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিল, কোনোভাবেই জ্বর কমানো যাচ্ছিলো না। মাগরিবের নামাযের পর দরুদে শেফা তিন বার পাঠ করে এই পানি পান করেছিল। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে।
মুহূর্তের মধ্যে গাছের কিংবা পুকুরের পানির অলৌকিক ক্ষমতার কথা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজনের ভীড় বেড়ে যায়। তখন মতিন মিয়া পুকুরের পানি বন্টনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। দূর দুরান্ত থেকে যারা পানি সংগ্রহ করতে আসছে তাদের মধ্যে যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় তাই এই ব্যবস্থা। তবে গ্রামের বাইরের যারা আসছে তাদের কাছে থেকে সে কিছু দক্ষিণা আদায় করে। প্রথম কয়েকদিন প্রচুর লোকজন আসলেও গতকাল থেকে ব্যবসা কমে গিয়েছে। মতিন মিয়া মনে করে ওপরওয়ালা স্বয়ং তাকে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কারণ ওর ঘরে আট মাসের গর্ভবতী বউ রয়েছে অথচ কাজকর্মের স্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত নেই। এমন অবস্থায় রুজি রোজগারের মালিক তিনিই।
আম গাছের ছায়ায় বসে আরেকটা বিড়ি জ্বালায় মতিন মিয়া। এই মহিলা বোধহয় আর বেশি টাকা দিতে পারবে না। বিড়িটা শেষ করে পানি দেবে বলে মনস্থ করে ঠিক তখনি দেখতে পায় ওর বউ রমিলা এই পথেই আসছে। রমিলা আসার আগেই মহিলাকে বিদায় করা দরকার। বোতলের জন্য মহিলার দিকে হাত বাড়ায়। মতিন মিয়া যে হঠাৎ রাজি হয়ে যাবে মহিলা তা বুঝতে পারলো না। বললো, আর তো টেকা নাই।
- টেকা চাই নাই। বোতল দ্যান।
মতিন মিয়া প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে পুকুর ঘাটে গেল। তারপর কিছু একটা দোয়া পড়ে বোতলে পানি ভরলো। আম গাছতলায় ফিরে এসে দেখে রমিলা চলে এসেছে। সে বোতলটা মহিলার হাতে দিয়ে পানি খাবার নিয়ম বর্ণনা করতে থাকে। মহিলা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, দাদা, আমরা তো মুসলিম না, হিন্দু। মগরিবের নমায কেমন পড়ুম?
মতিন মিয়া আবারো দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। রমিলা খুব সাবধানে মুখ টিপে হাসে। মতিন মিয়া বললো, মুশকিলে পড়লাম। আপনাগো কায়দা কানুন তো আমি জানি না।
মহিলা বললো, কায়দা কানুন জানন লাগতো না। আপনে বড়ো উপকার করলেন। চলি গো দাদা।
মতিন মিয়া ওদের চলে যাওয়া দেখে। তারপর রমিলার দিকে নজর দেয়। বললো, তোরে না কইছি ঘর থাইকা বাইর হবি না।
- ঘরে নুন নাই। নুন লাগবো।
- হেইডা তো মুবাইলে কইলেও পারতি।
- হ। কয়দিন বাইর হই না ঘর থাইকা, আতাং পাতাং লাগে।
- আইচ্ছা এহন ঘরে যা, নুন লইয়া আসুম নে।
- হিন্দু বেটি কয় টেকা দিল?
মতিন মিয়া আমতা আমতা করে। বললো, টেকা দিব ক্যান? পানি লইতে আইছে, পানি দিছি।
রমিলা আবারো হাসলো। বললো, আমারে এক শিশি পানি দিবা?
- তুই পানি দিয়া কি করবি?
- মাগরিবের নমায পইড়া পানি খামু।
- তোর কী রোগ হইছে?
- পায়ে পানি আইসা পড়ছে। এই যে -
রমিলা পায়ের কাপড় সামান্য তুললো। মতিন মিয়া সেদিকে তাকায়। পায়ে সামান্য পানি এসেছে বোঝা যায়। হঠাৎ ওর মনে হয়, অনেক দিন হলো রমিলার দিকে সে তাকায় না, কাছাকাছি যায় না। এমনকি সে অন্য কোনো মেয়ের দিকেও তাকায় না। গতমাসে একবার গঞ্জে গিয়েছিল। সুযোগ থাকলেও সেদিন সে অন্য মেয়েদের দিকে তাকায়নি, কাছাকাছি যায়নি। মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেললো। বললো, এই পানিতে তোর কাম হইবো না।
- এই পানিতে কি কারো কাম হয়?
এই প্রশ্নের জন্য মতিন মিয়া মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কয়েক মুহূর্ত সময় নিল, তারপর বললো, কাম না হইলে কি হেরা আইতো পানি লইতে?
- তাইলে আমার কাম হইবো না ক্যান?
- তুই হুদাই কতা বাড়াস। যা ঘরে যা।
রমিলা হাসে। যাবার আগে বলে যায়, নুন আইনো, ভুইলো না।
মতিন মিয়া পকেট থেকে বিড়ি বের করলো কিন্তু জ্বালালো না। রমিলার প্রশ্ন ওকে চিন্তায় ফেলে দিল। পানিতে যদি কাজ না হয় তাহলে ওর রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। দু’একদিন পরে আর মানুষজন আসবে না। তখন অন্য ধান্ধা বের করতে হবে। সে বিড়ি জ্বালালো।
কাঁচা রাস্তার যে প্রান্তটা গঞ্জের দিক থেকে এসেছে সেদিক থেকে একটা ব্যাটারী চালিত ভ্যান আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো মতিন মিয়া। কাছাকাছি আসতে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া অপরিচিত এক ভদ্রলোককে দেখে। ভাবে, উনি কি গাছ দেখতে এসেছেন? ভ্যান থামার জন্য ইশারা দেয়। আগুন্তককে দেখে সালাম দিল, আসসালামু আলাইকুম।
আগুন্তক সালাম নেয়।
- ভাইজান কি গাছ দেখতে আসছেন?
আগুন্তক সম্ভবত গাছের ব্যাপারটা জানে না। ভুরু কুঁচকে বললো, গাছ?
- জোড়া নারিকেল গাছ।
- না তো।
- ও, তাইলে ভাইজান কই যাইবেন?
- চেয়ারম্যান করিম সাহেবের বাসায় যাব।
- চেয়ারম্যান চাচার বাড়িত যাইবেন? চলেন। আমিও ঐ পথেই যামু।
মতিন মিয়া ভ্যানে উঠে বসলো। ভ্যান চলতে শুরু করে। ভদ্রলোকের সাথে একটা কাপড়ের ব্যাগ আছে দেখে সে খানিকটা উৎসাহ দেখায়, ভাইজান কি চেয়ারম্যান চাচার আত্মীয়?
- না, আত্মীয় না। একটা কাজে এসেছি।
- কয়দিন থাকবেন?
- দেখি কদিন থাকা যায়। আপনি গাছ নিয়ে কী বলছিলেন?
মতিন মিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। উৎসাহের সাথে সে অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দিতে শুরু করে। পুকুরের পানির অদ্ভুত ক্ষমতার কথা জানাতেও ভোলে না- এই পানিতে এমনসব রোগের চিকিৎসা হয় যা কোনো প্যাথীতে হয় না। ভ্যান চালক ওর অতিরঞ্জিত কথায় বিরক্ত হলেও আগুন্তক খুব মনোযোগের সাথে শুনতে থাকে।
(চলবে)
ছবি: গুগলমামা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৮