- ময়ী, ময়ী! আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ।
দিদার ডাকতে ডাকতে মৃনের রুমে ঢুকলো। মৃন তখনো বিছানা ছাড়েনি। সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ঘুমাবে কী করে? রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা ভর করেছিল ওর ওপর। গতকাল নভোর খোঁজে গিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরেছে। এভাবে একটা মানুষ উধাও হয়ে যেতে পারে তা বিশ্বাস করা যায় না। ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্রের মধ্যে শুধু নভো আর নভো! অথচ মানুষটা নেই। এমন তো হতে পারতো, মৃন গিয়ে দেখতে পারতো মানুষটা ঘুমাচ্ছে! ইশ, শুধু একটিবার যদি দেখা হতো, হোক সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য! যদি একটি বার কথা বলা যেত! কিন্তু হলো না। নতুন বাসায় নভোর এক সিনিয়র ভাইর সাথে দেখা হলো- পার্থদা। উনি অভয় দিয়ে বললেন, নভো ভালো আছে। আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না।
চিন্তা করবেন না বললেই কি চিন্তা না করে থাকা যায়! ছবিগুলো পাবার পর থেকেই সব সমস্যার শুরু। কেন যে নভোকে বলতে গেল ছবির কথা সেটা নিয়ে মনোঃপীড়ায় পুড়ছে মৃন। ও আবার উল্টোপাল্টা কিছু করে বসেনি তো? কিন্তু যাই হোক, হুট করে হারিয়ে যাবার মানে কী! এবার দেখা হলে প্রথম কাজ হলো, ওকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দেয়া। আচ্ছা, নভোর সাথে মাধবীর দেখা হয়নি তো? মাধবী সেদিন রাকিব স্যার সম্পর্কে যা বলেছিল তা তো খুবই উদ্দ্যোগজনক। নভো যদি মাধবীর কথা শুনে কিছু একটা করে বসে তাহলে তো উপায় থাকবে না। তাছাড়া, মাধবী তো রাকিব স্যার সম্পর্কে ওকেও সাবধান করতে চেয়েছিল। স্যারের সাথে মৃণের কয়েকবার কথা হলেও তেমন একটা নেতিবাচক মনে হয়নি। তাহলে কি মাধবীর কথা ঠিক নয়? কিন্তু তাতেই বা মাধবীর কী লাভ?
- ময়ী, এবার উঠে পড়। ক্লাশ নেই আজ?
মটকা মেড়ে বিছানায় পড়ে রইলো মৃন। বললো, দিদা জ্বালিও না তো। ক্লাশে যাবো না।
- কেনো রে? শরীর খারাপ করেছে?
- না না, শরীর টরীর খারাপ না। এমনি।
- সেকী রে, তোর চোখে কি হলো? এমন লাল কেনো? ঘুমাসনি রাতে? কার কথা ভাবছিলি? কাকে মনে ধরেছে?
- উফ দিদা! কিচ্ছু হয়নি। মনে হয় মাইগ্রেনের ব্যথাটা-
- মাইগ্রেনের ব্যথা তো অনেকদিন ছিল না! এখনো ব্যথা আছে?
- না না, এখন ভালো আছি। দিদা, বাবা কি বেরিয়ে গেছে?
- হ্যাঁ, সে তো সাত সকালেই বের হলো। তুই কি কিছু খাবি টাবি না নাকি?
- উঠছি। তুমি যাও তো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিদা চলে গেল। মৃন আরো খানিকক্ষণ মটকা মেড়ে পড়ে রইলো। নভোর কথা ভাবতে গিয়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!
"টক টক" করে দরজায় শব্দ হলো।
মৃন এ শব্দের সাথে পরিচিত। গৃহপরিচারিকা জয়নব নিশ্চয় বেড-টি নিয়ে এসেছে। মৃন বললো, আয় ভেতরে আয়।
জয়নব একটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো। বেড সাইড টেবিলে নামিয়ে রাখলো এক ট্রেটা। এক কাপ ধূমায়িত চা আর এক গ্লাস পানি। জয়নব নিঃশব্দে বেরিয়ে যেতেই মৃন উঠে পড়লো। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ গরম চা নেয়া ওর অনেক দিনের অভ্যাস। আর এ সুযোগটাই মা কাজে লাগায়। যখনি মৃন বেশী সময় বিছানায় পড়ে থাকে ঠিক তখনি ধূমায়িত গরম এক কাপ চা পাঠিয়ে দেয়া ওর ঘরে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে বসলো। রাস্তার দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলো সে। ঐ তো, নীল জিন্স আর সাদা টি-শার্ট পড়ে হেঁটে আসছে নভো। কাপ থেকে গরম চা ছলকে পড়লো জামায় কিন্তু সেদিকে খেয়ালই করলো না মৃন। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো সামনে। নভো বলে চিৎকার দিতে যাবে ঠিক তখনি বুঝতে পারলো- এটা নভো নয়, অন্যকেউ। ঠিক একদম নভোর মতোই পেটানো শরীর, একই রকম হাঁটার ভঙ্গি! মন খারাপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। এরপর যতবারই কাপে চুমুক দিল পানসে মনে হলো সবকিছু।
হঠাৎ মৃনের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। অপরিচিত নম্বর।
***
"ছবিগুলো তো স্টুডিও থেকে ওয়াশ করা হয়নি, প্রিন্টারে প্রিন্ট করা", বললেন জাকারিয়া ভাই।
সেদিন ছবিগুলো পাবার পর প্রচন্ড ক্রোধে নভোর কপালের দুপাশের শিরা দপদপ করতে থাকে। কারো মানসিকতা এতো নীচু হতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারে না। এক জোড়া নারী ও পুরুষের ব্যক্তিগত ছবিকে এডিট করে মৃনের মুখমন্ডল জুড়ে দিয়েছে। একই সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। কে এই কাজ করছে? কেন করছে? মৃন কি তাকে চেনে? তার সাথে মৃনের সম্পর্ক কী?
দ্রুতই নিজেকে সামলিয়ে নিল। তাড়াহুড়ো করে বের হলো বাসা থেকে। উদ্দেশ্য চিঠির বাহককে ধরা। কিন্তু বাইরে গিয়ে কাউকে পেলো না। পার্থদাও বাহক সম্পর্কে তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না। অপরিচিত এক টোকাই দিয়ে গেছে যাকে আগে কখনো দেখেননি। আর খামটা যেহেতু কেউ একজন হাতে করে দিয়ে গেছে কাজেই কোনো কুরিয়ার কিংবা ডাকঘরের চিহ্ন নেই। প্রেরকের নাম থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
সেদিন আর বাসা থেকে বের হয়নি নভো। নানান রকম অদ্ভুত চিন্তা মাথায় খেলা করতে থাকে। সম্ভবত বেখেয়ালীপনা দেখে রাতে পার্থদা ওর সমস্যা জানতে চাইলো। প্রথমে ভেবেছিল পার্থদাকে কিছু বলবে না কিন্তু উনার চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত চিঠি আর ছবিগুলো দেখালো, যদিও ছবিগুলো দেখাতে খুবই লজ্জা লাগছিল।
এরপর নভোকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কালপ্রিটকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত মৃনের সাথে যোগাযোগ করবে না। চিঠিতে যে হুমকি দেয়া হয়েছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে মৃনের অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে। সে বেঁচে থাকতে মৃনের কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারে না। কাজেই প্রথম কাজ হলো কালপ্রিটকে খুঁজে বের করা। আর এজন্য পার্থদা প্রত্যক্ষ ভাবে সহযোগীতা করবেন। তিনিই জাকারিয়া ভাইর কথা বলেন। জাকারিয়া ভাই হলেন পার্থদার বন্ধু, একই সঙ্গে আইটি স্পেশালিস্ট ও ব্যবসায়ী। নীলক্ষেতে উনার ফটোকপির দোকান আছে। উনি হয়তো কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, জাকারিয়া ভাই তখন ঢাকার বাইরে, ফিরতে কয়েকদিন দেরি হতে পারে।
এদিকে নভোর গা ঢাকা দেয়া দরকার, কারণ সে না চাইলেও মৃন তো ঠিকই ওকে খুঁজে বের করবে। পার্থদাই সে ব্যবস্থা করে দিলেন, মোহাম্মদপুরে উনার এক বন্ধুর মেসে।
- স্টুডিও প্রিন্ট হলে সহজে একটা ক্লু পাওয়া যেত।
জাকারিয়া ভাইর কথায় বাস্তবে ফিরলো নভো। বললো, তাহলে কী করা যায়?
- সেটাই তো ভাবছি। ধরো আরেক দিক দিয়ে ভাবলে, সুবিধা হলো বলা যায়। যদি ছবিগুলো নীলক্ষেত থেকে প্রিন্ট করা হয়ে থাকে তাহলে খুঁজে বের করাটা সহজ হবে।
- জ্বী, তাহলে তো খুবই ভালো হয়।
- তবে আমাদের আরেকটা কাজ করা জরুরী। ছবির এই যুবকের পরিচয় বের করতে পারলে খুব সুবিধা হয়। একে দেখে তো দেশী মনে হয় না। ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানী হতে পারে। হয়তো ইন্টারনেট থেকে ছবি যোগার করেছে। কিন্তু কমন ফেস না।
- হতে পারে।
পার্থদা বললেন, এই দায়িত্বটা বন্ধু তোর ।
- হুম দেখি। আচ্ছা তোরা আরেকটু অপেক্ষা কর।
জাকারিয়া ভাই একটা ছবি স্ক্যান করে ফটোশপে ওপেন করলেন। ব্লার টুল দিয়ে মৃনের মুখটা ঝাপসা করে দিল। এখন কোনোভাবেই আর মৃনকে চেনা যাচ্ছে না। এবার ছবিটা প্রিন্ট করলেন। দুই কপি। মূল ছবিগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা যাও। আমি খোঁজ নিচ্ছি। সংবাদ থাকলে পার্থকে জানাবো।
জাকারিয়া ভাই'র ডেরা থেকে বেরিয়ে পার্থদা আর নভো আলাদা হয়ে গেল। সাইন্স ল্যাব পাড় হয়ে ধানমন্ডির দিকে ভেতরে ঢুকে গেল নভো। ধানমন্ডি তিন নম্বর রোডের পার্ক-এর বেঞ্চে অনেকক্ষণ বসে থাকলো। একদল বালক ক্রিকেট প্রাকটিস করছে। মাঝে মাঝেই বল এসে পড়ছে পায়ের কাছে অথচ সেদিকে নভোর খেয়াল নেই। সে দশ টাকার বাদাম কিনলো এক ঠোঙ্গা।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঢাকা শহরের গোধূলী আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো সন্ধ্যার আগেই জ্বলতে শুরু করে। কেমন যেন মন খারাপ করা একটা হলুদ আলো। সবকিছুর স্বাভাবিক রং হারিয়ে যায়। ভালোবাসার রং ফিকে হয়ে যায়। অবশ্য এই সুযোগে নিজের মনের রংটাও লুকিয়ে ফেলা যায়।
মৃনের সাথে মাত্র ক'দিন যোগাযোগ হয়নি অথচ নভোর মনে হচ্ছে কয়েকযুগ পেরিয়ে গেছে। খুব একা একা লাগছে। মৃনের কথা ভুলতে পারছে না কোনোভাবেই। খুব ইচ্ছে করছে সাইন্স ল্যাব থেকে একটা ২৭ নম্বর বাস ধরে উত্তরা চলে যেতে। দূর থেকে একবার মৃনকে দেখেই চলে আসবে। মৃনকে কি একটা ফোন করবে? নভো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না্
বাসার উদ্দেশ্য রাস্তায় নামলো সে। রিক্সা নিল না। আনমনা হয়ে হাঁটছে। রাস্তাটা সামনে বাম দিকে বাঁক নিয়েছে। মোড়ের বৈদ্যুতিক বাতিটা জ্বলছে না সেদিকে খেয়াল করলো না। কাজেই রাস্তার পাশে রাখা "সাবধান, রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলছে" ছোট সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো না। মোড় ঘুরতেই সদ্য খোঁড়া বড়ো সড়ো একটা ড্রেনে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে দাঁড় করালো। ড্রেনের ভেতর থেকে কয়েকটা রড খাড়া ভাবে বের হয়ে রয়েছে। বড়ো বাঁচা বেঁচে গেল এ যাত্রায়।
উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। ছোট সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো। নিজের ওপর খুব রাগ হলো, এমন একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো না! মোড় ঘুরতেই দেখলো, একটা মোটর সাইকেল দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে! ওকে থামানো দরকার। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য নভো চালককে থামার জন্য দুইহাত তুলে ইশারা করলো। চালক অল্প দূরত্বের মধ্যেই মোটরসাইকেল থামাতে সমর্থ হলো। হেলমেটে চালকের সম্পূর্ণ মাথা ঢেকে আছে, বাইরে থেকে চেহারা দেখার কোনো উপায় নেই।
নভো বললো, সামনে রাস্তা কাটা, যেতে পারবেন না।
উঁকি দিয়ে সামনে দেখার চেষ্টা করলো। সম্ভবত ছোট সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো। মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে যাবার সময় হেলমেটের গ্লাস না তুলেই বললো, ধন্যবাদ। নভোনীল।
মোটর সাইকেল চালক নভোর নাম জানলো কীভাবে-এটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো ওর। ততক্ষণে মোটর সাইকেল দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেছে। আবার অনেকগুলো প্রশ্ন এসে জমতে শুরু করলো ওর মনে। মোটর সাইকেল চালক ওর নাম জানলো কিভাবে? সে কি ক্যাম্পাসের কেউ? কিন্তু এভাবে হকচকিয়ে দেয়ার কারণ কী? সে কি নভোকে অনুসরণ করছিল?
রাতে ভালো ঘুম হলো না।
দুঃশ্চিন্তা আর দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে রাত পার করতে হলো।
সকালে পার্থদা এলেন আরেক দুঃসংবাদ নিয়ে। জাকারিয়া ভাই নীলক্ষেতের দোকানীদের সাথে যোগাযোগ করেছেন কিন্তু এই ছবিগুলো ওখান থেকে প্রিন্ট করা হয়নি। সম্ভবত ব্যক্তিগত প্রিন্টার ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মূল ছবিগুলো উনার দরকার। যে ফটো পেপারে প্রিন্ট করা হয়েছে সেগুলো নীলক্ষেত থেকে কেনা হয়েছে কি না তা জানা যাবে।
নভোর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পার্থদাকে দেখে যতখানি আলোর সম্ভাবনা দেখেছিল তা দপ করে নিভে গেল।
তবে পার্থদা জানালেন, কাল বিকেলে মৃন ওর খোঁজে বাসায় গিয়েছিল। খুব কান্নাকাটি করেছে। নভো চাইলে ওর মোবাইল ফোন থেকে মৃনকে একটা কল করতে পারে।
মৃনকে ফোন করবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না নভো!
(চলবে)
আগের পর্ব:
পর্ব ১৩ কল্পদ্রুম
পর্ব ১২ মোঃ মাইদুল সরকার
পর্ব ১১ ঢুকিচেপা
পর্ব ১০ বিলুনী
পর্ব ৯ মনিরা সুলতানা
পর্ব ৮ কবিতা পড়ার প্রহর
পর্ব ৭ নিয়াজ সুমন
পর্ব ৬ পুলক ঢালী
পর্ব ৫ আখেনাটেন
পর্ব ৪ খায়রুল আহসান
পর্ব ৩ মেঘশুভ্রনীল
পর্ব ২ পদ্ম পুকুর
পর্ব ১ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
ছবি: গুগল মামা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৪৬