রাজধানীতে আভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলের জন্য যেসকল বাস সার্ভিস চালু আছে সেগুলোর মধ্যে সিটিং সার্ভিস নামক এক প্রকার সার্ভিস চালু আছে। লোকাল বাসের তুলনায় ভাড়া একটু বেশি হলেও সাধারণত সিটের অতিরিক্ত দুই/তিন জনের বেশি যাত্রী দাঁড় করিয়ে নেয় না এবং অযথা যেখানে সেখানে থামায় না। যাত্রী সিটিং হলেই কন্ট্রাক্টর বাসের দরজা লাগিয়ে দেয় গেটলক স্টাইলে। তা না হলে যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘ঐ কন্ট্রাক্টর, দাঁড়িয়ে লোক নিলে কিন্তু সিটিং ভাড়া পাবি না, লোকাল পাবি’। তবে অফিস টাইমে দাঁড়ানো যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেও তেমন একটা কাজ হয় না। বেশিরভাগ যাত্রীই কোন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করে না। আমিও ইদানিং বেশিরভাগ যাত্রীর দলে যোগ দিয়েছি। কারণ, প্রতিবাদ করতে গেলে প্রায়ই অন্যান্য যাত্রীদের সমর্থন পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে যাত্রীদের কেউ একজন বলে বসে, ‘ভাই অযথা চিৎকার করবেন না, ভালো না লাগলে নেমে যান’। তখন আত্মসম্মান বোধের জায়গাটা সঠিকভাবে কাজ করলে নেমে যাওয়াটাই সঠিক বলে মনে হয়।
তবে মূল সমস্যা হলো, মোহাম্মদপুর-মতিঝিল-মোহাম্মদপুর রুটে কোন সিটিং সার্ভিস নেই। কাজেই অফিস থেকে ফেরার পথে মতিঝিল-মিরপুর রুটের সিটিং বাসে উঠতে হয়, আর নামতে হয় কলেজগেট বা শ্যামলী বাস স্ট্যান্ডে যদিও মিরপুরের ভাড়াই গুনতে হয়। বাকিটা পথ হেঁটে বা রিক্সাই ভরসা। যদিও এই রুট ব্যবহার করলে সামান্য খরচ বেশি হয় তবুও কিছু সুবিধার জন্য এই রুটই বেশি ব্যবহার করি। সাধারণত বসার জন্য একটা সিট পাওয়া যায়, গায়ের সাথে গা ঘেঁষে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে না, কন্ট্রাক্টরের সাথে যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে গ্যাঞ্জাম লাগে না ইত্যাদি ইত্যাদি সব সুবিধার কথা বিবেচনা করা যা। তাছাড়া জ্যামে-গরমে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘামে ভিজে নিজের শরীরও খুবই অস্বস্তিকর ঠেকে।
এমনই সাধারণ এক সন্ধ্যায়, সাতটার পর অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। গাড়ি ঘোড়া নেই। এই পরিস্থিতি হলে অবশ্য সিটিং সার্ভিসের জন্য খুব বেশি অপেক্ষা না করে লোকাল বাসে উঠে পরি। তবে আজ সারাদিন কাজের অনেক চাপ গেছে, লোকাল বাসে হুড়োহুড়ি করে যেতে ইচ্ছে করছে না। ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর একটা সিটিং বাসে সিট পেলাম। বাসের মাঝামাঝি তবে জানালার পাশেরটা নয়, ভেতরের দিকের সিটটা। এতে অবশ্য সুবিধাই হলো। এক সিট সামনে মাথার উপরে একটা ফ্যান ঘুরছে, যার কিঞ্চিত বাতাস আমার গায়েও লাগছে। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত ছাড়লাম। বাসও ছাড়লো।
বহুদিন গ্রামে যাওয়া হয়না। গ্রামে যে দুই রুমের একটা বাড়ি আছে সেটাও ভুলে যাই মাঝে মাঝে। কেউ থাকে না সেখানে। বাড়ির সামনে একটা খেঁজুর গাছ ছিল। ছিল মানে এখনো আছে। দক্ষিণে একটা পুকুর থাকার কথা, সেখানে মাছ চাষ করা হতো এক সময়। পুকুরের পাড় দিয়েই মেঠো পথটা চলে গেছে ধানক্ষেত পেরিয়ে গ্রামের শেষ সীমানায়। এই মেঠো পথটাই ছিল আমাদের দৌড়াদৌড়ি করার প্রধান ক্ষেত্র।
প্রবল ঝাঁকুনীতে তন্দ্রা কেটে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম কি না বুঝতে পারলাম না। হেডফোন খুলে ফেললাম, কান গরম হয়ে গেছে। চোখ মেলে তাকাতেই বুঝলাম শাহবাগের বিখ্যাত জ্যামে আটকা পড়েছি। এই জ্যামের শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায় তা বের করা যাবে না। দু’এক জন যাত্রী নেমে যাচ্ছে তো দু’একজন আবার উঠছে। বাসে পাঁচ/সাত জন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একজন আমার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যানের বাতাসের গতিপথ আটকে দিয়েছে। বিরক্তিকর। দাঁড়ানো যাত্রীদের মধ্যে একজন বয়স্ক যাত্রীও আছেন। প্রায়ই আশেপাশে তাকাচ্ছেন, কেউ নামলে তার সিটে বসতে পারতেন হয়তো। এই আরেকটা কারণে লোকাল বাস অপছন্দ করি, যদিও সিটিং বাসেও এই ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে। যেমন ঘটছে আজ।
বয়স্ক মানুষটাও নিশ্চয় সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে আমারি মতো ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু বসার জায়গা না পেয়ে কোনো একটা সিটে সামান্য হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এরকম পরিস্থিতিতে আমার মধ্যে যে বিষয়টা কাজ করে তা হলো, এই বয়স্ক মানুষটাকে আমার সিটটা ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু একই সাথে মস্তিস্কের আরেকটা অংশ মনে করে, আমি তো নিজেও ক্লান্ত। আমার জন্যও তো বিশ্রামের প্রয়োজন। তাছাড়া ঐ বয়স্ক মানুষটা যখন বাসে উঠেছেন তখন তো তিনি জেনে শুনেই উঠেছেন যে, বাসে সিট খালি নেই, তাঁকে দাঁড়িয়েই যেতে হবে। কাজেই ফলাফল দাঁড়ায় যে, আমার সিট ছেড়ে দেয়া হয় না কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক রকম অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে। আজও একই ঘটনা ঘটছে। ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধে ভুগছি কিন্তু সিট ছেড়ে দিচ্ছি না। আসলে আমার বাবার জন্যই এই অপরাধ বোধের জন্ম। স্কুল শিক্ষক বাবা সবসময়ই কিছু না কিছু উপদেশ দিতেন। যেমন, ‘বয়স্ক মানুষদের সিট ছেড়ে দিতে হবে...’। আহ্, নীতিকথা শহুরে জীবনে কতটা মানানসই আমি বুঝি না। এটা যদি গ্রামে বা মফস্বল শহরে হতো তাহলে তো সিট ছেড়ে দিতে একরকম বাধ্য হতাম। দেখা যেতো যে, বয়স্ক মানুষটি কোন না কোনভাবে আমার পরিচিত বা উনি আমাকে চিনেন। হয়তো বলেই বসতেন, ‘তুমি রহমান মাস্টারের ছেলে না?’ কাজেই বাবার নাম রক্ষার্থে হলেও সিট ছাড়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু শহুরে মানুষটা তো আমার বাবাকে চেনেন না কিংবা আমার পরিচিত নন, কাজেই এক্ষেত্রে তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
যুক্তি তর্কে নিজের সাথে নিজেই হেরেই যাই। তবে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিই যে, বয়স্ক মানুষটার জন্য সিটটা ছেড়ে দেবো। ঠিক সেসময় বয়স্ক মানুষটার পাশের সিটে বসা মাঝ-বয়েসী এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, মুরুব্বী!
বয়স্ক মানুষটা তাঁর দিকে তাকালেন। যাক, ঐ ভদ্রলোক হয়তো তাঁর সিটটা ছেড়ে দেবেন! দ্বিধান্বিত আমাকে উদ্ধার করবেন!
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, মুরুব্বী, ভাড়া কি কম দিছেন?
বয়স্ক মানুষটা এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন না, আমিও বুঝলাম না। তিনি বললেন, ভাড়া কম দিব কেন?
- তাহলে দাঁড়িয়ে যাবেন কেন?
- সিট তো খালি নেই বাবা!
- হ্যাঁ, সেটাই তো বলছি। সিট খালি নেই দেখেও তো সিটিং বাসে উঠলেন! ভাড়া তো কম দিবেন না, তাহলে দাঁড়িয়ে যাবেন কেন? আপনাদের জন্যই সিটিং বাস সিটিং থাকে না।
বয়স্ক মানুষটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। বললেন, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু কোন বাসেই উঠতে পারিনি। তাই-
- এভাবে বাসে উঠবেন না। অন্যের সমস্যা হয়।
বয়স্ক মানুষটা বোধহয় বিষয়টা মেনে নিতে পারছেন না, তিনি বিনয়ের সাথে বললেন, আপনার কী সমস্যা করেছি বলবেন কি?
- এই যে আপনি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন এটাই সমস্যা। আপনার গায়ের গরম আমার গায়ে লাগছে। তাছাড়া ফ্যানের বাতাস পাচ্ছি না আপনার জন্য।
বয়স্ক মানুষটা মাথার ওপরের ফ্যানের দিকে তাকালেন একবার, তারপর নিজের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য বাসের পিছনের দিকে চেপে দাঁড়ালেন।
আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। এখনো অনেকটা পথ বাকি, সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে যাবো নাকি বসেই থাকবো? আসলে মাঝ-বয়েসী ভদ্রলোকের অদ্ভুত আচরণ আমাকে আরো বেশি দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। উনি তো বয়স্ক মানুষটিকে সরাসরি অপমান করলেন কিন্তু বাসের কোন যাত্রীই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামালো না, যেন এটাই স্বাভাবিক! আমিও কিছু বলিনি। কেন বলিনি? জানি না, শহুরে জীবনে এটাই হয়তো স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি আমরা। ভাবছি, পাশে বাবা থাকলে এতক্ষণে নির্ঘাত আমাকে দু’টা থাপ্পড় কষতেন। আহ্, বাবা! আবারো ফিরে আসছেন উপদেশ নিয়ে! না, আর না। দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটু গলা চড়িয়ে হাঁক দিলাম, চাচা, এখানে বসেন।
বয়স্ক মানুষটা আমার দিকে তাকালেন অবাক চোখে। একটু আগে তাঁর সাথে যা ঘটে গেছে তারপর তিনি এটা আশা করতে পারেন না। এক পা এগিয়ে আসলেন, তখনি আমার পাশে দাঁড়ানো মানুষটা বললেন, আমি উনার আগে উঠেছি, সিটটা আমারি প্রাপ্য।
বয়স্ক মানুষটা দাঁড়িয়ে পড়লেন। অযথা আরেক ঝামেলায় উনি জড়াতে চান না নিশ্চয়। পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালাম চোখ তুলে। বাচ্চা একটা ছেলে, বড় জোড় কলেজে পড়ে। কাঁধে একটা ভারী ব্যাগ ঝোলানো। হয়তো অনেক ভারী ভারী বইপত্র আছে, তবে নীতিবিদ্যার কোন বই যে নেই তা আমি নিশ্চিত। বললাম, ছোট ভাই, উনি তো বয়স্ক মানুষ, উনাকে বসতে দিন।
ছেলেটা বললো, তা কেন হবে? আমি তো আগে থেকে আপনার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। সিট খালি হলে তো আমিই আগে বসবো। তাছাড়া ঐ চাচা তো আপনার সাথের লোক না।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম। তারপর মিথ্যেটাই বললাম, উনি আমার পূর্ব-পরিচিত, আমার বন্ধুর বড় চাচা। এতক্ষণ উনাকে দেখিনি, দেখলে সিটটা আগেই ছেড়ে দিতাম।
বয়স্ক মানুষটা আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন, বললেন, থাক বাবা, আমি বসবো না।
বললাম, না চাচা, আপনি বসুন। আমি এখানেই নেমে যাবো।
ছেলেটা কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না। বয়স্ক মানুষটার জন্য সিটে বসা নিশ্চিত করে টুপ করে নেমে গেলাম রাস্তায়। বাকি পথ কিভাবে যাবো জানি না, তবে বুকের ভেতরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে।
ছবি: গুগল মামা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:২৪