প্রথমেই ছাত্রবিক্ষোভে 'উস্কানি' বা 'মদদ' দেবার বিষয়টি পরিস্কার করতে চাই। কেননা রাষ্ট্রকতৃক আনীত ঢাবি এবং রাবির শিক্ষকদের এটাই মূল অপরাধ (?)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি শিক্ষকদের সমর্থন বা সহমত প্রকাশের বিষয়টি নতুন নয়; মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সমানবয়সী। প্রথমত, শিক্ষকদের খুব সামান্য অংশই ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে সহমত পোষণ করেন। বেশিরভাগ শিক্ষকই এসব ঘটনাবলী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। সেই গুটিকয়েক শিক্ষকের এই সংহতি প্রকাশ করবার ধরন ও প্রক্রিয়া হচ্ছে, সমাবেশে দুটো কথা বলা বা মিছিলে কিছুদূর হাঁটা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ছাত্রদরদী শিক্ষকরা কখনোই আন্দোলনের অংশ হিসেবে 'তোমার আগুন জ্বালাও, ভাঙচুর করো' -- এধরনের বক্তব্য দেন না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তেজিত ছাত্রদের সংহত-শান্ত রাখতেই তাদের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাবি-আদায়ের আন্দোলনের কথাই তারা ছাত্রদের বলে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি ভাঙ্গা বা গাড়িতে আগুন দেয়ার কথা তাদের প থেকে বলার প্রশ্নই আসেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ঘটনার যে আন্দোলন, হুমায়ূন আজাদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন -- এসব ন্যায্য ও জরুরি ছাত্র-আন্দোলনে শিক্ষকরা বরাবরের মতোই জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের সেই গৌরবগাঁথার কথা এখানে নাই বা বললাম। তাই, এদেশের বিবেকবান এবং সংবেদনশীন মানুষের কাছে আমাদের প্রশ্ন, ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশের এ শিক্ষকসুলভ অংশগ্রহণকে কি আপনি/আপনারা অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করবেন? এই 'অপরাধে' (?) কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরএভাবে মাসের পর মাসের জেলে পুরে রাখা যায়?
এবার চোখ ফেরানো যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদের মুক্তি-চাওয়া এবং মুক্ত করবার ধরন ও প্রক্রিয়ার দুঃখজনক বৈষম্যের দিকে। এরই মধ্যে ঢাবি এবং রাবি শিকদের হাজতমুক্ত করবার চেষ্টা, রাষ্ট্রপরে কথিত বিবেচনা এবং চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় কেন্দ্র ও প্রান্ত নিরিখে প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির নজরকাড়া বৈপরীত্য দৃশ্যমান হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, ঘটনার কেন্দ্রস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তির বিষয়ে সবাই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। আর ঘটনার প্রান্তিকস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রায়সমাপ্ত বিচারকার্যের রায় হতে যাচ্ছে ৪ ডিসেম্বর। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান হচ্ছে, ঘটনাক্রমের এই বৈপরীত্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী প্রশাসনের দ্বৈতাচরণে আমরা বিস্মিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যেন রাজশাহীর লোকজন বেশিমাত্রায় জরুরি আইন ভঙ্গ করেছে, ঐ শিক্ষকদের 'উস্কানি'র মাত্রা অনেক বেশি ছিল, যেন উস্কানিদাতার সংখ্যাও ওখানে বেশি ছিল (রাজশাহীতে গ্রেফতারকৃত শিক্ষকের সংখ্যা ঢাকার চাইতে দ্বিগুণ)। তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে পুরো পরিস্থিতিই রাজশাহীর শিকদের বিপে কাজ করেছে, যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষত। পাশাপাশি এবিষয়ে ঢাবি, রাবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সক্রিয় নিরবতাতেও আমার বিস্মিত না হয়ে পারি না।
আমরা গভীর দুর্ভাবনায় পর্যবেণ করেছি, রাজশাহীর প্রশাসন ঢাকার চাইতে অধিক সক্রিয় ছিল। রাবির অধ্যাপক ড. তাহের হত্যা-পরবর্তী সময়ে রাজশাহীর প্রশাসনকে তো এতটা তৎপর দেখা যায়নি। মামলা, চার্জশিট গঠন, মামলার শুনানি, এমনকি রায় সবকিছুই প্রায় তিনমাসের মধ্যেই সমাপ্ত হতে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রশাসন এবং শিক্ষক সমিতি যেক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃত শিক্ষকদের মুক্তির জন্য সরকারের কাছে দেন-দরবার করছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতি হয়ে যাবে, আগ বাড়িয়ে এরকম কথাও বলে বসেছেন -- দেনদরবারের কথা তোলাই থাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট দুয়েকবার ঢাকা-রাজশাহী উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের মুক্তির কথা তুলেছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত-কমিটি কেবলই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তির ব্যাপারটি সদয় বিবেচনায় রাখার সুপারিশ করলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া গেল না তদন্ত-কমিটির প্রতিবেদনে, অন্তঃত পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা এরকমই জানতে পারি। ঢাবির শিক্ষকদের ব্যাপারে সদয় আর রাবির শিক্ষকদের ব্যাপারে নিরবতা (প্রকারান্তরে নির্দয়) -- বিষয়টি আমরা কেন্দ্র-প্রান্ত ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার অসাম্য দৃষ্টিভষ্টি এবং বৌদ্ধিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য হিসাবে দেখতে চাই। এ বৈষম্য বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে, এ-ভাবনায় আমরা অধিক শঙ্কিত। পাশাপাশি, আমরা ঢাবি এবং রাবির শিক্ষকদের ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি সহমত প্রকাশের কারণে দীর্ঘ তিনমাসাধিক সময়ের হাজতবাসে সমানভাবে ব্যথিত এবং মর্মাহত। ছাত্র এবং শ্রেণীকক্ষ থেকে দূরে থাকবার কষ্টবোধ তাদের কতোটা যন্ত্রণা দিচ্ছে, এ ভাবনায় আমরা গভীরভাবে বেদনাহত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ২০ আগস্টের ঘটনার শুরুর দিকটাকে সবাই ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলন হিসেবেই স্বীকার করেন বা করবেন। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সেরকমই আভাস মিলেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিগত দুই 'গণতান্ত্রিক' সরকারের দুর্নীতিবাজ নেতা ও ছাত্রনেতাদের 'খারাপ' সময় যাচ্ছে বলে, সেইসব বিক্ষুব্ধ রাজনীতিকরাই, সাধারণ ছাত্রদের একটি ন্যায্য আন্দোলনকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যায় বলে সর্বমহল থেকে, এমনকি তদন্তপ্রতিবেদনেও বলা হয়েছে। ঘটনার দ্বিতীয় দিন থেকেই আন্দোলন নৈরাজ্যের চেহারা পেতে থাকে। সবধরনের প্রতিবেদনেই বলা হচ্ছে, এই নৈরাজ্যের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শক্তির ভূমিকাই বেশি। তাহলে এই অপরাধের শাস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের লোকজন কেন পাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ছাত্র-আন্দোলনে সংহতি জানানোর জন্য জেল খাটবেন, এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কেন এখনও সমাপ্তি ঘটছে না? আর ঘটনার কেন্দ্রস্থলের চাইতে ঘটনার প্রান্তের লোকজন বেশি পরিমাণে বা সংখ্যায় শাস্তি পাবেন, এটাইবা কতোটা ন্যায়সঙ্গত ? বর্তমান সরকারের কথিত অনেক অনেক সাফল্যের পাশে এই ঘটনাটি কি একটি 'ক্ষত' হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে না? হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে জেলে পুরে রাখবার ঘটনাটি কি কখনোই মুছে যাবে? এত মানুষের দীর্ঘশ্বাসের ভার কি এ-সরকারকে বহন করতে হবে না?
তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, ঢাবির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আটককৃত ঢাবি ও রাবির সকল শিক্ষক ও ছাত্রদের মুক্তি দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তাদের সবার মুক্তি খুবই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা সুন্দর, সত্য এবং সৃষ্টির পক্ষে। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিপক্ষ ভাববার কোন যুক্তিসংগত কারণ নাই। আমরা জোরালোভাবে বিশ্বাস করি, একটি জ্ঞানী, দেশপ্রেমিক এবং মননশীল প্রজন্ম তৈরীর করবার জন্য এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আত্মমর্যাদায় বিকশিত হতে দেয়া উচিত। তাই, ঢাবি এবং রাবির শিক্ষকদের সত্বর মুক্তি দিয়ে এ সরকার একটি সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমার আশা করছি।
....
লিখেছেন: ফাহমিদুল হক, রাহমান নাসির উদ্দিন, বখতিয়ার আহমদ, শাহ নিসতার জাহান, কাজী মারুফুল ইসলাম, সায়েমা খাতুন, তানিজমউদ্দিন খান, মাহমুদুল সুমন
লেখকবৃন্দ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
রচনাকাল: ২৭ নভেম্বর, ২০০৭; প্রথম প্রকাশ: আজকের প্রথম আলো (২৯ নভেম্বর, ২০০৭)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০০৭ রাত ৯:১৫