somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক

২৭ শে নভেম্বর, ২০০৭ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে, নাট্যকার মামুনুর রশীদের কলামের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, কিছু সম্পাদকীয় কাটাকুটিসহ। যারা পড়েননি, তাদের জন্য পোস্ট করা হলো।]

প্রথম আলোতে ২০ এপ্রিলে প্রকাশিত নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের 'বিজ্ঞাপন: অনুষ্ঠানের সৌজন্যে' কলামটি পড়ে এই প্রতিক্রিয়াটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। তাকে ধন্যবাদ যে খুবই সময়োপযোগী ও জরুরি একটি প্রসঙ্গ, স্বল্প পরিসরে হলেও, পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। টেলিভিশনের নাটক দেখতে গিয়ে বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে দর্শককে যে-নাকাল হতে হয়, সেই প্রসঙ্গটি দিয়ে শুরু করে তিনি বাংলাদেশের মুদ্রণ ও ইলেক্ট্রনিক সব মিডিয়াতেই বিজ্ঞাপনের আগ্রাসনের বিষয়টি আলোচনা করেছেন এবং এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছেন।

মামুনুর রশীদকে আরেকটি কারণে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। তিনি নাট্যব্যক্তিত্ব হয়েও বিজ্ঞাপনের আগ্রাসন নিয়ে কথা বলছেন যেক্ষেত্রে এদেশে নাট্যকাররাই বিজ্ঞাপননির্মাতা Ñ ফলত তারা তাদের কর্মপরিধির মধ্যে এধরনের অসঙ্গতি সত্ত্বেও সাধারণত নিশ্চুপ থাকেন। থিয়েটারকর্মীদের এককালের আদর্শ মামুনুর রশীদ আজও ধরে রেখেছেন, নির্মাণ করছেন চে গুয়েভারাকে (চের সাইকেল) নিয়ে কিংবা আদিবাসী সাঁওতালদের (রাঢ়াঙ) নিয়ে মঞ্চনাটক। তার সহকর্মী নাট্যব্যক্তিত্বরা যখন প্রায়ই বলছেন 'গ্লোবালাইজেশন আমাকে গলাধঃকরণ করেছে' (আলী যাকের) এবং বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছেন কিংবা অনুজ প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকর্মীরা বলছেন 'এখানে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি', (অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) তাই চলচ্চিত্র-টেলিফিল্ম নির্মাণ স্থগিত রেখে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছেন, বলছেন না 'কিছু টাকা জমিয়ে নিই, আমার ছবিটা আমি নিজেই প্রযোজনা করতে চাই', তখন তার কলামটি ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।

ঢাকাই ছবিতে 'এটেম্পট্ টু রেপ' দৃশ্যে, পর্নোগ্রাফিক কাটপিস, ঢাকার বাইরের কোনো সিনেমা হলে দর্শক হিসেবে দেখে যেমন একজন সহনায়িকার আর্তনাদ করার কথা, মামুনুর রশীদের তার অভিনীত নাটকে বিজ্ঞাপনের অশ্লীল অনুপ্রবেশ দেখে তেমনই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমরা যারা দর্শক তারা যেহেতু নাটকের অংশ নই, তাই আমাদের তেমন প্রতিক্রিয়া হয়না, কিন্তু টেলিভিশনে কিছু একটা দেখতে দেখতে আমরা সাধারণত ভুলে যাই ঠিক কী দেখছিলাম। হয়তো একটা নাটক দেখছিলাম, কিন্তু একটা দৃশ্য শেষ হতে না হতেই, কাহিনী দানা বাঁধতে না বাঁধতেই বিজ্ঞাপনবেশে হাজির হয়ে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আমাদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ফেলে, বেভারেজ কোম্পানি আইল্যান্ডে যাবার আমন্ত্রণ জানায়, মসলা কোম্পানি বৌকে পুনরায় রাঁধুনীর প্রতিপন্ন করে কিংবা রঙ ফর্সাকারী ক্রিম আমি কালো বলে আমাকে আরও বেশি হীনম্মন্যতায় ডুবিয়ে দেয়। এভাবে আকাশ-পাতাল-দ্বীপ-বর্ণবাদ ঘুরে যখন আমি নাজেহাল-পরিশ্রান্ত পরিব্রাজক, তখন আমার মনে না-থাকারই কথা কী দেখছিলাম।

কিন্তু আমার মতো দশা সব দর্শকের হয়না। অনেক অনেক দর্শক আছেন, যারা বিজ্ঞাপনের এই জোয়ারে ভাসতে কোনো অসুবিধা বোধ করেন না, বরং উপভোগ করেন। বিজ্ঞাপন দেখে তারা মার্কেটে ছোটেন 'ফ্রি'-টা সংগ্রহের জন্য, একটা কোলায় অভ্যস্ত একজন অন্তঃত চেখে দেখার জন্য অতিরিক্ত আরেকটা কোলা কেনেন, মেখে দেখার জন্য অতিরিক্ত আরেকটা ক্রিম খোঁজেন। এই 'অতিরিক্ত' খেয়ে-মেখে-চেখে তাদের খরচ বাড়ছে, বাড়তি অর্থোপার্জনের চাপ পড়ছে উপার্জনকারী পরিবারের সদস্যটির ওপরে। আমাকে প্রলুব্ধ করে বিজ্ঞাপন যে আমার পকেটই কাটছে, এটি বোঝার মতো সচেতনতা অনেক মানুষেরই নেই। আবার সচেতন হবার ঢাল বুকের সামনে ধরে রাখলেও, প্রতিরক্ষা বেশিক্ষণ টেকে না। কারণ বিজ্ঞাপনের এই গুণটা আছে যে সে তার পণ্য সম্পর্কে দর্শককে কেবল প্রভাবিতই করে না, সেটিকে 'ওউন'-ও করায়। তাই টেলিফিল্ম বা মেগাসিরিয়ালের দর্শকরা নাটকটি সম্পর্কে আলোচনা করার চাইতে অনেক বেশি আলোচনা করে সেটি দেখতে গিয়ে যে যে বিজ্ঞাপন তারা দেখেছেন সেগুলো নিয়ে। অপি করিম যে-নাটকে ছিলেন, সেটিতে তার অভিনয় কেমন হলো, এটি আলোচনা না করে দর্শকরা অনেক বেশি আলোচনা করেন ঐ নাটকটি দেখতে গিয়ে 'একটেল জয়'-এর যে-বিজ্ঞাপনটি দেখেছেন, সেটিতে অপি করিমের পারফরম্যান্স নিয়ে।

বিজ্ঞাপনের এই যাদুকরী মতা কোত্থেকে আসে? বাচ্চাদের অনুষ্ঠান শুরু হলে বাচ্চারা উঠে যায়, কিন্তু 'রুচি চিপস'-এর বিজ্ঞাপন কীভাবে তাদের আটকে রাখে? কারণ হলো, ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগ ও গবেষণা, ৩০ মিনিটের নাটকের চাইতে অনেক বেশি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কমে যাচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞাপনে বাড়ছে। আর এই গবেষণা বহু পথে গিয়ে বিভ্রান্ত নয়, একটাই তার গন্তব্য --Ñমানবমন। কীসে সে প্রলুব্ধ হয়, কী তাকে নাড়া দেয়? তা যদি হয় বিত্তবাসনা, সৌন্দর্যকামিতা, আত্মপ্রচার, যৌনাকাঙ্ক্ষাÑতবে সেগুলো ধরেই নাড়া দাও, ঝাঁকুনি দাও। ক্রয়মতা না থাকুক, ক্রয়াভ্যাস ঠিকই গড়ে উঠবে।

মামুনুর রশীদ একটি প্রশ্ন তুলেছেন, অতিবিজ্ঞাপন দিলেই পণ্যের প্রসার হয়? আমার অনুমান কখনও কখনও হয়, কখনও কখনও হয় না। আমার যদি আদর্শ ভোক্তামন প্রস্তুত থাকে, আমি যদি প্যাসিভ কনজিউমার হই, তবে হবে। আমার মন যদি বিজ্ঞাপনের এই 'চক্রান্ত'র বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে চায়, তবে হবে না। ব্রিটেনে যখন হাতে-গোনা কয়েকটা পত্রিকা-চ্যানেল, তখন আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির ও নিম্নশিক্ষাহারের দেশে মিডিয়ার এই 'অ্যাবনরমাল গ্রোথ' কেন, সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন, তার উত্তর খোঁজাও জরুরি। সংক্ষেপে বলা যায় নব্বই দশকে শুরু হওয়া বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণে কিছু বহুজাতিক পুঁজির অনুপ্রবেশ আমাদের মতো প্রান্তিক অর্থনীতির দেশগুলোতে হয়েছে, বিকাশমান মিডিয়াগুলো সেই পুঁজির শেয়ার নিতে চায়। স্থানীয় পুঁজি ও বহুজাতিক পুঁজি একত্রে যোগ করলেও তা সীমিতই, তাই মিডিয়াগুলো পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েছে। সেই পুঁজির আত্মপ্রকাশের অন্যতম অবলম্বন বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপন হলো মিডিয়ার টিকে থাকার ও মুনাফার প্রধান উপায়। তাই বিজ্ঞাপনগুলো পেতে মিডিয়াগুলো কমাচ্ছে বিজ্ঞাপনের রেট। একটি বিজ্ঞাপন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেতে তাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বেশি টাইম ও স্পেস। এর চাপে পড়ে মূল সংবাদ ও অনুষ্ঠান হয়ে পড়েছে ক্ষীণকায়, শীর্ণকায়, মাইনরিটি। কিন্তু সচেতন দর্শক চায় অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান নয়। তাই আমাদের সম্মিলিত আওয়াজ তুলতে হবে, চাপ সৃষ্টি করতে হবে, আমাদের প্রাপ্য আমাদের বুঝে নিতে হবে। মিডিয়া-মালিকরা কীভাবে এর সমাধান করবেন, সেই পথ তাদেরই বের করতে হবে। মামুনুর রশীদ তো একটা উপায় বলে দিয়েছেন, বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে চ্যানেল-মালিকদের বসতে হবে। আন্তরিকভাবে সমস্যাটির সমাধান করতে চাইলে পরামর্শদাতার অভাব হবে না।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০০৭ রাত ১১:৫০
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×