ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক সমাজে দুশ্রেণীর নারীরা ধূমপানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এক হলো উচ্চশ্রেণীর নারীরা এবং নিম্নশ্রেণীর নারীরা। মধ্যবিত্তের মেয়েরা কিছুটা কম।
উচ্চবিত্তের নারীরা ফ্যাশনে হোক বা চাকচিক্যের মোহে পরে হোক বা স্ট্যাটাস রক্ষার জন্যই হোক ধুমপানের সাথে জড়িয়ে যায়। তবে ধূমপান ছাড়াও বর্তমানে অন্যান্য মাদক গ্রহণ করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েরা সমাজে ’ পাছে লোকে কিছু বলে ’ এই ভয়ে ধূমপানে কম আসক্ত হয়। রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে গেলে দেখা যায় রাতের পার্টিতে বেশিরভাগ মেয়ের হাতেই সিগারেট। তা তাদের কাছে ফ্যাশন । এধরনের ফ্যাশন করতে পুরুষরাই নানাধরনের কথা বলে তাদেরকে হাতে সিগারেট ধরিয়ে দেয়। তারপর সিগারেট প্রীতি চলতেই থাকে।
অন্যদিকে দারিদ্যসীমার নীচে বসবাসকারী নারীরা অনিচ্ছাকৃতভাবেই ধূমপানের সাথে জড়িয়ে যায়। যেমন তামাক চাষে নারীরা বেশি সম্পৃক্ত থাকে। তামাক জ্বালানোর সময় ধূমপান হয়ে যায়। আবার পারিবারিক ও নানা অস্থিরতার জন্যও ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে যায় অনেকে। বাড়ীর গৃহকর্মীদের বেশিরভাগই দেখা যায় গুল ব্যবহার করতে।্ অনেকে পান, জর্দা ও গুল এই তিনটি একসাথে খায়। আবার অনেক বয়স্ক গৃহকর্মী প্রকাশ্যেই ধূমপান করে।
যেসব মেয়েরা পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে ফ্যাশন করতে গিয়ে সিগারেট ফুকেঁ এবং যেসব নারীরা খুবই নিম্নআয়ের হয়ে থাকে- এই উভয় শ্রেণীর মধ্যেই দেখা যায় শিক্ষার হার কম। নিম্নশ্রেণীর নারীদের অক্ষরজ্ঞান নেই আর উচ্চশ্রেনীর মেয়েদের স্কুল সার্টিফিকেটও নেই।
ধুমপান নিরোধের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের কথা বলা হয়। আইনের ফাঁক চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ধূমপান ব›ধ করার জন্য অবশ্যই কঠোর আইন হওয়া উচিত। কিন্তু ধূমপান বন্ধের পর নতুন প্রজন্ম যে অন্য কিছুতে আসক্ত হবে না তা কিন্তু নয়। বা তা নিয়ে কেউ ভাবছে না।
নিরন্তর সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে অনেক ক্ষেত্রে ধূমপানের সৃষ্টি। তবে কিশোর বয়সে কৌতুহলবশত: ধুমপানের মাত্রাটা বেশি ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,
বাংলাদেশে ২৯% নারী তামাক ব্যবহারকারী । তার মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের হার ২৮% । ১.৫% নারী সিগারেট এবং ১.১% নারী বিড়ির মাধ্যমে ধূমপান করেন। ৩০% নারী কর্মস্থলে এবং ২.১% পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার (নাটাব)। ২০০৪ -২০০৫ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে ৩৯ লক্ষ নারী তামাক সেবনে যোগ হয়েছ্ ে । ধূমপান না করেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার প্রায় ১ কোটি নারী। বর্তমানে বিশ্বে ২০ কোটি মহিলা ধুমপায়ী।
বেসরকারী সংগঠন ’প্রজ্ঞা ’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে নারী ধুমপায়ীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। আর ১ কোটি ৩০ লাখের ওপরে ধোঁয়াবিহীন জর্দা, সাদাপাতা,গুল তামাকজাত দ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত । ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের শতকরা ২৮ এবং পুরুষের মধ্যে শতকরা ২৬ জন ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। প্রত্যক্ষ ধুমপানের হার পুরুষের মধ্যে অনেক বেশ্ ি। ৪৫ ভাগ পুরুষ এবং ১.৫ ভাগ নারী সিগারেটের মাধ্যমে এবং ২১ ভাগ পুরুষ ১.১ ভাগ নারী বিড়ির মাধ্যমে ধুমপান করে। তবে পুরুষদের ধুমপানের ফলে নারীদের পরোক্ষ ধুমপানের শিকার হওয়ার হার অনেক বেশি। অর্থাৎ পরোক্ষ ধুমপানের শিকার বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি নারী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্তার (ডব্লিউ এইচ ও ) রিপোর্ট অনুযায়ী আগামীতে নারীদের ধুমপান তিনগুণ বাড়বে। প্রায় ৫৩ কোটি নারী যার ৮০% উন্নয়নশীল দেশেই হবে। দক্ষিণ এশিয়াতে ধুমপায়ী নারী ( সিগারেট, বিড়ি) ৩% । বাংলাদেশে ২৯% নারী তামাক ব্যবহারকারী আছে, তার মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের হার ২৮% এবং নারী ধুমপায়ী ১২%। তারা প্রকাশ্যেই ধুমপান করছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় ১৪ লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯ লাখ। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী এই জেলায় ৩ লাখ ৮০ হাজার নারী পুরুষ তামাক ব্যবহার করেন । তবে ঠাকুরগাও জেলায় তামাকের উৎপাদন বেশী হওয়ায় এই সংখ্যা ৫ লাখেরও অধিক বলে সেখানকার চিকিৎসদের ধারণা।
কুষ্টিয়া এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তামাক চাষ বন্ধ করে খাদ্য উৎপাদনের গবেষনার কাজ করতে গিয়ে লোক মুখে শোনা গেছে যে তামাক উৎপাদন এলাকায় তামাক চাষের সময় আত্মীয়রা বাড়িতে তামাকের কাজ করতে হবে বলে কেউ বেড়াতে আসে না। এরকমও আছে যে তামাক চাষী পরিবারে কেউ কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। তামাকের কাজে মেয়েকে কষ্ট করতে হবে সেজন্য। তামাক চাষীরা তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে এই চাষে বিনামূল্যেও শ্রমিক হিসেবে স্ত্রীকেও সম্পৃক্ত করে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকায় পারিবারিকভাবে নারীদের নানা রোগের সৃষ্টি হয় এবং চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং যার ফলে তারা অর্থনৈতিকসংকটের মধ্যে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাজমা খাতুন জানান, সাধারণত শিশুরা অনুসরণ করতে পছন্দ করে। তাই শৈশবে নিজ পরিবারে বাবা বা বড় ভাইকে ধুমপান করতে দেখে সেটা মনে গেথে যায়। ফলে বড় হয়ে সেও খেতে শুরু করে। আবার বিভিন্ন মিডিয়াতে ধুমপানের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখেও তা অনুসরণ করে। অনেকে কৌতুহলবশত: ধুমপান করে এবং পরবর্তীতে আর ছাড়তে পারে না। ধুমপান গ্রহণে কোন একটি কারণ থাকে না। দেখা যায় অনেকগুলো কারনের সমন্বয়েও হয়ে থাকে। তাই এই অভ্যাসের পরিবর্তন আনতে হলে মোটিভেশন দরকার। পরিবার থেকেই শুরু করা উচিত। অনেকসময় দেখা যায় শিক্ষক ক্লাসে ধুমপান বিরোধী কথা বলছেন কিন্তু তিনি নিজেই একজন ধুমপায়ী। ফলে এই ধরনরে অসামঞ্জস্যতাও দুর করতে হবে। আবার ধুমপানের উপকরণগুলো সহজলভ্য হওয়ায় এতে আসক্ত হওয়ার এটিও একটি কারণ। এটি কিনতে কোন বয়সের বাধ্যবাধকতা নেই।