মালেকা বেগমের জন্ম ১৯৪৪ সালে পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলায়। কুমিল্লা জেলার পা-ুঘর পোস্ট অফিসের কোড়েরপাড়া গ্রামে তার দাদাবাড়ি এবং একই জেলার নবীনগর থানার ভুবনঘর গ্রামে নানাবাড়ি। বাবা আবদুল আজিজ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের প্রথম নির্বাচিত ভিপি। তিনি ইংরেজির ছাত্র ছিলেন। দাদা, নানা-দু’বাড়িতেই প্রগতিশীল একটি চিন্তাবলয় ছিল। পুরান ঢাকার বিভিন্ন ¯’ান ঘিরে রয়েছে শৈশবের স্মৃতি । পুরান ঢাকার ওয়ারীতে মালেকা বেগম বেড়ে ওঠে। হিন্দু অধ্যুষিত একটি পরিবেশে তিনি বেড়ে ওঠেন। ফলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষা সে সময়েই লাভ করেন তিনি।
শৈশবেই ভাই-ভাবীর সূত্রে কমিউনিস্ট আবহে বেড়ে উঠেছেন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন গভীরভাবে। রোকেয়া হলের দু’বার ভিপি নির্বাচিত হন এবং ডাকসুতে নির্বাচিত হন কমনরুম সম্পাদ পদে। বাংলার এবং সমাজ বিজ্ঞান-দুটো বিষয়ে স্নাতকোত্তার ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। রোকেয়া হল, বাংলা বিভাগ ও ডাকসু আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিয়মিত পদাচারণা ছিল তাঁর।
ষাটের দশকে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। মালেকা বেগম বলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থ নয়, বরং ন্যায়ের চেতনা সামনে রেখে আমরা রাজনীতি করতাম। ছাত্র জীবন থেকেই কমিউনিস্ট আন্দোলন করতাম। কিš‘ নারী আন্দোলনে এতো গভীরভাবে যুক্ত হবো তা কখনে ভাবিনি।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ গঠিত হয়। সভাপতি ছিলেন সুফিয়া কামাল এবং সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি জীবনে আমি কমিউনিস্ট পার্ট করলেও মহিলা পরিষদ কখনো কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন ছিল না। সকল মতাদর্শের নারীদের সহ অব¯’ান ছিল মহিলা পরিষদে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেই সময় আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার, আন্দোলন গড়ে তুলি। ভারতের নারী আন্দোলনের নেত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সহায়তায় আমি, মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। মুক্তিযেুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম মহিলা পরিষদ থেকে।’
মালেকা বেগম শিক্ষকতা করছেন ঢাকাবিশ্ববিদ্যায়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগে। শিক্ষা জীবনের অনেক পরে ২০০৪ সালে তিনি পিএইচডি করেন। পিএইচডির বিষয় ছিল ‘যৌতুকের সামাজিক রূপ এবং বাংলার সাহিত্যে তার প্রতিফলন।’
দুইশ’ বছরের বাংলা সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের তত্ত্বাবধায়নে কাজ করেছেন মালেকা বেগম তার পিএইচডি গবেষণার জন্য। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে আজকের সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মে পণ প্রথার সামাজিক অভিঘাত কতো গভীর ও বীভৎস এর চিত্র উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন তিনি। যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী স্নেহলতা আত্মহত্যা করে ১৯১৪ সালে। এ হত্যাকা- নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে সে সময়। রবীন্দ্রনাথ তার ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘দেনা-পাওনা’য় লিখেছেন, ‘আজও যৌতুককে কেন্দ্র করে আত্মহুতির ঘটনা ঘটছে আমাদের সমাজে অহরহ’। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটি মেয়ের আত্মাহুতি কেবল একটি মেয়ের মৃত্যু নয়, তা গোটা পরিবার, সমাজ ও জাতির মৃত্যুর সমতুল্য। অনেক ক্ষেত্রে এ মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ও নেমে আসে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই ইতিবাচক। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে গণমাধ্যম যথেষ্ট তৎপর। তাদের এ ভূমিকা প্রশংসার দাবিদার।
মালেকা বেগম নরীদের পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে বলেন, ‘ হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পান না। এ কারণে তাদের মধ্যে যৌতুকের প্রথা থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। কিš‘ মুসলমান মেয়েরা পৈতৃক হিস্যা কিছুা হলেও (ভাইয়ের অর্ধেক) পা”েছন। তারপরও স্বামী কিংবা তার পরিবারের মধ্যে যৌতুকের মানসিকতা কেন- তা একটি বড় প্রশ্ন। মেয়েপক্ষ কতোটা দিয়েছে, কতো রকমভাবে সাজিয়ে দিয়েছে- এগুলো আলোচনা করে মেয়েপক্ষ যেমন আত্মতৃপ্তিতে ভোগে, ছেলেপক্ষের মধ্যেও একই প্রবণতা দেখা যায়। আসলে নারীকে নিয়ে এখনো কেনাবেচার ব্যবসা চলছে যৌতুক দেয়া-নেয়ার ব্যব¯’ায়। আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি, নারী অধিকারের ক্ষেত্রে কিছুটা গুণগত পরিবর্তন এসেছে। কিš‘ গোটা সমাজ কাঠামো ও নারীর প্রতি হীন দৃষ্টিভঙ্গি আজও বদলানো যায়নি। মেয়েদের এখনো বিয়ের পর জামাই বাড়ি চলে যেতে হয়। এছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা তার নেই। গায়েহলুদ, ঘটা করে বিয়ের আয়োজন এবং মেয়ে দেখার নানান রীতি মেয়ের ওপর চাপ ফেলে। ছেলেমেয়ে পরস্পর তাদের মনমানসিকতা যাচাই করে, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কথা বলে, জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন অন্যজনের কতোটা সহায়ক হবে-এসব তারা যাচাই করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমাদের সমাজে যৌতুক প্রবণতা টিকিয়ে রাখতে এবং মানুষকে না জেনে আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে বিয়ে হওয়াতে পেছনে মা-বাবার পরিবারের ভূমিকা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে শ্রেণীগতভাবে কে কতো উঁচুতে উঠতে পারলো তার প্রবণতা উৎকটভাবে চোখে পড়ে। অর্থাৎ কেউ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরকুলের আভিজাত্য প্রদর্শন করে নিজে উ”চ শ্রেণীতে উঠতে চায়, কেউ আবার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরকুলের আভিজাত্য আশ্রয় করে নিজের অব¯’ান উন্নত করতে চায়। দেখা যায় এক ধরনের পারিবারিক সংস্কৃতির মধ্যে একটি মেয়ের বড় হতে হয়। তার মূল্যবোধ সেভাবেই গড়ে ওঠে। কিš‘ যখনই বিয়ের পর মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি যায় তখন তাকে শ্বশুরবাড়ির ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি গ্রহণ করতে হয়। নিজস্ব জগৎ ধ্যান-ধারণা বিসর্জন দিয়ে নতুন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে গিয়ে একটি মেয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তা থেকেও অনেক বড় বড় সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
নারী সাহিত্যিকদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে ‘বেগম’ পত্রিকার ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন মালেকা বেগম।
নারী সাহিত্যকদের গল্পে আজ সমকামিতা, পরকীয়া, লিভ টুগেদার-এর বিষয় থাকছে। যৌন জীবন নিয়ে পুরুষ কোনো লেখা লিখলে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। কিš‘ নারী এমন বিষয় নিয়ে লিখলে প্রশ্ন দাঁড়ায়। কারণ তাদের প্রশ্ন, নারী কেন লিখবে এ বিষয়ে। বিষয় তো অনেক আছে, যৌনতা নিয়ে নারীকে লিখতে হবে কেন? নারীদের এ ধরনের সাহিত্যকর্মের বিরুদ্ধে শুধু মৌলবাদীরাই ঝাপিয়ে পড়ে না, সমাজের পুরুষ মানুষও এক্ষেত্রে অনেক সো”চার ভূমিকা পালন করে থাকে যা অনৈতিক। এ ধরনের প্রতিবাদে অনেক বুদ্ধিজীবী-সমালোচকের অংশগ্রহণ ও মানসিকতার যে পরিচয় মেলে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
মালেকা বেগম প্রসঙ্গক্রমে বলেন, তসলিমা নাসরিনের লেখায় সাহিত্যের গুণ আছে। ‘আমি তাকে সমর্থন করি। কারণ তার লেখায় নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। বিতর্কিত বিষয় তো পুরুষ সাহিত্যিকদের লেখায়ও থাকে। কিš‘ আঘাত পড়ে নারীর ওপর।
তিনি নারী পুরুষের বৈষম্যর কথা তুলতে গিয়ে বলেন, আমাদের সমাজে ছেলেরা জন্মেই স্বাধীন, মেয়েরা জন্মেই পরাধীন। নানান সংস্কারের বেড়াজালে মেয়েদের বাধা দি”েছ সমাজ, পরিবার, আইন, ব্যক্তি বিশেষ ও মৌলবাদী নীতিমালা। এই সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। এর জন্য যে অন্তরায় রয়েছে তা ভেঙে একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা আজ সময়ের দাবি।
মালেকা বেগম অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪১৮ পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরস্কারে আমি লজ্জিত থাকি। আমার কাজের জন্য, গবেষণার জন্য, আন্দোলনের জন্য নারী সমাজকেই পুরস্কার দিতে হয়। তারাই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। পুরস্কার অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে আনন্দ দেয়, তার কাজের প্রতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারের চেয়ে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, শাশুড়ি, ছেলেমেয়ে , বৌ-জামাই, নাতি-নাতনি এবং স্বামীর ভালোবাসা, স্বীকৃতি, সহযোগিতা অনেক বড় পুরস্কার। তাদের ভালোবাসা পেয়েছি বলেই আজ জীবনের এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। তা না হলে জীবন অন্য রকম হতে পারতো।