১.
নীতশে বলেছিল গড ইজ ডেড। মানে গডের কনসেপ্টটাই মরে গেছে। কিন্তু এক গড মরে গেলে আরেক গড চলে আসে। কখনো সে গড হয় চার্চ। কখনো রাষ্ট্র, কখনো কর্পোরেশন। সুপারম্যানের পরিনিতি হচ্ছে তাই অনেকটা মিথ অব সিসিফাসের মত।
-জেন রেসি
২.
অসীমের সংজ্ঞা বোঝাতে দার্শনিকদের বেশ কমন উদাহরন হলো অসীম সংখ্যক বান্দরের হাতে অসীম সংখ্যক টাইপ রাইটার ধরিয়ে দিলে অসীম সংখ্যক সময়ে তারা শেক্সপীয়ার, হোমারের মতো মহাকাব্য লিখে ফেলতে পারবে হুবহু।
এটা সঠিক কিনা তার প্রমানের জন্য ২০০৩ সালে পোর্টমাউথ ইউনিভার্সিটির মিডিয়াল্যাব তাদের ইউনি-গ্রান্ডের ২০০০ ডলার খরচা করে একটা পরীক্ষা করে যেখানে চিড়িয়াখানা থেকে একটা বান্দর এনে তার হাতে কীবোর্ড তুলে দেয়া হয়। সেই বান্দর পুরো পাচ পাতা টাইপ করে একটা ইংলিশ অক্ষর "এস"। না, সেটাতে কোনো হোমার ইলিয়াদের মহাকাব্যের লাইন বা শেক্সপীয়ারের কোনো থিয়েটার ছিলো না।
তবে গানিতিক ভাবে এর প্রয়োগ সর্বাগ্রে। সবচেয়ে বেশী আলোচিত প্রয়োগ হয় যখন এ্যাবিওজেনেসিস নিয়ে তর্ক আসে। আপনারা হয়তো জানেন যে কোষের ভেতর যে জিন আছে তাতে কয়েক কোটি প্রোটিন ব্লক আছে যেগুলো তৈরী হয়েছে অজৈব পদার্থ দিয়ে,সোজা বাংলায় মৌলিক পদার্থ বা ক্যামিকেলস দিয়ে। তো এই কয়েক কোটির বিন্যাস সমাবেশ বিক্রিয়ায় হুট করে কিভাবে একটা জীন কর্দমাক্ত মজাপুকুরে তৈরী হবে? এবং সেটা তৈরী হলেই হবে না, তার জন্য একটা নিউক্লিয়াস দরকার, সেই নিউক্লিয়াসের এটিপি মানে শক্তি যোগানের জন্য একটা মাইটোকন্ড্রিয়ার দরকার পড়ে।
প্রশ্নটা সেখানে নয়। এমন না যে আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে যে এ্যাবিওজেনেসিস সত্য। এটাকে জানার উদ্দেশ্য হলো যে বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিকভাবে এটাই আমাদের একটা পথ দেখাতে পারে সিন্থেটিক জীবন তৈরী করার ক্ষেত্রে এবং আমাদের বিবর্তনের প্রক্রিয়া কিভাবে সংঘটিত হয়েছে।
একজন সাধারন মানুষ সবকিছু শোনার পর যখন পূর্নিমা রাতে ভাবুক মনে গুন গুন করতে করতে আপনাকে জিজ্ঞেস করে,"এই যে আমি, আমি কিভাবে কেন এই সময়ে অবস্থান করছি? কেন আমি অতীতে বা ভবিষ্যতে জন্ম হলাম না? কেন আমি "আমিই" হলাম?"
সর্বপ্রথম আমাকে এই প্রশ্নটি করে ২০১৭ সালে বুয়েট পাশ এক আর্কিটেকচার। তার ফটোগ্রাফিক মেমোরী ছিলো তাই কোয়ান্টাম ফিজিক্স তিনি বেশ ভালোই বুঝেন। তাকে উত্তর দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমি আসলে তার প্রশ্নটাই বুঝিনি।
৩.
প্লেটোর ভাষায় বাস্তবতা হলো আমাদের ধারনার বাইরে থাকা বস্তুসমূহের একটা বিমূর্ত রূপ বা সামগ্রীকতা। ধরা যাক আপনি একটা ফল হাতে নিলেন। আপনি সেটাকে ছোট বেলা থেকেই আপেল বলে জেনে আসছেন। সেটা আপনার কাছে ফল হিসেবে একটি আপেল। যদিও সামগ্রীক থেকে চিন্তা করলে এটা শুধুই একটা ফল। কিন্তু আপনার কাছে এটি একটি আপেল। এর স্বাদ মিস্টি। খোসার রং লাল হলেও কামড় দিলে ভেতরের সাদা পাল্প পাবেন যেটার পরতে পরতে মিশে আছে মিস্টি রস। এই যে লাল রংটা আপনি দেখছেন কারন আপনার চোখের রেটিনায় যে ৬-৭ মিলিয়ন কন আছে তার কারনে। যারা প্রোটানোপিয়া বা কালার ব্লাইন্ডে ভুগছেন তাদের চোখের লাল রং দেখার জন্য যে কন গুলো থাকা দরকার সেগুলোতে সমস্যা। তাহলে তার কাছে লাল রং এর আর কোনো অর্থ বহন করবে না। তার কাছে দুনিয়ার সব আপেলই লালহীন। আবার জিহ্বার সামনের টেস্টবাডে সমস্যা থাকলে আপনি মিস্টি স্বাদটি অনুভব করতে পারবেন না(স্কুলে এক মজাদার স্মৃতি হলো ক্লাশ এইটে বায়োলজির এই চ্যাপ্টার পড়ানোর পর আমার এক বন্ধু আমাদের সবার সমানে তীব্র ঝালের বোম্বাই মরিচ খেয়ে ফেলেছিলো এবং সেটা খাবার পর পানি খাবার প্রয়োজন কোনো পড়েনি। তবে যখন পরীক্ষার জন্য বইটা পুরো পড়ি তখন বুঝেছিলাম ওকে যদি এরপর পানি খাওয়ানো যেতো তাহলেই কেল্লাফতে)।
তার মানে দেখা যাচ্ছে এই যে একটা ফলকে দেখলেই আপনি আপেল, বড়ই জাম, কাঠাল মনে করছেন এটা হলো আপনার মস্তিস্কের একটা প্রিডাফাইন্ড রেফারেন্স। ধরে নিন আপনি ছোটবেলা থেকেই শিখেছেন চিনির মতো স্বাদের সব কিছুই মিস্টি। রক্তের রং এর মতো সবকিছু লাল।
তাহলে এই যে আপনি আমি জামাল কামাল যদু মদু সবই আমরা রেফারেন্স হিসেবে ধরে নেই। এই যে টম ক্রজকে টম ক্রুজ বলে জানি কারন তাকে এ নামেই পরিচয় করানো হয়েছে। এখন কেউ যদি বলে মাপোথার ৪ আপনি জীবনেও চিন্তে পারবেন না।
কিন্তু এটা দিয়ে সত্বার বর্তমান অবস্থান ও হেতু বিচার করা যায়? সত্বার ডেফিনিশন কি? আপনার শরীরে যে আত্মা সেটাই বা কি?
আজকে বিদ্রোহী ভৃগু সাহেব আমাকে বললেন আমি কেন মৃত্যুকে ডরাই না? মৃত্যুর পর কি অপেক্ষা করছে সেটা নিয়ে কি আমি শংকিত নই?
এটা একটা ভালো প্রশ্ন তার চেয়ে বড় প্রশ্ন এই যে আপনি কেন আপনি এখন এই সময়ে এই স্থানে এবং কেন আপনার সত্বা মিলিয়ে "আপনি"ই হলেন?
এটা খুব সুন্দর একটা প্রশ্ন।
৪.
ব্লগের অনেকেই কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কারন এটা ঠিক বোধগম্য নয়। সেদিন দেখলাম কে যেনো বললো শ্রোয়েডিঙ্গার বলেছে যেহেতু বিড়াল মারা গেছে তার জন্য এই বাস্তবতা আবার অন্য বাস্তবতায় সে ঠিকই জীবিত। এটাই কোয়ান্টাম ফিজিক্স। কিন্তু বাস্তবতায় তা দেখি না, তাইলে কোয়ান্টাম ফিজিক্স ভূয়া।
আবার বলেন যে আমরা এরকম মহাবিশ্বে বাস করছি হতে পারে আরেকটা ইউনিভার্স আছে যেখানে আমরা হয়তো এরকম না হয়ে অন্য রকম হতাম, বা অন্য কিছু করতাম।
সবচেয়ে মজাদার প্রশ্ন ছিলো গোল জিনিস যদি আপনি সামনে থেকে দেখেন তাহলে যদি বাম ঘূর্নি মনে হয় তাহলে পেছন থেকে দেখলে একই জিনিস ডান ঘূর্নী মনে হবে। তাহলে কোয়ান্টাম ফিজিক্সে যে ঘূর্নী বা স্পিন সবই তো ভূয়া।
আপনার মধ্যেও এরকম সকম প্রশ্ন থাকতে পারে, তখন আপনি হয়তো ভাববেন সত্যিতো আসলে কোয়ান্টাম ফিজিক্স ভূয়া। আবার যাকে কনা বলছেন তারে পরক্ষনেই তরঙ্গ বলছেন। কেমনে কি!
বাদ দেন, মাথা গরম কইরেন না। চলেন কোথাও ঘুরতে যাই। ধরেন আপনার দেশের বাড়িতে যে পুকুর পাড় আছে অথবা আশুলিয়ার তুরাগ নদী, যাবেন? ভয় নেই আপনাকে চুবাবো না, আমি নিজেও সাতার জানি না।
নদীর পাড়ে আসুন একটু বসি, হাতে কিছু সুড়কি নিয়ে নদীতে ছুড়তে থাকি। দেখবেন সুন্দর ঢেউ সৃষ্টি করছে যেখানে সুড়কিটা পড়লো এবং ঢেউগুলো গোলাকার।
এখন আপনি একটু ঢিল ছোড়ায় বৈচিত্র্য আনলেন। কিছু খুটি ফাকা গেড়ে গোলাকার সৃষ্টি করলেন নদীর ভেতর। এখন ঐ গোলাকার অংশে একটা ঢিল ছুড়লেন। দেখুন ঢেউ গুলো একটু অন্যরকম প্যাটার্ন তৈরী করেছে।খুটি বরাবর সামনের দিকে কোনো উচু ঢেউ নেই কিন্তু দুটো খুটির মাঝখানে ফাকা বরাবর প্রথমে একটা, পরে সেটা থেকে দুটো এবং একটু পর চারটা এমন করে ছোট ছোট ঢেউয়ের সংখ্যা বাড়ছে।
এখন আপনি বাসায় ফিরুন। একটা টর্চ হাতে নিন। আপনারা সবাই জানেন যে আলো সরল পথে চলে। আর তাই আপনি ওয়ালে টর্চ মারলে ঐ ওয়ালেই পড়বে, জানালা দিয়ে ঘুরে ফিরে পাশের বাড়ির সুন্দরী জরিনার ওপর পড়বে না। এখন টর্চের আলোর সামনে একটা কার্ডবোর্ড রাখলে তার ছায়া ওয়ালে পড়বে। ছায়া অন্ধকার এবং আলোর এত ক্ষমতা নাই যে সে কার্ডবোর্ড ভেদ করে ওয়ালে আছড়া পড়বে। আলোহীনতার কারনে ছায়ার অংশটা অন্ধকার হবে। এটা সবাই জানে, এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নাই। এখন বাসার দুস্ট শিশুটি একটা সুই নিয়ে কার্ডবোর্ড ফুটো করে দিলো। তাহলে ওয়ালে দেখবেন ছায়ার মধ্যে একটা ফুটো পেয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে একটাই ফুটো পাবেন। কিন্তু শিশুটি ধারনাতিত দুস্ট হওয়ায় ঐ ফুটোর পাশে আরেকটা ফুটো করে দিলো। তো স্বভাবতই মনে হতে পারে ওয়ালে আপনি দুটো ফুটোই পাবেন।
কিন্তু না, তাকিয়ে দেখলেন অনেকগুলো ফুটো লাইন ধরে। মনে হতে পারে কোনো ম্যাজিক বা কিছু একটা ভুল বা ফুটো আরো কোথাও আছে। আপনি যেটা করলেন আরো কার্ড বোর্ড নিলেন এবং দুটো ফুটো করে বোর্ডে টর্চ মেরে দেখলেন ফোটার সংখ্যা টর্চের মাথা থেকে কার্ডবোর্ডের দূরত্বের সাথে বাড়ছে কমছে। এমনকি ফোটাগুলোর উজ্জলতাও। প্রশ্ন আসতে পারে আলো যদি এমন ঘুরায় ফেরায় যায় তাহলে ওয়াল ভেদ করে জরিনার কাছে যায় না কেন?
ঠিক এই জিনিসটাই তো ঢেউয়ের সাথে হয় নি?
তার মানে আলো আসলে কনিকা নয়, এগুলো একেকটা ঢেউ। তাহলে আমরা যে অমুক কনিকা সমুক কনিকা পাওয়া গেছে বলি এটা কি ভুল? না, সেগুলো আমরা গননার সুবিধার্থে বলি। আর কনিকা হলেও যে পিং পং বলের মতো টু টু করে ফাল পাড়বে সেটা না। প্রতিটা ঢেউয়ের চূড়া একটা বিন্দু এবং বিন্দু গুলোর আচরন অনেকটা পিং পং বলের মতো। তাই বলে আপনি বলতে পারবেন না এটা শুধু ফাল পাড়তেছে। পিং পং বল যেমন ডানে বায়ে ঘুরে, সামনে এগোয়, বাউন্স করে এই পয়েন্টগুলোও সেরকম করে। এবং আপনি যখন তাদের বিন্দু মনে করে হিসাব করেন তাহলে তখন আপনি বুঝতে পারবেন কিভাবে একটা কনিকা নির্দিস্ট অনেক জায়গাতে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরী তো সেটাই বলে। এই যে পুরা সার্বজনীন ক্ষেত্রে সেটা বিভিন্ন মৌলিক বল দ্বারা উত্তেজিত হয়, তখন তার চূড়া তো গোন যায়। সেই ঢেউগুলোর একটা দিক থাকে। ইলেক্ট্রন গুলো তার কক্ষে সর্বময় অবস্থান করে বলে একই সময়ে এর অবস্থান ও কৌনিক দূরত্ব নির্নয় করা সম্ভব না। হিসাব কি কিছু মেলে?
আর এজন্যই শ্রোয়েডিঙ্গার তার বিড়ালের থট এক্সপ্যারিমেন্ট দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন কেন এটা একই সময় জীবিত ও মৃত!
এতটুকু যদি বুঝতে পারেন, নিদেপক্ষে অনুধাবন করতে পারেন তাহলে আমার কথা শুনে রাখুন, আপনি এখন পুরো কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিজে বুঝে ক্লাস থ্রি এর একটা পিচকিকে সে বিষয়ে জ্ঞান দিতে পারবেন এরকম মজাদার এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে, দারুন তাই না?
চলবে....