১.
ঢাকাকে পৌরসভা ঘোষনা করা হয় ১৮৮৪ সালে। ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছে ছিলো একদিন এই অঞ্চল ব্রিটেনের মতো গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় নিজেদের ভাগ্যন্নয়ন করে উন্নত জাতীতে পরিনত হবে। টেকসই গনতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের বিকল্প নেই এই কথাটি একবিংশ শতকের কোনো রাস্ট্রবিজ্ঞানী অস্বীকার করতে পারেননা। তখনকার ব্রিটিশ প্রশাসন কর্তৃক মনোনীত কাউন্সিলরের তালিকায় যাদের নাম ছিলো তাদের নাম দেখলেও ভড়কে যেতে হয়: মোহিনী মোহন দাস, খাজা আমিরুল্লাহ, পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি, খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, রাধিকা মোহন বসাক প্রমূখ। ড. প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন জগন্নাথ কলেজের মনোবিজ্ঞানী। বাকি যারা ছিলেন তারাও কেও ব্যাংকার, আইনজীবি, বুদ্ধিজীবি মহলের কেউ যাদের দর্শন বর্তমান বাংলাদেশের কুলীন সমাজের মুখে উহু আহা সৃষ্টি করে।
নানা এক্সপেরিমেন্ট চলে দীর্ঘ ত্রিশ বছর। ১৯১৬ সালে ১৮ ই ডিসেম্বর ততকালীন বাংলার গভর্নরের ক্ষেদোক্তি ছিলো,"পৌরসভাগুলোতে ৩০ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা (এক্সপেরিমেন্ট) করে এখন আমরা হতাশাগ্রস্ত (ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্ট) হয়ে পড়েছি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নাগরিকেরা কোনো সুবিধা (অ্যাডভানটেজ) পাচ্ছেন না। নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা ব্যক্তিস্বার্থের (সেলফ-ইন্টারেস্ট) ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন।"
আজ ১০০ বছর পরও যখন দেখি স্থানীয় সরকার গুলো ডুবে আছে সীমাহীন দুর্নীতি ও তৈলবাজীতে তখন এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবি মহল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের জন্য শুধু ঘৃনারই সৃস্টি হয়।
২.
১৯৫১ সালের আগ পর্যন্ত একটা ধারনা ছিলো দুর্ভিক্ষের প্রধান কারন সামগ্রীক চাহিদার বিপরীতে খাদ্যের অভাব। পরবর্তিতে তারা দেখলেন দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না।
অমর্ত্য সেনের ভাষায়,সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ক্রিয়াশীল গণতন্ত্র ও শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে দুর্ভিক্ষ হয় না।
একটা সহজ উদাহরন দেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সরকার যখন খাদ্য সংগ্রহ করে গুদামে রাখতেন তখন পুরো বাংলাদেশকে কয়েকটা সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। এসব ময়মনসিংহের আশে পাশের জেলার জন্য ময়মনসিংহের খাদ্যগুহামকে কেন্দ্র হিসেবে ধরা হতো। ১৯৭৩ সালে যখন ভরপুর ফলনের পরও চালের দাম উর্ধ্বমুখী তখন সরকার এসব গোডাউন থেকে চাল ছাড়তে শুরু করে আশেপাশের এলাকায়। সমস্যা মিটে যেতো যদি সেকানকার স্থানীয় সরকার বা কৃষি অফিসারের কাছে সেই ইনফোরমেশন গুলো থাকতো। কিন্তু মধ্যসত্বভোগী দালাল ফড়িয়া, সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রনারোপ এবং অসময়ে বন্যা কারনে তার ব্যাঘাত ঘটে।
ধরা যাক কুস্টিয়ার গোডাউনে উদ্বৃত্ত চাল আছে। চট্টগ্রামে অনুদানের খাদ্য বন্দরে নামার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ময়মনসিংহের কেউ জানে না যে এত চাল পড়ে আছে ওসব এলাকায়। ফলে অর্থনীতির মৌলিক সুত্র ধরে সেখানকার স্থানীয় বাজারে চালের দাম আকাশ ছোয়া। তার মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী দালান এবং দলীয় নেতাকর্মীরা সে সুযোগ পূর্ন কাজে লাগায় মজুতদারী করে।
পরিনামে শুরু হয় ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্র জানে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কিন্তু স্থানীয় সরকারের চোর বাটপার এবং অযোগ্য আমলার সুবাদে তারা সে অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেয়নি। তখন একে একে প্রশাসনিক সিস্টেম ব্যার্থ হয় সেই দুর্ভিক্ষ এড়াতে। আর জন গন যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন স্বভাবতই অর্থনীতির চাকা থমকে দাড়াবে। সেক্ষেত্রে চীন আর সৌদী আরবের বদান্যতায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের পদ পাওয়া আটকে যায় এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের করুন অবস্থা জানানোর ক্ষমতাটা পর্যন্ত থাকে না।
বাকশালের নামে সরকার সংবাদপত্রগুলোর টুটি চেপে ধরলে তখন মানুষ বিশ্বাস শুরু করতে থাকে গুজবকে। যেটা আমরা এখন দেখি বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের ক্ষেত্রে। আমর্ত্য সেন এই কথাগুলোই তার বইতে খুব স্পস্ট ভাবে দেখিয়েছেন এবং দুর্ভিক্ষের প্রধান কারন ছিলো স্থানীর সরকারের দুর্নীতি, কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়ার্তুমি ও ব্যার্থতা।
একটা জিনিস আশ্চর্য্য লাগে ততকালীন সরকারের এসব যৌক্তিক সমালোচনা করাটা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কারন তিনি এখন জাতীর পিতা। তাহলে অমর্ত্য সেনকে কি জেলে ভরা হবে?সুত্র তার এই বই।
৩.
হেলেনিস্টিক সময়ের রাজা অরেলিয়াস মনে করতেন জীবনে উথ্থান পতন থাকবেই তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। বৈরাগ্যবাদ অনুসারে, এমন নয় যে পৃথিবীতে কখনো দুর্ভিক্ষ , জ্বরা, দুর্যোগ ঘটেনি। নির্দিস্ট সময় পর পর এসব বার বার ঘটেছে। আমরা সেগুলো পার করে আসছি। এখন যে দুর্যোগ ঘটছে, তাতে আমি যেমন কস্ট পাচ্ছি, আমার প্রতিবেশীও একই পরিমান কস্টে আছে। এমনকি দেশের আরেক কোনায় অমুক ব্যাক্তিও সেই কস্ট করছে। এই পরিনতি আমরা এড়াতে পারবো না। এখন যে জিনিসটা অবশ্যম্ভাবী সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা, ক্রোধ পাগলামী করলে নিজের মানসিক শারীরিক ক্ষতিই হবে।
অরেলিয়াস বৈরাগ্যবাদে এমন পরিস্থিতিতে মেডিটেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। আবার এটাও বলে মানুষের দোষ না ধরে নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরী করায় মনোযোগী হতে।
বৈরাগ্যবাদের আরেক দার্শনিক সেনেকা তার এক চিঠিতে সন্তান হারা মা কে এই কথা বলে সান্তনা দিয়েছিলেন, ধরুন আপনার সন্তান জীবিত এবং সে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বয়ঃসন্ধি প্রাপ্ত হলে। দেখা গেলো দেশের টানে ও পারিবারিক স্বচ্ছলতার জন্য যুদ্ধে নাম লেখালো এবং সেখানে গিয়ে হাত বা পা হারালো বা নির্মম আঘাতে ধুকতে ধুকতে মারা গেলো। বেচে থাকাটাই তার জন্য কস্টকর হয়ে যেতো। সুস্থ থাকলে যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, ক্ষেত্র বিশেষে সে নিমর্ম নিষ্ঠুর বা পাগল হয়ে যেতো। অথবা কোনো এক মহামারীর আক্রমনে সন্তানটি ধুকতে ধুকতে মারা গেলো তৃষ্ণার্ত পিপাষায় এবং সে মৃত্যু আরো বেদনাদায়ক হতো। অথবা কোনো দুর্ঘটনায় জীবন্ত আগুনে জ্বলে মারা গেলো। যদি তাও না হতো তাহলে এক দিন না একদিন তাকেও মৃত্যুবরন করতে হতো। যেটা অবশ্যাম্ভাবি সেটা দ্রুত ঘটে গেলে সেখানে আটকে গেলে কিভাবে হবে! বরংচ তাকে স্মরনীয় এবং তার স্মৃতিগুলো বহন করার জন্য আপনাকে বেচে থাকতে হবে। সে যেনো আপনার মাঝে বেচে থাকে সেই চেস্টা করতে হবে। আপনি নতুনভাবে জীবন শুরু করুন। যদি ঘর আলো করে নতুন কেউ আসে তাহলে তার মধ্যে আপনার সেই মৃত সন্তানের স্মৃতি ছড়িয়ে দিন। দেখবেন তখন জীবনের মানে দারুন ভাবে পাল্টাবে এবং আপনি মানসিক শান্তি পাবেন।
জীবনের অর্থ নিহিত আছে প্রজ্ঞায় এবং যুক্তিবোধে সেটা সম্রাট অরেলিয়াসের শিক্ষক যিনি কিনা একজন কালো দাস ছিলেন, এপিকটিটাস ছিলো যার নাম, তার কাছ থেকেই জানতে পারি। বৈরাগ্যবাদের এই তিন স্রস্টার বানীগুলো একবিংশ শতাব্দিতেও সমান ভাবে কার্যকর সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
৪.
নীশের জারাথুস্ত্রা ছিলেন সুপারম্যানের প্রতীক। আমরা হয়তো মনে করবো সুপার ম্যান মানেই ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন কেউ যার গতি হবে আলোর মতো, শক্তি হবে অসীম এবং দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে জগতে সব কালো অন্যায়। না, নিশের জারাথুস্ত্রা ছিলেন সাধারন একজন মানুষ যিনি কিনা দীর্ঘ ২২ বছর ধ্যান করে মানবিক সুপারম্যান হবার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেছিলেন। যদিও তার এই কথাটি শুনে বনের মাঝে নির্জনে বাস করা বৃদ্ধা বলেছিলেন এই চিন্তাধারা তাকে হাস্যরসের বস্তুতে পরিনত করবে। জারাথুস্ত্রা তাতে দমে যাননি।
শহরের কেন্দ্রে যখন সবাই দড়ির ওপর মানুষের হাটার কৌশল দেখে আবিভূত হচ্ছিলো, তখন তিনি এক কোনায় দাড়িয়ে জারাথুস্ত্রানামা শুরু করেন।
বিবর্তনের ধারা এখনো শেষ হয়নি। তবে এটা সত্য বর্তমান মানুষ পূর্ববর্তী মানুষের থেকে অনেক উন্নততর। নীশে জারাথুস্ত্রা অমনিবাস লেখার সময় ভেবেছিলেন সে এমন কিছু মানুষের রেফারেন্স ধরবেন যারা নিজেদের মোরালিটি এবং ভ্যালু নির্ধারনে স্বাধীন হবে। কে কি ভাবলো তা নিয়ে না ভেবে যেটা সঠিক এবং প্রজ্ঞাময় ও প্রভাবহীন তাই সে গ্রহন ও ধারন করবে। সুপার ম্যান নিজের কৌশলগত স্বার্থ বা ভ্যালুর জন্য শক্তির প্রয়োগে দ্বিধান্বিত হয় না, তার জারাথুস্ত্রা সেটা করবেন না। বরংচ সে নিজে কস্ট বরন করবেন। অন্যের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত না হয়ে খুশী হবেন, তার স হযোগী হবেন। শারীরিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হবার পর দুর্বলের প্রতি স হমর্মিতা এবং সহযোগিতার হাত বাড়াবেন। সেক্সের ক্ষেত্রে তিনি ক্ষানিক দুর্বল হবেন তবে তা শুধু মাত্র ভঙ্গিতে। নিজের রতিসুখের চাইতে মনোযোগী হবেন তার সঙ্গিনীর রতিসুখে। নিজের গুনে অহংকারী না হয়ে বরংচ সদাপ্রসন্ন থাকবেন এবং সমাজের উন্নয়নে নিজেকে মনোনিবেশ করবেন।
নীশের সুপারম্যান হবার লিস্টি ছিলো বেশ হাস্যকর। যিনি কিনা সবার প্রতি মনোযোগী, সমাজ সেবক, বৈরীতায় প্রজ্ঞার আশ্রয় নেবে। মানবসমাজের মুক্তি তিনি বিজ্ঞানে না খুজে বরং নিজের সংস্কৃতি এবং মহত্বর গুনাবলীর মাঝে খুজে নেবেন। জারাথুস্ত্রার এমন বানী শুনে সবাই হেসেছিলো, কেউ কেউ কৌতুক করছিলো কিন্তু যখন তিনি তার প্রভাব সম্পর্কে বর্ননা করলেন, সমাজে কি হতে পারে। সেটা দ্ব্যার্থহীন ভাবে উল্লেখ করলে দড়ি হাটা মানুষের কসরত থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকে ঘিরে ভীড় বাড়তে থাকলো।
আমাদের সমাজে এমন জরাস্থুস্ত্রা হয়তো আছেন। পিটার সিঙ্গারের উল্লেখিত দুর্যোগকালীন মোরালিটিতে তারা কাজ করছেন নীরবে।
কিন্তু সবকিছুই ভুল হয়ে যাবে যদিনা আমরা একটা শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করে কল্যানমূলক ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে পারি।
দুর্ভিক্ষ অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। আমরা কি এখনো শিক্ষা নেবো না?
সুত্র:
১) Thus Spoke Zarathustra - Friedrich Nietzsche
২) Famine, Affluence, and Morality - Peter Singe
৩) এক শ বছর পরেও পরিবর্তন নেই- সৈয়দ মকবুল হোসেন প্রথম আলো প্রকাশ কাল: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০