কফিন
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
মাঝ রাতে ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ, মানুষের পায়ের দুপদাপ আওয়াজ আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো কেরামত আলী মোল্লার। মনে হলো কয়েক জন শক্ত সমর্থ মানুষ অত্যাধিক ভারি কিছু বয়ে নিয়ে তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই বয়সের কারনে তার ঘুম কমে গেছে। খুটখাট শব্দ শুনলেই জেগে ওঠে। তার উপর ইদানিং এলাকায় চোরের আনাগোনা বেড়েছে। রাতের আঁধারে কারো হালের বলদ, কারো সিন্দুক, কারো বা আবার ঘটি-বাটি-হাড়ি-পাতিল চুরি হয়ে যাচ্ছে। তাই আর চুপ করে শুয়ে থাকতে পারলো না কেরামত আলী মোল্লা। পাশে শুয়ে থাকা বউকে গুঁতা দিয়ে বললো,
: সালেহা, ও সালেহা! হারিকেনটা দাও তো একটু। বাইরে কিসের যেন আওয়াজ, দেখে আসি!
প্রথমটাই কোন সাড়া না দিলেও কেরামত আলীর ডাকাডাকিতে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বললো,
: হারিকেন তো পায়ের কাছেই আছে! নিয়া যেখানে ইচ্ছা যান, আমারে এই মাঝ রাইতে ডাইকা তুলনের দরকার কি!
বউয়ের উত্তর শুনে মনে হলো এখনই দু’চার ঘা লাগিয়ে দেয়। এটা তার ৩য় বউ। বছরখানেক হলো বিয়ে করেছে। বয়স কম তাই দেমাগ একটু বেশী! প্রথমটা কলেরা হয়ে মরেছে, ২য় টা মরেছে গলায় দড়ি দিয়ে। তারপর বিয়ে করেছে সালেহাকে। তিন তিনটা বিয়ে করলেও কোন ছেলে মেয়ে নাই কেরামত আলী মোল্লার। এই নিয়ে তার দুঃখের সীমা নাই। শেষ বয়সে এসে এখন আর আগের মত গায়ে জোরও নাই। থাকলে সন্তানের মুখ দেখার জন্য হলেও আরেকটা বিয়ে করতো সে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে উঠানে গিয়ে দাঁড়ালো। চারদিক শুনশান নীরব, একটা ঝিঁঝিঁ পোকা পর্যন্ত ডাকছে না। একটু আগের শব্দ গুলোও আর শোনা যাচ্ছে না। উঠানের বাঁদিকের তেঁতুল গাছটার পাতা গুলো ঝির ঝির করে নড়ছে হালকা বাতাসে। গোয়াল ঘরে গরু গুলা ঠিকই আছে, তবে হাঁটু গেঁড়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে না জাবর কাটছে বোঝা যাচ্ছে না। রসুই ঘরটাও দেখে নিলো একবার, দুনিয়ার কাঁসার থালা বাসন যার যার জায়গাতেই আছে। শুধু হারিকেনের আলো পড়ে সামান্য চকচক করে উঠলো। আলো দেখে চুলার পাশ দিয়ে চিকচিক শব্দ তুলে দৌড় দিলো একটা ধাড়ী ছুঁচা। আশেপাশের পরিবেশে কোন অস্বাভাবিক কিছু নাই, তবে মানুষের পায়ের দুপদাপ আওয়াজ আর হাঁপানির শব্দ ভুল শোনেনি সে এটা নিশ্চিত। নাহ, ঘরে ফিরে আবার একটা ঘুম দেওয়া দরকার। সকালে উঠে দেখা যাবে ঘটনা কি। কিন্তু ঘরে ঢোকার আগ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে লম্বা লম্বা পায়ে উঠান পার হয়ে বাইরের ঘর লাগোয়া দরজার ঝাঁপটা খুলে পা বাড়ালো আবার। হারিকেনটা উচু করে ধরলো আশপাশটা ভালো করে দেখার জন্য, অমনি পায়ের কাছ থেকে হাত চারেক দূরে পড়ে থাকতে দেখলো একটা কাঠের কফিন। কফিনের ধারেপাশে কেউ নাই, শুধু শুধু একটা কফিন পড়ে আছে তার বাড়ির সামনে। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত ঠেকলো কেরামত আলীর কাছে। কফিনটার কাছে যেয়ে হাতের হারিকেনটা আরেকটু উচু করে ধরে দেখলো কফিনের চারপাশ খুব শক্ত করে পেরেক দিয়ে আটকানো। কি আছে কফিনের মধ্যে?
প্রশ্নটা মনে আসতেই নিজেকে গাল দিয়ে উঠলো কেরামত আলী মোল্লা। কি থাকবে আবার কফিনে? লাশ। কিন্তু কার লাশ? আর এত রাতে কেই বা এখানে এনে রাখলো? তার কোন আত্মীয়স্বজন মারা গেলে তো সে আগেই খবর পেত! আর তাছাড়া কোন কিছু না বলে একটা লাশ বাড়ির সামনে রেখে যাওয়া কেমন কথা! নাকি সে ভুল দেখছে ঘুমের ঘোরে! চোখটা ভালো করে রগড়ে নিয়ে হারিকেনের সলতেটা যতটুকু সম্ভব বাড়িয়ে দিলো। তার পর ভালো করে চারপাশটা দেখে নিশ্চিত হলো সত্যি কেউ নাই। মনের ভেতর অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো তার। মনে হলো এক ছুটে আবার বাড়ির ভেতর যেয়ে বউয়ের পাশে যেয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কফিনের ভেতর কার লাশ সেটা দেখার এক অদম্য কৌতূহলও জাগলো মনে। বেশ কিছুক্ষণ কফিনটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর সিদ্ধান্ত নিলো বাড়ির ভেতর যেয়ে সবাইকে জাগিয়ে তুলবে। বাড়িতে বউ ছাড়াও ২টা রাখাল আর এক ঝি আছে। রাখাল দুটা সেই সন্ধ্যা বেলায় ভাত খেয়ে ঘুম দেয় আবার ভোর বেলা গরু নিয়ে বের হয়। আবার উঠানে ফিরে যেয়ে বউ আর রাখাল দুটার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলো কেরামত আলী। কিন্তু কারো কোন সাড়াশব্দ নাই! মরন ঘুম ঘুমিয়েছে যেন! মানুষের চোখে এত ঘুম আসে কিভাবে ভেবে পায় না সে। ওর ডাকাডাকিতে গরু গুলা নড়ে চড়ে বসেছে কিন্তু মানুষের কোন পাত্তা নাই! বিরক্ত মনে চালায় গুঁজে রাখা শাবলটা নিয়ে আবার বাইরের দিকে পা বাড়ালো। এমন সময় বড় দুধেল গাইটা উঠে দাঁড়িয়ে বিকট শব্দে ডেকে উঠলো। আচমকা এরকম আওয়াজ শুনে প্রথমটাই ভয় পেলেও গরুর ডাক বুঝতে পেরে গোঁ ধরে বুকে এক গাদা থুতু ছিটিয়ে শাবল হাতে আবার রওনা হলো কফিনের উদ্দেশ্যে। একবার ভেবেছিলো যেয়ে দেখবে কফিনটা নাই, সবই তার মনের ভুল। কিন্তু না, যেখানে ছিলো সেখানেই পড়ে আছে কফিন।
এবার ভালো করে কফিনটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। পাতলা কড়ই কাঠে বানানো কফিন, এধরনের কফিন এর আগেও দেখেছে সে মেডিকেলের বাইরে “শেষ বিদায় ষ্টোর” নামের দোকানে। হাতের হারিকেনটা কফিনের উপরে পায়ের দিকে রেখে মনে মনে আয়াতুল কুরশি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে কফিনের গায়ে শাবল বসাতে শুরু করলো। কফিনের ডালাটা ঘন ঘন পেরেক মেরে এমন ভাবে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে প্রথমটাই মনে হলো খুলতে খুলতে ভোর হয়ে যাবে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র না কেরামত আলী মোল্লা। একটা একটা করে তুলতে লাগলো লম্বা লম্বা সব পেরেক। একেকটা পেরেক তুলে আর কেরামত আলীর উত্তেজনা বাড়ে! রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে হারিকেনের ঝাপসা আলোয় কেরামত আলী মোল্লার চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। একটা সময় সব গুলো পেরেক তোলা শেষ, এবার ঢাকনাটা সরানোর পালা। কি দেখবে নিজেও জানে না কেরামত আলী মোল্লা। তবে ভেতরে যাই থাক দেখতে তাকে হবেই!
বাম হাতে হারিকেনটা ধরে ডান হাত দিয়ে কফিনের ডালাটা হালকা একটু সরাতেই নাকে লাশ পচা তীব্র বোটকা গন্ধ লাগলো! আর পুরোপুরি ঢাকনা সরাতেই হতবাক হয়ে দেখলো আর কারো নয় এযে তারই লাশ! গলে পচে একাকার, মুখের পাশ দিয়ে কিলবিল করতে করতে একটা সাদা রঙের পোকা টুপ করে পড়ে গেলো কফিনের মেঝেতে! হঠাৎ লাশটা চোখ খুলে তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
"কেরামত, তুই বাইরে কি করছিস? তুই তো মরে গেছিস, ভেতরে আয়! মরা মানুষের এভাবে বাইরে থাকতে নাই! তুই পাপী, তুই শয়তান! তুই নিজ হাতে তোর ২য় বউকে মেরে তারপর গলায় দড়ির ফাস পরিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিস। একথা আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি! মৃত্যুর আগে মেয়েটা কি রকম ছটফট করছিলো মনে নাই তোর সে কথা? কি অপরাধ ছিলো তার? বাচ্চা হয় না? আরে বজ্জাত, মেডিকেলের ডাক্তারতো তোর প্রথম বউয়ের বেলাতেই বলেছিলো বাচ্চা হয় না তোর জন্য! তুই নপুংসক! প্রথম বউটা তো কলেরাই মরে বেঁচেছে, তাকেও কম নির্যাতন করিসনি! এখন শেষ বয়সে এসে আবার বিয়ে করেছিস! তুই তো মরে গেছিসরে হতভাগা! চলে আয়, কফিনের ভেতর চলে আয়! তোর বাইরে থাকা ঠিক না! দেখছিস না কি রকম গন্ধ ছড়াচ্ছে, পোকা হয়েছে! কেরামত আলী মোল্লা! ও কেরামত আলী মোল্লা! আয়, ভেতরে আয়...আয়!"
নিজের লাশের মুখে এধরনের কথা শুনে হারিকেন আর শাবল ফেলে দিকবিদিক শূন্য হয়ে দৌড় দিলো কেরামত আলী মোল্লা। ২ দিন পর গ্রামের পাশের বিলে কেরামত আলী মোল্লার ফুলে ফেঁপে ওঠা লাশ পাওয়া গেলো। লাশের গায়ে কিলবিল করছিলো সাদা সাদা পোকা! কাকতালীয় ভাবে সে লাশ কড়ই কাঠের কফিনে করে নিয়ে এনে রাখা হলো তার বাড়ির বাইরে, ঠিক যেভাবে কেরামত আলী সেই রাতে পড়ে থাকতে দেখেছিলো তার নিজের লাশের কফিন। পার্থক্য শুধু রাত আর দিন।
২২টি মন্তব্য ২১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
যৌবনে চারটি বিয়ে করা কি সুন্নাত?
আপনি যদি বিয়ে করে সুন্নাত পালন করতে হয় তাহলে তা আপনার প্রথম স্ত্রী যদি মারা যায় তা ও আপনার বয়স ৫০ এর অধিক হলে, তখন করতে পারবেন কারণ প্রথম স্ত্রী... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭২-এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ২০২৪-এর অর্জন না
৭২-এর রক্তস্নাত সংবিধান বাতিল করে । নিজেদের আদর্শের সংবিধান রচনা করতে চায় এরা‼️বাংলাদেশের পতাকা বদলে দিতে চায়! বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ভালো লাগেনা এদের!জাতিয় শ্লোগানে গায়ে ফোস্কা পরা প্রজন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আয়নাঘর শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল
নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আয়নাঘর শুধু ক্যান্টনমেন্টেই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল এমনকি ব্যক্তিগত বাড়িতেও ছিল। আপনারা শুধু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে.....
প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় এখন আর কেউ নিজের মতো হতে চাই না, হতে চাই বিশ্ববরেণ্যদের মতো। শিশুকাল থেকেই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সব ছাত্রদের মাথায় জিপিএ ৫, গোল্ডেন পেতে হবে! সবাইকেই ডাক্তার,... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এইচএমপিভি
করোনা মহামারির ৫ বছরের মাথায় নতুন একটি ভাইরাসের উত্থান ঘটেছে চীনে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নামের নতুন এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে দেশটিতে।চীনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে... ...বাকিটুকু পড়ুন