কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া লিখে যাওয়ার ভেতরে নির্ভার একটা ব্যাপার থাকে। প্লট গেঁথে তোলা কিংবা চরিত্রগুলিকে ধারাবাহিকতার ভেতরে রাখা- এইসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই।
কৈশোরেরে কথাগুলি লিখে যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য ছিল - লেখনীর এই তৃ[প্তিটুকু যেন নিতে পারি।
তবে, স্মৃতি থেকে কিছু মনে আনার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখছি- অনেক হালকা হয়ে আসা ঘটনা মনে পরছে।
৭৬ পর্যন্ত ঢাকার থাকাকালিন শহরের কোন স্মৃতি মনে নাই। বিচ্ছিন্ন কিছু ছবি- যেমন বর্ষায় ঝিল দালাঙ্গুলির ভেতরে চলে আসছে; রাস্তায় নৌকা মূল সড়ক পর্যন্ত লোক পাড়াপাড় করছে। রেললাইনের দুধারে পশরা নিয়ে দোকানীরা। আমার প্রথম প্লেনে চড়ার ঘটনা এই সময়েই- এর পর দীর্ঘ গ্যাপ দিয়ে আবার প্লেনে উঠতে পেরেছি ২১/২২ বয়সে।
পাখা লাগানো ডাকোটা প্লেন; দুই সারিতে।
পাঠকদের মনে আছে কিনা জানিনা- তখন প্লেনে সুগার কিঊব দিতো চা খাবার জন্যে। ছোট ছোট সাদা চারকোনা গুটির মতো। বরাবরই যেকোন খাবারের দিকে আমার টান। চিনির চারকোনা টুকরা বের করে সাথে সাথেই মুখে চালান করে দিয়েছিলাম। চা দিতে এসে এয়ার হোস্টেস আমাকে আর কিছু দিলোনা; খুব রাগ হয়েছিলো। সেটা সামলাতেই আম্মা আবার আমার কাপে আলাদা করে চা ঢেলে দিলেন। সেই প্লেন থেকে নেমে আবার আমরা বাসে উঠে বসেছিলাম নানা বাড়ি যাবো বলে। কালুর ঘাট ব্রীজের উপর দিয়ে যাবার ছবিটা চোখে ভাসে। কোন একটা কারণে সেতু পাড় হবার সময়- বাসের কাঠের জানাগুলি বন্ধ করে দিলো। কি জানি কেন! বাসগুলি ছিল - আশির দশকের রামপুরা টু সদরঘাটের 'মুড়ির টিনের' মতো।
ঢাকা থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রাম আসা হলো; কিন্তু বাসা তখনো ভাড়া করা হয়নি। কদমতলিতে আমার ফুপির বাসায় ( আমরা ডাকতাম 'আপ্পি' - এটা বার্মিজ ডাক) ঊনার বড় উঠান জুড়ে আমাদের নতুন কাঠের ফার্নিচার; সেগুলি ছিল আমাদের সারাদিনের খেলার জায়গা। সমবয়সী অনেক কাজিন থাকায় বেশ ভালোই হৈ চৈ করে কাটছিল। সেখানে থাকা হয়েছিলো সপ্তা দুই। এর ভেতরেই দূর্ঘটনা ঘটে গেল। পাড়ার এক ছেলে আমাকে ডেকে নিলো সাইকেল চড়াবে বলে। পেছনের ক্যারিয়ারে পা উঁচু করে বসেছি ঠিকই; কিন্তু কীভাবে যেন এক পা চলে গেল একেবারে চেইনের ভেতরে। সাইকেল এর চেইন গেঁথে ছিল আমার বাম গোড়ালির বাহিরের দিকটায়; রক্ত বন্ধ করার জন্যে তাড়াতাড়ি পাশের এক ডিসপেন্সারি থেকে বয়ান্ডেজ করিয়ে নিলো ছেলেটা। পরে বাসায় ফিরে আর একবার ডাকতারের কাছ এযেতে হয়েছিলো যদীও টিটেনাস আর নতুন করে ব্যান্ডেজ করার জন্যে। এর পর দীর্ঘ সময় সাইকেলের দিকে হাত বাড়াই নি। পরে ক্লাশ সেভেনে উঠে- বন্ধুর সাইকেল নিয়ে চালানো শিখেছিলাম।
এই ফাকে একটা কথা বলে রাখি। খুব ছোটবেলাতেই আমি ম্যাক্সিম গোর্কির তিন খন্ডের আত্মজীবনী পড়ে শেষ করেছিলাম। অসম্ভব মুগ্ধ করা লেখেনী, জীবনবোধ। আমার গল্পগুলি লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে- এই জিবনবোধের ব্যাপারটা কেমন জানি আনা যাচ্ছেই না। এটা কি পর্যবেক্ষণের অভাবের জন্যে, নাকি একসাথে অনেক কথা মনে করার চেষ্টা করছি দেখে হচ্ছে- বুঝতে পারছি না।
কিছু কিছু ঘটনা হুটহাট মনে পরে যায়। নানা বাড়ির সাথে তখন সম্পর্ক বেশী, কারণ দাদা-দাদী দুজনের কেউ বেঁচে নেই। নানুর বাড়ির পাশে একজনকে কাকে নাকি ভুতে ধরেছিল। ভুত তাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। আমরা বাচ্চারা সব দল বেঁধে দেখতে গেলাম। গোবরের পানি, পঁচা ডিম মিশিয়ে তাকে খাইয়ে দেয়া হলো। কেমন একটা বীভৎস গন্ধ! এখন বুঝি মেয়েটির হিস্টেরিয়া ছিল। সেটারই টোটকা চিকিৎসা করা হলো। পরে যখনই মেয়েটাকে দেখেছি- খুব ভালো করে লক্ষ করার চেষ্টা করতাম আগের কোন রেশ দেখা যায় কিনা।
১০ নং জামাল খান রোড।
এটাই হলো আমাদের ঠিকানা- একটা বড় উঠান ঘিরে তিনটা ঘর; দুটা দোতলা দালান আর একটা টিনের ঘর- যেখানে বাড়িওয়ালি থাকেন- অবাঙালী। বেশ বড় পরিবার তাদের। ৭৬ থেকে ৮১ পর্যন্ত এখানেই বেড়ে ওঠা। জায়গাটি এইতো কিছু দিন আগেও আগের মতোই ছিল; এখন সব বদলে গেছে। এই বাসা থেকেই আমার পড়ার হাতেখড়ি- শিশুবাগ স্কুলে।
মাকে ভর্তি করা হলো নার্সারিতে বছরের শেষ দিক তখন। ভর্তি পরীক্ষায় সাদা খাতা দিয়ে আসার কারণে আমাকে কেজিতে নেয়া হয়নি। পরে শুনেছিলাম- পশের বাচ্চাটা কিছু না পেরে কান্না করছিলো দেখে, আমি নাকি তার খাতার সব উত্তর লিখে দিয়েছিলাম -নিজেরটা খালি রেখে!
নার্সারীর একটা ঘটনাই মনে আছে। আমাদের বর্ণমালা লিখেতে দেয়া হয়েছিল। আমি চোখের পলকে লেখা শেষ করে, খট খট করে জুতার হিলের শব্দ তুলে আপার কাছে খাতা দিয়ে আসলাম। আপা একনজর খাতার দিকে তাকিয়ে বললেন- "এই ছেলে তো সব পারে! এ নার্সারিতে কেন?!"
তথাস্তু! আমাকে প্রমোশন দিয়ে কেজি ওয়ানে তুলে দেয়া হলো।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১২:৩৬