আমার ছেলেবেলা (গোপিবাগ পর্ব)
৬ ভাইবোনদের ভেতর একমাত্র আমার জন্ম গ্রামে। বাকিরা সব চট্টগ্রামের মেমন হাসপাতালে জন্ম নিলেও যুদ্ধের ডামাডোলে আম্মারা চলে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। আমার জন্ম হলো ধাই এর হাতে। বাসার ছেলেরা তখন সব জুমার নামাজ পরতে মসজিদে গেছে। গ্রামে গেলেই সেই ধাই এর সাথে আমার দেখা হতো আর সে এই কথাটা আমাকে সবসময় বলতো। এজন্যে বাসার সবাই আমাকে বলতো ‘গাইয়া’ । এইজন্যেই গ্রামের জন্যে আমার একটা আলাদা টান থেকে গেছে।
ছোট বেলার স্মৃতি খুব ভালোভাবে যেটা মনে আছে একেবারে দিনক্ষণ সহ- সেটা হলো অগাস্ট ২৯, ১৯৭৬ রোববার। ছুটির দিন – টিভির সকালের অধিবেশন চলছে- বাচ্চাদের পড়গ্রাম শুরু হবে একটু পর কিংবা শুরু হয়ে গেছে। আব্বা পত্রিকা পড়ছেন বিছানায় বসে- ছুটির দিনের যেটা তিনি করতেন। হঠাৎ টেলিভিশন এ একটি বিশেষ ঘোষনা বলে চলে আসলো সরকার কবিরুদ্দিন এর ছবি। উনি কবি নজরুল ইসলামের ম্ররত্যু সংবাদ দিতে দিতে কেঁদে ফেললেন। এরপর টিভিতে কবির নানা ছবি ভিডিও দেখাতে থাকলো। এই সময় আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম – কে এই লোক – কি হয়েছে- এই সব। আব্বা আমার সব প্রশ্নের নানা জবাব দিয়ে গেলেন।
কিন্তু তারও আগের বেশ কিছু ঘটনা মনে আছে। কিন্তু দিনক্ষন জানিনা। যেমন আমাদের বাসায় প্রথম যেদিন টিভি আসলো। আমার ফুপা আর আমাদের টিভি কেনা হলো একসাথে। ফুপারটা ২০” আমাদেরটা ১৭” (অথবা ২০”/২৪”) । তখন এন্টেনা ছাড়া ছবি ভালো আসতো না। ৫ তালার আমাদের এই বাসাটায় একটা টেরাস মতো ছিল। সেখানে দুই টিভি এক সাথে ছাড়া হলো। এন্টানা নাই দেখেই হয়তো কেমন নেগেটিভ ছবি আসতে শুরু করলো। ব্যাটম্যানের কার্টুন হচ্ছিল। একটা ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে ব্যাটম্যান নীচে নেমে আসছে রবিনকে নিয়ে- এই ছবিটা গাঁথা হয়ে থাকবে সারাজীবনের জন্যে।
এরও আরো আগের ঘটনা, তখন আমাদের টিভি ছিলনা। পাশের বাসায় ওরা টিভি দেখতে দিতোনা এই বাসার বাচ্চাদের- অর্থাৎ আমাদের। সিড়ির সাথে ভেন্টিলেটারের ফাকাগুলি ছিল বড় বড়; তারই ভেতর দিয়ে উঁকি মেরে যা দেখা যায়।
আরেকটা কথা মনে পরে- এটা কিছুটা রহস্যমাখা। হঠাৎ খুব গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল চারদিকে; আমি আব্বাকে জিজ্ঞাস করলাম-
“ আজকে মারামারি হচ্ছে? আজকে কাকে মারছে?”
আব্বা জবাব দিয়েছিলেন- “ না; আজকে বিজয় দিবস। মারছে না কাউকে, তোপধবনি হচ্ছে ।“
এঈ প্রশ্ন আর জবাবের অংশটুকু খুব পরিষ্কার ভাবে মনে আছে। এটা কি ৭৫এর ১৫ আগস্টের পরের ঘটনা? ১৫ আগস্টে কি তাহলে আমি কোন কিছু শুনেছিলাম? এটা বলতে পারছি না। আমাদের বাসা ছিল গোপিবাগে- মতিন সাহেবের ৫ তালা দালান। আশেপাশে এরকম দালান খুব একটা আর ছিলনা। সুতরাং শব্দ ধানমন্ডীতে হলেও এই পর্যন্ত আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু এটা ৪ বছর বয়সের স্মৃতি; তাই কিছুটা সন্দেহ থেকেই যায়। আরেকদিন খুব ঝড় হয়েছিল। টেরাস থেকে আসার পথে বাতাস প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায় যায় এমনটা অবস্থা।
ঢাকার এই বাসায় তোলা আমার দুটি ছবি ছিল- যদিও আমার কাছে নাই এখন। সেই দিনটার কথা মনে পড়ে। আপ্পু (ফুফা) আসলেন দুপুরের দিকে; কিন্তু বাসায় কেউ নাই। ওনার ছিল স্টুডিয়ো আর স্টিল ফিল্মের ব্যবসা।
উনি আমাকে দাড় করিয়ে, বসিয়ে কয়েকটা ছবি তুলনেন। একটা ছবিতে আমি বেগম পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ছি – মাথায় বাহারী টুপি –ফিটফাট বেশ – কিন্তু পত্রিকাটা উলটো করে ধরা; আমিতো পড়তেই শিখিনি তখনো।
একবছর খুব বন্যা হলো। গোপিবাগের একটু ভেতরেই ঝিল। সেই ঝিলের পানি তখন রাস্তায়। চারদিকে নৌকা চলা শুরু করলো। রেললাইন বরবার বাজার বসতো। আমাদের ছাদ থেকে সেই বাজার দেখা যেতো। আরো যখন ছোট ছিলাম- তখন ট্রেনের শব্দ পেলেই জানালার শিক ধরে আমি ঝুলে থাকতাম ট্রেন দেখবো বলে। এমনকী মাঝরাতেও; যদিও স্মৃতিতে নেই তা।
চার তালায় ছিল সময়বয়সী বন্ধু রাশেদ। রাশেদের বাবা ছেলে্কে অসম্ভব আদর করতেন। অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলের জন্যে ‘বচ্চু’ নিয়ে আসতেন। বচ্চু হলো কিছু একটা উপহার, বা খাবার- এই শব্দটা কোথা থেকে এসেছে আল্লাহ মালুম । দোতালায় থাকতো অবাঙালী পরিবার – পা্পন ছিল আমাদের বন্ধু। সমবয়সী দুই ভাই। আমি যদিও স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। কিন্তু একদিন কি কারণে যেন পাপনদের সাথে ওদের নার্সারি স্কুলে গেলাম। ক্লাশা টিচার আপা কি যেন জিজ্ঞেসও করেছিলেন আমাকে। ক্লাশ শুরুর একটু পরই দেখি পেছন থেকে ছেলেগুলি কাগজের প্লেন বানিয়ে ছুড়ে ছুড়ে মারছে।
পাপন ভালো বাংলা বলতে পারতো না। ঘুড়ির সুতা ছিড়ে দিলে রাগ করে বলতো – “আমার সূতা ভেঙ্গে দিলে কেন!”
মতিন সাহেবের অনেকগুলি ছেলেমেয়ে । ওরা একবার নীচে নাটকের আয়োজন করলো। সিরাজউদ্দৌলা হতে পারে। ওদের এক ছেলে বাচ্চু- একবার আমাকে দাওয়াত দিয়ে চড়ুই জবাই করে রান্না করে খাইয়েছিল! একেবারে আমাকে দাড়া করিয়ে চোখের সামনে চড়ুই জবাই দিল!
টেরাসটা ছিল আমাদের সবার প্রিয় খেলার জায়গা। ওখান থেকে উকি মেরে নীচে তাকিয়ে রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা দেখতে মজা লাগতো। এখানকারই এক বেকারীর মালিক ছিল- ইয়া চওড়া গর্দান; মোটা হওয়ায়, ছেলেকে কোলে নিতে পারতো না; ঘাড়ের উপর চড়িয়ে নিয়ে যেতো। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা; ছবিটা চোখে ভাসে।
পাশের বাসায় এক মহিলা ছিল; তাদের সব কিছুতেই বেশ নাক উঁচু। একদিন আমাদের বাসায় শুটকি রান্না হচ্ছিলো।
মহিলা গন্ধ শূঁকে নাক কুচকে বললেন- “ইয়া আল্লাহ! কি গন্ধ! এটা কিভাবে মানুষ খায়!”
আমার পিচ্চি মাথার ভেতর- কথাটা গেঁথে গেল। আমি জ্ঞানত কখনো আর শুটকী খাইনি- এখনো খাইনা!
আমার বড় ভাই বোনদেরকে পড়াতে আসতেন এক টিউটর। আমি তক্কে তক্কে থাকতাম উনি বের হবেন কখন; কারণ প্লেটে দু-একটা বিস্কিট থেকে যাবার সম্ভাবনা থাকতো প্রায়ই। সেটা আমার ভাগে। মাঝে মাঝে উনি ডাক দিয়ে আমার হাতে বিস্কিট দিতেন।
মতিন সাহেবের বাসা ছেড়ে আমরা চট্টগ্রামে আসি ৭৬ এ; সম্ভবত সেপ্টেমবরে। কারণ, অক্টোবরে ১০ তারিখে রানার জন্ম হয় চট্টগ্রামেই।
(অনেক দিন পর আবার এখানে লেখা শুরু করলাম। নিজের জন্যেই লিখে যাচ্ছি; কারও পড়তে ভাল লাগলে সেটা বাড়তি পাওয়া। )