মজনু ভেবেছিল একগাদা ক্রেডিট খরচ করে এলিয়েন কাউন্সিলের IALTS প্রিপারেশন কোর্স করার চাইতে, অল্প পয়সায় কিছু ডাটাবেজ কিনে নিয়ে আপলোড করে নেয়াই ভালো। সেভাবেই এগিয়েছিল সে। আপলোডের পর সেলফ টেস্টে 'সুপ্রীম' ব্যান্ডমার্কও করে ফেলে। কিন্তু পয়সা বাঁচাতে গিয়ে 'থট রিডিং মডিউলের পরীক্ষাগুলি আর দেয়নি।
গ্যাঁড়াকল লাগলো সেখানেই।
মূল ঘটনায় যাবার আগে IALTS পরীক্ষার ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। (আজকাল অনেক পৃথিবীবাসী গল্পপাঠকই সাধারণ জ্ঞান ডাটাবেজ লোড না করেই পাঠ শুরু করেন, এই প্যারাটা তাদের জন্য। এলিয়েন পাঠকদের এই অংশটুকু ক্লান্তিকর লাগতে পারে; আগে ভাগে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।)
২৫৬৮ সনের বর্তমান পৃথিবীতে সুযোগ সুবিধা একেবারেই কমে এসেছে। অন্যান্য গ্রহগুলোর তুলনায় জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী। মানুষ এখন মহাকাশ মাইগ্রেশনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে অনেকখানি। কিন্তু ইউনাইডের এলিয়েন নেশন (UAN) এটা খুব একটা উৎসাহিত করতে চায়নি। তাই, আন্তগ্রহ মাইগ্রেশনের হার আর মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই IALTS অর্থ্যাৎ Intergalatic Alien Language Test Standards পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বলা বাহুল্য ইংরেজী পৃথিবীবাসির মাতৃভাষা হলেও অন্যসব গ্রহে তা এখন প্রায়বিলুপ্ত। আন্তর্মহাজাগতিক ভাষা হলো 'অ্যালিঙ্গুয়েজ' । তাই চাকরী, পড়াশোনা, নাগরিকত্ব সবকিছুর মাপকাঠি হিসাবে এই IALTS পরীক্ষা। ন্যুনতম ব্যান্ডমার্ক অর্জন করতে না পারলে কোন পৃথিবীবাসীই চাকরী বাকরী তো দূরের কথা, এমনকি মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগই পায় না।
যেহেতু গ্যালাক্সির আধুনিক প্রচলিত যোগাযোগ রীতি মৌখিক ভাষা নির্ভর নয়, তাই IALTS ও সেভাবেই সেট করা হয়েছে। ছয় টা ভাগে পরীক্ষাটা নেয়া হয়।
স্বাদ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, শ্রুতি, দর্শন আর টেলিপ্যাথি। ন্যুনতম পারদর্শিতা দেখাতে পারলেই কেবল মিলবে ছাড়পত্র।
তা যা বলছিলাম।
মজনুর শুরুটাও ভালোই হচ্ছিল।
প্রায় গোটা বিশেক বিকট স্বাদের টেস্ট ম্যাটেরিয়াল রাখা ছিল। সে ১৬টা ঊদ্ধার করতে পারলো।
'ক্রি ক্রি ক্রি মাআআআআলা' গ্রহের 'তুরবিন' প্রাণীর ( পৃথিবীর হিসাবে মাকড়সা জাতীয় প্রাণী; যাদের কিনা সে গ্রহের আশরাফুল মাখলুকাত বলা জেতে পারে) যুদ্ধপ্রস্তুতির লালার স্বাদটা তাকে বিভ্রান্ত করে না দিলে সে হয়ত বাকি কটাও বের করে ফেলতে পারত! সে প্রথমে এটাকে 'ঝুলঝুলা' গ্যালাক্সির যাযাবর সরীসৃপদের বন্ধুত্বের উপহারের প্রতীক ' নাল্লাফ বিয়ার' হিসাবে ভেবেছিল। আসলে দুটোর স্বাদ ই কাছাকাছি ( অনেকটা পৃথিবীর বিলুপ্ত পশু গরুর বর্জ্যের মতো)
এরপর গেলো সে পরীক্ষা কক্ষ দুই এ।
ঢোকার সাথে সাথে মোটা মতো এক ছায়া তাকে জাপটে ধরে ফেললো। আগে থেকে প্রস্তুতি থাকার পরও মজনু আর্তচিৎকারটা প্রায় দিয়েই ফেলেছিল। কোনমতে আতংক কাটিয়ে উঠে, দ্রুত কুসুম কুসুম কোমল স্পর্শের মেন্টাল ডাটাবেজ ঘাটতে শুরু করলো। তথ্য পাবার সাথে সাথে সে বলতে শুরু করলো-
"জেন্ডারঃ নারী; গ্যালাক্সীঃ দিমিত্রি, বয়সঃ আর্থ ৩৯, সৌন্দর্য্য মাত্রাঃ ৭৩%"
একটা ক্লিক শব্দ হয়ে মুহুর্তে মুক্তি পেলো সে নাগপাশ থেকে। কিন্তু স্বস্তির শ্বাস ফেলার কোন সুযোগ ছিলনা। একটার পর একটা আলিঙ্গনে পরীক্ষা চালু থাকলো। দশটার কোটা পেরুতে তার খুব একটা বেগ পেতে হলনা। তবে 'স্বর্গিন' গ্রহের সবচেয়ে রহস্যময় প্রজাতি মেনকা রম্ভার আলিঙ্গন থেকে কেন যেন তার, বের হতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না । ডিসকোয়ালিফাইড হবার ভয় না থাকলে সে নিঃসন্দেহে আরো কিছুক্ষন জাপ্টে ধরে থাকতো।
এরপর ঘ্রাণের মডিউল।
এটা পার হওয়া অবশ্য পৃথিবীর মানুষদের জন্য খুব সহজ। পুরা গ্যালাক্সিতে সারমেয়র পর মানুষের ঘ্রাণকেই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ মানা হয়! সবকটা স্যাম্পলের ঠিকঠাক ডাটাবেজ লিংক করে, সে চলে আসলো শ্রুতি মডিউলে।
সাত/আটটা সাউন্ড স্যাম্পল ডাটা লিংক করতে করতে তার কান ঝিমঝিম শুরু হয়ে গেলো। নবমবারে যখন 'প্রুলাকাঙ্কান' গ্রহের 'চিচিহুয়া' জাতের জাতীয় সংগীতের তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেল, তখনই সে লিংক বন্ধ করে দিল। যথেস্ট নাম্বার তোলা হয়েছে এই মডিউলে; দুটো বাদ পড়লে ক্ষতি নেই, আগে জান বাচানো দরকার!
দৃষ্টিনির্ভর পরীক্ষাটা হলো খুব দ্রুত।
একটার পর একটা ছবি, হলোগ্রাফ, শ্যাডোগ্রাফ এর উপর মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে যেতে হলো তাকে।
ছোটবেলা থেকেই সে এসব ডাটা জেনে আসছে নানাভাবে। অনায়সেই উতড়ে গেলো এই অংশটুকুও। বলা চলে তার আত্মবিশ্বাস কিছুটা বেড়েই গেলো বরং। কিন্তু তখনো ঘুর্ণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেনি সর্বনাশটা যে এভাবে হয়ে যাবে!
থটরিডিংটা হলো সবচেয়ে আনপ্রেডিকটেবল মডিউল।
এখানে যে কোন টাস্ক করতে দেবে, কীভাবে করতে দেবে, তা অনুমান করা একেবারেই মুশকিল। পরীক্ষার্থীকে একটা আলোচনার প্রেক্ষাপটে নিয়ে যাওয়া হয়; যেখানে দুজন এলিয়েন তাদের পদ্ধতিতে বার্তা বিনিময় করতে থাকে। তাকে থটরিডিং পদ্ধতির মাধ্যমে পরীক্ষক রোবটের কাছে এই ডাটা প্রেরণ করতে হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে পৃথিবীবাসীদের এই মডিউলে খারাপ করার মূল কারণ হচ্ছে তাদের অতি ইমোশনাল কনটেন্ট বা ইকিউ জনিত দূর্বলতা!
মজনু সেই কথা মাথায় রেখেই যতোটা সম্ভব নিরাসক্ত অনুভুতি নিয়ে পরীক্ষা কক্ষে ঢুকে গেল।
তাকে জানিয়ে দেয়া হলো ভিনগ্রহী এক জুটি তাদের ভালবাসার অনুভুটিকে প্রকাশ করছে; সেটাই তাকে থটরিড করতে হবে। মজনু দ্রুত তার আপলোডেড ডাটা লিংক চেক করে নিল। একজন মেয়ে আর অন্যটি ছেলে। মেয়েটি আবার "ইয়ে এ, এ, এ, লেভু" (ঊচ্চারণটা বিরতী দিয়ে না করলে অশুদ্ধ ধরা হয়) গ্রহের বিউটি কন্টেস্ট বিজয়ী। মজনু মনে মনে প্রমাদ গুনলো; এই গ্রহটির কুখ্যাত হয়ে আছে বিপরীত মানসিকতার জন্য। ওখানটায় সব কিছুই পৃথিবীর ঠিক উলটো। তাই মিস 'ইয়ে.. লেভু'র দশাসই বীভৎস কায়া দেখে অবাক হলোনা মোটেও।
সে মনসংযোগ করার চেষ্টা করলো তাদের ভাবনায়।
তারা দুজনে জুটি বাঁধা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় মেতে ছিল। সেই ভাবনাজালের ডাটা গোছাতে গোছাতে অদ্ভুত এক বিষন্নতায় ডুবে যেতে থাকে মজনু। তার থটরিডিং এর জাল ভেদ করে জেগে ওঠতে চায় অন্য এক মুখচ্ছবি।
কতোদিন দেখা হয়না লাইলীর সাথে! মাইগ্রেশন যদি হয়ে যায়; আর দুজনের দেখা হবে কিনা কে জানে!
মজনুর মনসংযোগ বার বার ছুটে যেতে থাকে ভিনগ্রহী দুজনের অনুভুতির ডাটা চলাচলের সংযোগ থেকে। এলিয়েনজুটির আবেগের জালে সে নিজেকে কোনভাবেই সেট করতে পারেনা। কাঁচের রুমের বাইরে বসা পরীক্ষক রোবটটির দিকে সে তাকিয়ে থাকে অসহায় ভাবে। অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে রোবট টির পেছনে লাইলীর অবয়ব ভেসে উঠেছে। নির্ভরতার মৃদু হাসি দিয়ে সে যেন হাতছানি দিয়ে পিছু ডেকে চলছে মজনুকে!
রোবটটি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। ডাটা শীটে ক্রস চিহ্ন দিতে দিতে যান্ত্রিক ভাবনায় ডুবে গেলো সে- আবারো তবে আরো একজন হতভাগা আদমসন্তান ইভের মায়ার জাল ছিড়তে ব্যর্থ হলো!
এই ভাবনাটি থটরিড করতে অবশ্য মজনুর কোন সমস্যা হল না।