তিনি ছিলেন একজন খৃষ্টান ধর্ম প্রচারক। তাঁর জন্মভূমি ফ্রান্স। অনদিকে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসাদার। ইংলণ্ডের রাজনীতিবিদরা তাঁকে বিশেষ এক দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন ভারতে। দায়িত্বটি ছিল মুঘল দরবারের অন্দরমহলের খুঁটিনাটি সংগ্রহ করা। তিনি ঐ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ঐসব সংগ্রহ করা তথ্যকে কেন্দ্র করে অতথ্য, অসত্য, মিথ্যা মিশ্রিত করে সৃষ্টি করেছিলেন একটি ইতিহাসের। সেটাকে তাঁর ভ্রমণকাহিনী বলে চালানো হয়েছে, আর তা ইউরোপের প্রায় প্রত্যেক ভাষাতেই মুদ্রিত হয়েছে সগৌরবে। তাঁর জন্ম সাল ছিল ১৬০৫ আর মৃত্যু হয় ১৬৮৯ খৃষ্টাব্দে
ফ্রাসোঁ বার্নিয়ের (François Bernier)
এঁর বাড়ি ছিল ফ্রান্সের মঞ্জু প্রদেশের জই নামক স্থানে। জন্ম ১৬২০ খৃষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন চিকিৎসক। খুব ভালভাবে ডাক্তারি পাশ করার পর তাঁকে স্থায়ীভাবে কোন জায়গায় ডাক্তারি করতে না দিয়ে পর্যটকের ভূমিকায় সমগ্র ইউরোপ এবং মিশর, তুরস্ক, সিরিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশ ঘুরিয়ে ১৬৫৮ তে সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে পাঠানো হয় ভারতবর্ষে। মিঃ বার্নিয়ের বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও কার ইঙ্গিতে তিনি এতগুলো দেশ, বিশেষত মুসলিম দেশে পর্যটন করলেন এবং কেনই বা তিনি সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বে ভারতবর্ষে এলেন তার কারণ, আধুনিক গবেষকরা মনে করেন যে, ভারত আক্রমণ করলে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ভারতের পক্ষে থাকবে কি বিপক্ষে থাকবে অথবা থাকবে নিরপেক্ষ তা দেখার জন্যই ছিল তাঁর ঐ ভ্রমণকার্য। শাহজাহান ছিলেন ধার্মিক লোক। অতএব বিলেতি সুরা আর বিদেশি সুন্দরী দিয়ে তাঁকে যে মুগ্ধ করা যাবে না এটা বিলেতি রাজনীতিজ্ঞরা জানতেন ভালভাবে। ভাগ্য প্রসন্ন হোল। যে মুহূর্তের প্রতীক্ষা করছিলেন বার্নিয়ের, তা পেয়ে গেলেন তিনি। বাদশার জ্যোষ্ঠ পুত্র দারশিকো ছিলেন বিলাসী। আহমেদাবাদে রাজকুমার দারার সঙ্গে বার্নিয়ের দেখা করেন এবং তাঁর স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার গ্যারান্টি দেন। তাঁর চিকিৎসায় রাজকুমারের স্ত্রী কিছুটা সুস্থ বোধ করেন সেইজন্য প্রিন্স দারা তাকে পারিবারিক চিকিৎসক হিসাবে বরণ করে তাঁকে বিশেষ এক অনুমতিপত্র দেন যার বলে তিনি রাতে দিনে রুগী দেখার নাম করে দিল্লির রাজদরবারে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে যান অবাধে।সবচেয়ে মজার কথা, তিনি কোন পারিশ্রমিকই নিতেন না। তিনি নাকি ছিলেন নির্লোভ। তবে যে বিষয়ে লোভ ছিল সেটা হলো, রাজদরবারের বালক-বালিক থেকে প্রত্যেক মহিলার সঙ্গে চিকিৎসার নামে আলাপ করা এবং ভেতরের কথা বের করে নেয়া। দারাকে তিনি প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে সম্রাটের মৃত্যুর পর পরবর্তী সম্রাট হতে পারেন তিনিই। তাতে বার্নিয়ের স্বার্থ ছিল নতুন যুবক রাজাকে হাতে করে ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার। তাঁকে আকবরের অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। একটি নতুন ধর্ম তৈরি করতে আকবরের মত দারাশিকোও “মজমউল বাহরাইন” বলে যে বই লিখেছিলেন এবং হিন্দু ধর্মগ্রন্থ উপনিষদের যে অনুবাদ তিনি করেছিলেন অথবা করিয়েছিলেন সেসব ছিল বিলেতি মস্তিষ্কপ্রসূত কৌশল।
জব চার্নক [Job Charnock (c. 1630-1692)]
১৬৫৫-র পরে জব চার্নককে বিলেত থেকে পাঠানো হয় ভারতে। কাশিমবাজার কুঠির অধ্যক্ষ হন তিনি। নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ শুরু হলে কোন ইঙ্গিতে বা কোন পরিকল্পনায় তিনি কাশিমবাজার থেকে চলে এলেন ২৪পরগনার বরিশা। ওখানকার জমিদার ছিলেন সাবর্ণ চৌধুরী। জমিদারদের সঙ্গে বৃটিশদের আঁতাত কেমন ছিল সে আলোচনা পরে হবে। ঐ চৌধুরী মশাইয়ের কাছ থেকে ‘কালিকোঠা বা কালিঘাট, গোবিন্দপুর , সুতানুটি’ এত তিনটি গ্রাম তিনে নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন করেন তিনি। তখন আমাদের দেশের কেউ আঁচ করতে পারেননি যে এই কলকাতা একদিন হবে বৃটিশদের প্রধান ঘাঁটি- রাজধানী দিল্লি থেকে উঠে আসবে এই কলকাতাতেই। মুর্শিদাবাদের টাকশালও উঠে এসেছিল এখানেই। এই বিচক্ষণ ব্যক্তির মৃত্যু হয় ১৬৯২ খৃষ্টাব্দে।
মিস্টার ডুপ্লে (Joseph François Dupleix)
ভারতবর্ষ নামক মৌচাকটিতে শুধু ইংলণ্ডের মধুকরেরাই আসেননি, ফরাসী যে সব মধুকর এসেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম মিঃ ডুপ্লে। ১৬৯৭ এ তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দে। ১৭১৫-তে ভারতে এসে ১৭২০-তে পণ্ডিচেরি কাউন্সিলের সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ভারতে আরো প্রভাব ফেলতে তিনি প্রচণ্ড বাধা পেলেন ইংরেজ ক্লাইভ তথা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের জয় হয় আর খর্বিত হয় ফ্রান্সের প্রভাব।
মি: ক্লেভারিং (Clavering)
জন্মগ্রহণ করেন ১৭২২ খৃষ্টাব্দে এবং ১৭৭৭-তে হয় তাঁর পরলোকগমন। তিনি ছিলেন একজন সামরিক কর্মী। সারা বাংলার সৈন্য বিভাগটি যখন তাঁর দায়িত্বে ছিল তখন ছিল ১৭৭৪ সাল। তিনি ছিলেন মিঃ ওয়ারেন হেস্টিংসের মন্ত্রীসভার সদস্য। তাঁর সমস্ত মতামতে ক্লেভারিং একমত হতে পারতেন না। সুতরাং বাংলার এতবড় সামরিক নেতা হয়েও বাড়তি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। সেই কারণেই ‘স্যার’ ‘লর্ড’ ইত্যাদি চটকদার উপাধিও জোটেনি তাঁর ভাগ্যে
এদের চিনে রাখুন,একদিন এরাই আপনাদের ছিড়ে-খুঁড়ে খেয়েছিল (প্রথম পর্ব)