সকালে কাজে গিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়েছিলাম কিছু জটিল সমস্যার সমাধানে। আটটার দিকে সহকর্মী এক বাঙালী সহকর্মী এসে বললো - বেনজির মারা গেছে।
শুনার পর মনে হলো মেরুদন্ড দিয়ে একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষন লাগলো ধাতস্থ হতে। হাতের কাজ শেষ হতেই সহকর্মী এক পাকিস্থানীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম সে খবরটা জানে কিনা?
উত্তরে সে বল্লো, হ্যা জানে। তারপরই শুরু হলো আমার অবাক হবার পালা। তার মতে পুরো ঘটনার জন্যে বেনজির নিজেই দায়ী। কারন সরকার আগেই তাকে সতর্ক করেছিলো। বেনজির জিদ করেছে এবং ফল পেয়েছে।
আমার প্রশ্ন ছিল - তাইলে সরকার নিশ্চিত ভাবে জানতো "কে বা কাহারা" দল একজন পাকিস্থানী নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো না কেন? আর বেনজিরের জন্যে আরো বেশী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি কেন? এটাই কি সরকারের দায়িত্ব নয়?
পাকিস্থানী চুপচাপ থেকে বললো - ইউ আর রাইট। মানে আমেরিকা চায়না বেনজির ক্ষমতায় আসুক।
আমি বিতর্ক না করে বললাম - তুমি তো পাঞ্জাবী, তাইনা।
উত্তরে সে বললো - তুমি জানো কিভাবে?
কিছু না বলে কাজে মন দিলাম। বলতে পারতাম বিগত দশ বছরের এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যার উপসংহার হলো - পাকিস্থান ৬০ বছর যাবত এতটা দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে অবস্থান করলেও পাকিস্থানী জাতির কোন অস্থিত্ব নেই। আর জেনেছি - শুধু মাত্র একটা ধর্মীয় বন্ধন একটা জাতি তৈরী করতে পারে না। এই বিষয়ে পরে বলছি। তার আগে আরেক পাকিস্থানীর গল্প বলি।
দুপুরে লাঞ্চ রুমে ইচ্ছা করেই পাকিস্থানীদের মাঝে বসলাম। শুনার চেষ্টা করলাম ওরা কি বিষয়ে কথা বলছে। ওদের আলোচনায় ছিল - কানাডার বর্তমান আবহাওয়া আর নববর্ষে কাজের রুটিন।
চেষ্টা করলাম ভুট্টোর মৃত্যু নিয়ে আলাপ করি - কিন্তু দেখলাম বসে থাকা তিনজনের মধ্যে কেমন যেন একটু অসস্তির ভাব। একজন উঠে গেল পাশের টেবিলে বসার জন্যে। অন্য দুইজন কেমন দায়সারা ভাব দেখালো। পরে ওদের আলাদা ভাবে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি - টেবিলে বসা দুইজন ছিলো করাচীর - কিন্তু একজন সিন্ধ আরেকজন মোহাজের। অন্যজন পাঞ্জাবী। ওরা বিতর্ক করতে চাইছিলো না। তাই ভূট্টো বিষয়ক আলোচনা করেনি। বিশেষ করে সিন্ধি আর মোহাজেররা পাঞ্জাবীদের সামনে কোন মতামত প্রকাশ করে না। এটা আগেও দেখেছি। ওরা মোটামুটি ভয় পায়।
এখন কল্পনা করুন - বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটেছে - আর আমরা প্রবাসে বসে আলাপ করছি আবহাওয়া নিয়ে! অসম্ভব!
যাই হোক। আমরা যদি পাকিস্থানের ইতিহাসের দিকে একটু চোখ বুলাই - দেখবো পাকিস্থানের জন্ম হয়েছিলো "ধর্ম ভিত্তি" জাতির একটা রাষ্ট্র কাঠামোর লক্ষ্যে। বাংলাদেশের মানুষ দুই বছরের মধ্যেই টের পেয়ে যায় - সেটা ছিল কতো বড় ভুল। তেমনি বেলুচিস্থান, সিন্দ্ধ আর উজিরিস্থানের পাঠানরা
কি এই ৬০ বছরের টেয় পায়নি পাঞ্জাবীদের এই প্রতারনা? অবশ্যই পেরেছে?
তাই দেখছি - পাকিস্থানের সেনা শাসকগন সেনাশক্তি ব্যবহার করেই পাকিস্থান নামক একটা ভুখন্ডের ভিতরে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধরে রেখেছে। তারপর জন্ম লগ্ন থেকেই পাকিস্থানী সেনাবাহিনী ব্যবহূত হয়েছে ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসাবে। একসময় সোভিয়েত ব্লকে থাকা ভারতকে চাপে রাখার কাজে, পরে মুজাহেদীন তৈরীর কাজে পরে তালেবান আর আল-কায়েদা তৈরীর কাজে পাকিস্থানী সেনা বাহিনীকে ব্যবহূত হয়। বেলুচিস্থানে কসাই টিক্কা খান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের কসাই নিয়াজী পাকিস্থানের সেনাবাহিনীতে এবং দেশে সন্মানিত হয়েছে।
তাইলে সমস্যাটা কোথায়?
পৃথিবী যখন সামনে যাচ্ছে - পাকিস্থান স্থির হয়ে আছে ৬০ এর দশকে। এখনও পাকিস্থানে এখনও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চলছে। আর শহরে গড়ে উঠেছে পুজিঁর কেন্দ্র। যার নিয়ন্ত্রন মূলত সেনাবাহিনীর। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে যে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ভুমিকা গুরুত্বপূর্ন - তা পাকিস্থানে কখনও গড়ে উঠেনি। সেনাবাহিনী আর সামন্তপ্রভুরা মিলে মধ্যবিত্তের বিকাশ বন্ধ করেছে। এই জন্যে ওরা ব্যবহার করেছে ধর্মকে। তাই দেখি জুলফিকার আলি ভু্ট্টো - যিনি মূলত একজন সামন্তপ্রভু - একদিকে সেনাবাহিনীর সাথে বন্ধুত্ব করে ক্ষমতায় গেছেন আর নিজের ছেলে মেয়েদের পাঠিয়েছেন পশ্চিমে। আর কমিউনিস্ট নিধনের নামে সেনাবাহিনী ৬০ দশকে মধ্যবিত্তের উপর চরম আঘাত হেনেছে - যার চিহ্ন দেখা যাবে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্থানেও। ফলশ্রুতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বে ভুগছে একটা পুরো রাষ্ট্র কাঠামো। ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষদের ভিন্ন সংস্কৃতিরকে শ্রদ্ধার সাথে একসাথে রেখে একটা সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ার পরিবর্তে সেখানে ধর্মভিত্তিক একটা নতুন সংস্কৃতির প্রচলনের চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে সেই চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির প্রকৃত পক্ষে কোন পক্ষকেই নিজের মনে করছে না। তাই একটা সাধারন সংস্কৃতি হিসাবে ভারতের বোম্বের সিনেমা আর গান সবার মধ্যে একটা সাধারন সংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। সকল পাকিস্থানী এখানে এক।
আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য - শুরু থেকেই পাকিস্থানের সেনাবাহিনী তাদের গুরুত্ব বাড়ানো আর নিজেদেরকে দেশরক্ষার একমাত্র শক্তি প্রমানের মাধ্যমে দেশের মানুষের নজর সরিয়ে রাখার জন্যে কাশ্মির সমস্যাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে। সেটাও পাকিস্থানের স্থায়ী গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করেছে।
জন্মলগ্ন থেকেই পাঞ্জাবীদের আধিপত্য আর প্রভৃত্ব অন্য জাতিগোষ্ঠীকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রকাঠামো থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। নীচের তালিকা দেখলে বুঝা যাবে - পাকিস্থান একটা দেশ না হয়ে যদি একটা ফেডারেশন হিসাবে কাজ করতো তা হলে হয়তো একটা সুন্দর জীবন পেত পাকিস্থানের সকল সাধারন মানুষ।
পাঞ্জাবীঃ - ৪৫% ( এই পাঞ্জাবীরা শেষ দিন পর্যন্ত বৃটিশের সেবা করেছে আর পরে নিজেরা বৃটিশদের পরিত্যক্ত জুতায় পা ঢুকিয়ে পাকিস্থানের প্রভু হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে)
পাসতুনঃ ১৫%- (এদের মূলত পাকিস্থানী না আফগানী বলাই শ্রেয়। কারন এদের সংস্কৃতি পাঞ্জাবীদের চেয়ে আফগানের পাশতুনদের সাথে বেশী মিলে।)
সিন্ধিঃ ১৫% ( (এদের ভাষা আর সংস্কৃতি সম্পূর্ন আলাদা। জমিদারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই ষ্টীর সাথে পাঞ্জাবীদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব পাকিস্থানের রাজনীতির প্রধান সমস্যা।)
মোহাজেরঃ ৮% (এই গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিহারীদের মতোই। কিন্তু সংখ্যাধিক্য আর কেন্দ্রীভুত হয়ে এরা মোটামুটি করাচীর মতো একটা বড় শহর নিয়ন্ত্রন করে। প্রবাসী বেশীর ভাগ মোহাজেকে পাকিস্থানের চাইতে ভারতকেই তাদের দেশ হিসাবে পরিচয় দিতে বেশী স্বাচ্ছন্ধ্য বোধ করে। মোহাজেরদের আলাদা রাজনৈতিক দল আর ভিন্ন পরিচয় প্রমান করে যে পাকিস্থান ৬০ বছরেও অভিবাসী মুসলমানদের নিজেদের মতো করে নিতে পারেনি।)
বালুচঃ - ৪% ( এরা পাকিস্থানের জন্মলগ্ন থেকেই স্বায়ত্বশাসনের জন্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বালুচ নেতা আকবর আলি বুখতিকে হত্যা করে তাদের সংগ্রামকে কিছুটা স্তিমিত করেছে)
আফগান রেফিউজীঃ - ২০ লক্ষ ( যারা ৮০ দশক থেকে পাকিস্থানে বসবাস করছে এবং পাকিস্থানের রাজনীতি আর সামাজিক নিয়ামক হিসাবে গুরুত্পূর্ন ভূমিকায় আছে।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন কতগুলি জাতি গোষ্ঠীকে একটা দেশের মধ্যে রাখার জন্যে যে গনতান্ত্রিক পরিবেশ দরকার তাও পুরোপুরি ধংশ করে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেনাশাসন।
ফলশ্রুতিতে পাকিস্থান আজ একটা পরিপূর্ন ব্যর্থ রাষ্ট্র। ব্যর্থ রাজনৈতিক ভাবে, ব্যর্থ একটা দেশ হিসাবে গড়ে উঠতে- ব্যর্থ একটা জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে। তাই দেখি পাকিস্থানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আসীন ১৯ বছরের এক যুবক! বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে মোশাররফের বিকল্প হিসাবে ১৯ বছরের বিলওয়ালের কথা ভাবতে নিশ্চয় কষ্ট হবে!
তাইলে সমাধানটা কি?
একটা কথা সব জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য - নিজেকে সাহায্য করাই সর্বোচ্চ পন্থা। পাকিস্থানের জনগন আর সকল রাজনৈতিক দলের জন্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফাগুলো আবার পড়া উচিত। প্রত্যে জাতিগোষ্ঠীর জন্যে তাদের সীমানায় স্বায়ত্বশাসন দিয়ে একটা কনফেডারেশনের কথা ভাবা জরুরী। নতুবা প্রচুর হানাহানি আর রক্তপাতের পর কমপক্ষে চারটা দেশের জন্ম নেবে সেখানে - যারা ভারত-পাকিস্থানের রেশারেশি সম্পর্কের উত্তরাধিকারই বহন করবে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০০৮ ভোর ৪:২৫