উৎসর্গ
ফকির মজনু শাহ
ভবানী সন্ন্যাসী
জয় দূর্গা দেবী চৌধুরাণী
হরি আছেন পূর্বে, আল্লা আছেন পশ্চিমে, তুমি তোমার হৃদয় খুঁজে দেখ- করিম ও রাম উভয়েই আছেন হৃদয়ে; এ জগতের সমস্ত মানব-মানবীই তাঁর অংশ। _সন্ত কবীরের গান; তর্জমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর_
আহমদ ছফা তাঁর কোনো একটি রচনায় একবার লিখেছিলেন, বাংলাদেশে অনেকেই ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা বলতে বোঝে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করা। এতে যেই সমস্যাটা হয়, যখনই ফারাক্কা বাঁধ থেকে শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি ইস্যুতে এই উপমহাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আঞ্চলিক সহযোগী ভারত রাষ্ট্রের দখলদারিত্বের বিরোধিতা ন্যায়সঙ্গতভাবেই করা হয়, তখনই এর ভেতরে কেউ কেউ 'হিন্দুবিরোধিতা' দেখতে পান। এই যে ভারত রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের হিন্দুদের এক করে ফেলা, এর চর্চা শুধু বাঙালি মুসলমানের সাম্প্রদায়িক-রাজনীতিতে বিশ্বাসী অংশটিই করে না, সেক্যুলারিজমের ভেড়ার চামড়া গায়ে দেওয়া এক দল তথাকথিত প্রগতিশীলও করে থাকে।
১৯৭১এ সাড়ে নয় মাসের একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান নামের একটি চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসে পূর্ব বাংলা, বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জায়গা করে নেয় পৃথিবীর মানচিত্রে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সমর্থন দিয়েছিলো এ-কথা সত্য, ভারতের জনগণ-বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের জনগণ-নিঃস্বার্থভাবে আমাদের প্রায় এক কোটি মানুষকে যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন সেটার জন্যও আমরা তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো, ভারতের জনগণ আর ভারত রাষ্ট্র এক কথা নয়। ভারত রাষ্ট্র আমাদের সমর্থন দিয়েছিলো তার জিওপলিটিকাল ইন্টারেস্টে, এবং সেই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলনের তীব্রতা ছিলো তুঙ্গে এটা যদি আমরা মাথায় রাখি, তাহলে এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে কেন ভারত রাষ্ট্র চায়নি আমাদের মুক্তিসংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হোক। ভারত রাষ্ট্রের ভয় ছিলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে, তাহলে তার ঢেউ পশ্চিমবঙ্গেও লাগতে পারে। এবং মঈদুল হাসানের 'মূলধারা ৭১' বইটা যদি কেউ পড়েন, তাহলে দেখবেন মুক্তিবাহিনীর বাইরে ভারতের গোয়েন্দাসংস্থা Research and Analysis Wing (RAW)-এর সক্রিয় তত্ত্বাবধানে মুজিববাহিনী নামের যেই ফোর্সটি গড়ে তোলা হয়েছিলো এমনকি তাজউদ্দিন আহমেদেরও অজান্তে, তার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো আসলে কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের যতোটা সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা। ভয় ছিলো এই যে কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষত সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির যেসব সদস্য বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন পেয়ারাবাগানে, মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন যদি যুদ্ধটা দীর্ঘস্থায়ী হয়; এবং সেটা ভারত রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হবে।
যেসব মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন, তারা ১৬ ডিসেম্বরের পর ফিরে আসলেন বাংলাদেশে। এঁদের মধ্যে যাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাঁদের একটা আশা ছিল দীর্ঘ চব্বিশ বছরের সাম্প্রদায়িক নিপীড়ণ যা চূড়া স্পর্শ করেছিলো ১৯৭১এ তা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরা মুক্তি পাবেন। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম দূর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকহারে মণ্ডপে আক্রমণ চালানো, রক্ষীবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের হিন্দু সম্পত্তি দখল করার উল্লাস (এটা নিয়ে একটি করুণ গল্প লিখেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, গল্পের নামঃ দখল), পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধবংসকৃত রমনা কালীবাড়ি মন্দির পুনঃনির্মাণের অনুরোধ নিয়ে মন্দিরের সেবায়েতরা শেখ মুজিবের নিকটে গেলে শেখ মুজিবের 'জনপ্রিয়তা' হারানোর ভয়ে অনুরোধ অস্বীকার- ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবেই এই ইঙ্গিত দেয় যে বায়াত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাস্তবে হাওয়াই মিঠাই ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে 'বহুদলীয় গণতন্ত্রের' নামে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছিলেন। এবং সাম্প্রদায়িকতার চর্চায় আমাদের বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের সাথে জামাত ঘরানার ইসলামাবাদী দলগুলোর পার্থক্য যে কতো কম সেটা বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরও অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন নামের একটি জঘন্য সাম্প্রদায়িক আইনের বহাল থাকা। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শাসকশ্রেণী হিন্দু সম্প্রদায়ের চরম অবমাননা করার জন্য এই শত্রু সম্পত্তি আইন তৈরি করেছিলো। সেই আইন আজও বহাল তবিয়তে বহাল আছে।
যাই হোক, সাম্প্রদায়িকতার চর্চার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এক না, এদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে।
আওয়ামী লীগ ব্যবসা করে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যদি যে আকাঙ্খা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিলেন সেটা বোঝাই তাহলে সেই চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার জন্য সামান্য স্পেসও থাকার কথা না, কারণ পাকিস্তান নামের প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে লড়াই করেই তো অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। এখন আওয়ামী লীগ নিজে যতো সাম্প্রদায়িকই হোক না কেন-মনে রাখা দরকার পার্টিগতভাবে যে সে পাকিস্তানের মুসলিম লীগেরই মতাদর্শিক উত্তরাধিকারী তার প্রমাণ দুইদিন পরপরই আওয়ামী লীগ দেয়, বিশেষত নির্বাচন আসন্ন হলে আওয়ামী লীগ নিজেকে সাচ্চা মুসলমান প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, যার নমুনা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে-'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' নিয়ে ব্যবসা করার জন্যেই তাকে সময়ে সময়ে অসাম্প্রদায়িকতার ভেক ধরতে হয়। পার্টিগতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্যেই হোক আর জামাতের সাথে থাকতে থাকতে জামাতি হয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, বিএনপির পক্ষে যেভাবে বর্তমানে নির্বাচনের পরে জামাতের সাথে মিলে মন্দির ভাঙা আর হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করা সম্ভব হয়, আওয়ামী লীগের পক্ষে সেটা তার রাজনৈতিক প্রয়োজনেই সম্ভব হয় না।
এবং এই সেই কারণ যার জন্য জিম্মি হয়ে আছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা আওয়ামী লীগ নামের একটা চরম কপট আর বহুরূপী দলের কাছে। বিএনপি যদি একটা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী দল হত, তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য ব্যাপকসংখ্যায় বিএনপিকে ভোট দেওয়া কঠিন হত না, কারণ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য এমন কোনো মানবিক পরিবেশ কোনকালেই তৈরি করেনি সমাজে। কিন্তু বিএনপি সেটা না হওয়ার কারণেই একজন হিন্দু আওয়ামী লীগকে বাধ্য হয়েই সমর্থন করেন, কারণ এই দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক কোন দলকে তিনি পান না সমর্থন করার জন্য। একটা সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট দলগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য রিলিফের জায়গা ছিলো একটা। কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট রাজনীতি যে এখন ভয়াবহভাবে দুর্বল তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই একজন হিন্দু, যাঁর জমি কেড়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা, সেই দলকেই ভোট দেওয়া লাগে তাঁর। কি নির্মম পরিহাস!!!
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কতোটা নৃশংস হতে পারে তা দ্যাখা গেছে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে বিএনপি-জামাতের 'বিজয় উদযাপনে।' শত শত হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। শত শত হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
দৃশ্যটা কল্পনা করুন। একজন মা দেখতে পেলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের একদল বন্য শুয়োর বাড়িতে ঢুকে তার শিশুকন্যাটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি সেই শুয়োরদের নেতার পায়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে যাও, ওর এখনো রজঃস্রাব শুরু হয়নি...
আপনার ছোট বোনের সাথে যদি এটা হত, আপনি সহ্য করতে পারতেন? গুজরাতে সাম্প্রদায়িক হিন্দু দল বিজেপি যেই নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছে মুসলমান মেয়েদের ওপর তার সাথে এর কোনো পার্থক্য আছে? ইশরাত জাহানের সাথে আমি এই মেয়েটির কোনো ফারাক দেখি না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালি, মুসলমান আর পুরুষের পক্ষের রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ শুধু বাঙালির নয় শুধু মুসলমানের নয় শুধু পুরুষের নয়। এই সমাজ আদিবাসী বাঙালি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান আস্তিক নাস্তিকসংশয়ী পুরুষ নারী নপুংসক সকলের। বাংলাদেশ রাষ্ট্র লুটেরা-সন্ত্রাসী বড়লোকের পক্ষে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত শিল্পোদ্যোক্তা দেশপ্রেমিক বড়লোকের ওপরে। এই লুটেরা-সন্ত্রাসী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভেঙে ফেলা ছাড়া এই সমাজকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই। এবং এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস এতো অন্ধকারের মধ্যেও মানবিক সমাজ নির্মাণের খোয়াবনামাটাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি, খোয়াবটা আছে, থাকবেই।
দূর্গা মায়ের সন্তানদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জিওহিস্টোরিকাল কারণে বাঙালি মুসলমান, এবং অতীত ও বর্তমানের সাম্প্রদায়িক দলসমূহের উসকানিতে অসংখ্যবার ব্যবহৃত হওয়ার দুঃখজনক ইতিহাস থাকা সত্ত্বে এটাও সত্যি যে এই সম্প্রদায়ের মূল ঐতিহ্যটা ঐতিহাসিক কারণেই অসাম্প্রদায়িকতার। ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন যেই সূফীরা, সেই সূফীদের শান্তি ও ভালবাসাময় শিক্ষাই এর কারণ, এবং ইসলামের এই ধারাটাই বাংলার ইসলাম। 'আমাদের' বলতে আমি প্রধানত এই বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিই ইঙ্গিত করছি, কারণ যে সংখ্যায় বেশি তার দায়িত্বও বেশি, তবে সকল ধর্ম-জাতি-লিঙ্গের মানুষেরই উচিত দূর্গা মায়ের সন্তানদের পাশে দাঁড়ানো।
সামনে নির্বাচনই হোক আর ১/১১এর মতোন কোনো প্রতিবিপ্লবী সরকারই আসুক, যাই ঘটুক না কেন, একটি হিন্দু মন্দিরের গায়েও যেন আঁচ না লাগে। আমাদের একটি হিন্দু বোনের গায়েও যাতে হাত না পড়ে কোনো সাম্প্রদায়িক শুয়োরের। তবে এ কেবলই প্রতিরোধের জন্য সংগঠিত হওয়া, এই রাষ্ট্র ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত কারো জন্যই মানবিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তাই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি কমিউনিস্ট রাজনীতির শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিকল্প নাই।
উপমহাদেশের 'মূলধারার' রাজনীতিতে হিন্দুয়ানি সাম্প্রদায়িকতা আর ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের যেই চারা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ লাগিয়ে দিয়ে গেছে, তা আজ পরিণত হয়েছে বিরাট মহীরুহে, এবং জ্বালিয়ে মারছে এই এলাকার প্রায় সকল দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকেই। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিএনপি কেউই দূর্গা মায়ের সন্তানদের সত্যিকারের সহমর্মী হবে না কোনোদিনও, তারা মৃত হিন্দুর লাশ নিয়ে ব্যবসা করবে, আর জীবিত হিন্দুকে জিম্মি করে ক্ষমতায় থাকবে/যাবে। তাই আমাদেরকেই সহমর্মী হতে হবে।
মা অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে আছেন, তাঁর সন্তানদের পাশে আমরা কি দাঁড়াবো না, দাঁড়াবো না?
জুন ২০, ২০১৩
জিগাতলা, ঢাকা।