'আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবেশ।' পরীক্ষায় ১ নম্বর পাওয়ার জন্য সামাজিক বিজ্ঞানের এই সংগা ছোটবেলায় আমরা সবাই মুখস্ত করেছি।কিন্তু কি আছে আমাদের চারপাশে?
নদী-নালা,খাল-বিল,গাছ-পালা,ব্রীজ,পাহাড়,দোকান,স্কুল,কলেজ,গরু-ছাগল,ভূত-পেত্নি___ইত্যাদি ইত্যাদি। এর বাইরে কি কিছু নেই? পৃথিবী নামক গ্রহের পরিবেশটার চিত্র এরকমই। কিন্তু পৃথিবীর বাইরের জগত্,পরিবেশ চেনার আগ্রহ আদিম কাল থেকেই মানুষ চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। এই চিন্তা-চেতনা থেকেই হোমো সেপিয়েন্স পরিচিত হয় 'মহাবিশ্ব' শব্দটার সাথে। কিন্তু তখন আমরা মহাবিশ্বকে চিনতাম না। মাহাবিশ্ব সম্পর্কে এখন আমরা যেটুকু জানি,সেটুকু জানতে আপেক্ষিক তত্ত্ব,কেন্দ্রিক পদার্থবিজ্ঞান,কণা পদার্থবিজ্ঞান,তাপগতিবিজ্ঞান,প্লাজমা ইত্যাদি এবং সর্বোপরি জ্যোর্তিপদার্থবিজ্ঞানের পেছনে কাছা মেরে ছুটতে হয়েছে। মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা করতে গেলেই প্রথম যে প্রশ্নটা মাথায় আসে তা হলো,এই মহাবিশ্ব এলো কোথা থেকে? কিকরে হলো এর উত্পত্তি? কবেই বা হলো?
বহুপ্রাচীন গ্রিক,রোমান ও ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ইহুদি,খ্রিস্টান,ইসলাম তিনটি আব্রাহামিক ধর্মমতে মহাবিশ্বের উত্পত্তি ঘটেছিল খুব নিকট অতীতে। সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশপ উসার (Bishop Ussher) হিসাব করে বলেছিলেন মহাবিশ্বের উত্পত্তি ঘটেছিল ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। তিনি এই হিসাব বের করেছিলেন মজার একটা প্রক্রিয়ায়। বিশপ ওল্ড টেস্টামেন্টের মানুষদের বয়স যোগ করে এই হিসাব পেয়েছিলেন। উনি ধারণা করেছিলেন মহাবিশ্ব ও মানুষ একই সাথে উত্পত্তি লাভ করেছিল। দর্শনতত্ত্বের কারণে এই ধারণা বহুআগেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সহ তত্কালীন (এরিস্টটলের আগে ও পরে) কিছু দার্শনিক ধারণা দিয়েছিলেন মহাবিশ্বের উত্পত্তি ঘটেছে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে এবং মহাবিশ্ব ও মানুষ সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে। অবশ্য তখনও বেশ কিছু ধর্মের প্রচলন ছিল। তবে দার্শনিকগণ একটি গূঢ় বাক্য ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।তা হলো, মহাবিশ্বকে না জানতে পারলে এটি কবে,কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা জানা অসম্ভব। এই মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্সটা আসলে কি?
সহজ ভাষায় উত্তর-যা বিদ্যমান তার সমষ্টিই হলো মহাবিশ্ব। পরিবেশের উপাদান থেকে এবার চিন্তাধারা প্রমোশন পেল,এসে দাড়াল মহাবিশ্বের উপাদানে। দার্শনিকগণ ঢক ঢক করে পানি পান করার মতই মহাবিশ্বের উপাদান সম্পর্কে ধারণা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ধারণাগুলো রিমিক্স করলে অনেকটা এরকম দাড়ায়-'পৃথিবী মহাবিশ্বের একটা অংশ। শুধু পৃথিবী নয়,চাঁদ,তারা,সূর্য সবই মহাবিশ্বের অংশ।'
তত্কালীন ক্ষুদ্র সূর্যপূজারী গোষ্ঠী হিলিয়াম বেলুনের মত ফুলে ফেপে ওঠে এ তত্ত্বে,বিরোধিতাও চলে তাল মেপে। সৌরজগত্ এর ধারণাও ছিল বিরোধিতার কেন্দ্রে। সূর্যকে তারা জ্বলন্ত গ্যাসের বল হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না। যদিও তার সংখ্যালঘু ছিল। বাকি সমাজে উক্ত ধারণাগুলো জোয়ারের মত বয়ে চলছিল। লোকদের মূল আলোচনা আর জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছিল বিস্ময়কর এই মহাবিশ্ব।
বৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশ,প্রমাণসহ মহাবিশ্বের সার্জারি শুরু হয় স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত (theory of general relativity) প্রণয়নের পর।১৯১৬ সালে। মহাকর্ষকে স্থানকালের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যায় আপেক্ষিক তত্ত্বে। স্যার আইজ্যাক নিউটন এই জিনিসটা খেয়াল করেন নি যে, মহাকর্ষ তত্ত্ব মহাবিশ্বের উত্পত্তি সম্পর্কিত কৌতুহল ধারণ করে আছে। আসলে নিউটন স্যার তার অনেক কাজকর্মের মাহাত্মগুলা ঠিক ঠাক বুঝত না বা বোঝার চেষ্টা করত না। হ্যালি কিন্তু এই ব্যাপারগুলোতে নিউটনকে সাহায্য করত। যে হ্যালিকে আমরা ধূমকেতুর পরিচায়ক হিসেবে জানি ও সম্মান করি। অসাধারণ কৌতুহলি এই হ্যালি বন্ধুর মত নিউটনের পাশে ছিলেন সেসময়। যাই হোক,নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের সকল বস্তুকণাই পরষ্পরকে আকর্ষণ করে। এখন সমস্যা হলো,এই আকর্ষনের জন্য তো সব বস্তুরই এক যায়গায় মিশে যাওয়ার কথা। আর গ্রহগুলো কেন সম্পূর্ণ বৃত্তাকার পথে না ঘোরে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে তাও একটা প্রশ্ন ছিল। নিউটন এরও উত্তর জানিয়ে গেছেন।
'আকর্ষন মান দূরত্বের ব্যাস্তানুপাতে ক্রিয়া করে।' কিন্তু তবুও, মহাকর্ষের প্রভাবে মহাবিশ্ব কখনও চিরস্থায়ী থাকতে পারে না।
এবার মহাবিশ্ব সম্পর্কিত চিন্তাধারায় সাইক্লোন তৈরি করেন এডউইন হাবল (Edwin Hubble)। ১৯২৯ সালে তিনি আবিষ্কার করেন যে মহাবিশ্ব স্থির না। এটির প্রসারণ ঘটে চলছে। সব ধারণা,তত্ত্বের মোড় ঘুড়িয়ে দেয় এই আবিষ্কার।
এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বৃহত্ বিস্ফোরণ তত্ত্ব বা big bang theory । বিগ ব্যাংগ থিওরি বলে,-'আজ থেকে ১৫০০-২০০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সকল বস্তুই একটা কেন্দ্রে পূঞ্জিভূত ছিল। যার আকার অনেকটা ডিমের মত ছিল। এর ডিমের ভেতর চলত প্রচুর চাপ,প্রচুর তাপ,সীমাহীন এনার্জির লড়াই। ডিমটার তা আর সহ্য হয় না। বিশাল এক বিস্ফোরণ ঘটে ডিমটির। আজকের গ্রহ,নক্ষত্রসহ সকল পদার্থ,স্থান,কাল ও শক্তি সবকিছুই এই বিস্ফোরন থেকে উত্পত্তি লাভ করে।'
আর এগুলো প্রতিনিয়ত দূরে সরতে থাকে পরষ্পরের কাছ থেকে। প্রতিটি বস্তুকণাই একটা নির্দিষ্ট হারে,নির্দিষ্ট বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে সরতে সরতে এগুলো একসময় এমন এক অবস্থায় পৌঁছাবে, যা হবে এদের শেষ সীমা। এদের দূরে সরে যাবার গতি এদের দূরত্বের সমানুপাতে পরিবর্তিত হয়। অর্থাত্, যার দূরত্ব যত বেশী, তার পরষ্পর থেকে দূরে সরে যাবার গতিবেগও তত বেশি।
সালটা ১৯৬৫। আর্নো পেনজিয়াস (Arno Penzias) ও রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) নিউজার্সির বেল টেলিফোন ল্যাবে একটি মাইক্রোওয়েভ এন্টেনা দিয়ে একটা অদ্ভুদ তরঙ্গ ডিটেক্ট করেন। তারা বলেন,'এটি মহাবিস্ফোরনের ফলে আলোক তরঙ্গ সরে গিয়ে লাল রংয়ের তরঙ্গসীমা পেরিয়ে মাইক্রোওয়েভে পরিণত হয়েছে।'
তারা তাদের এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পায়।।।
______________________________________________
চালিয়ে যাবার ইচ্ছা আছে। লেখায় কোন ভুল-ত্রুটি থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩২