দুপুর তার কাছে হয় কলেজিয়েটের মাঠ না হয় রেলওয়ে কলোনির কোনো এক গাছের নিচে অবিশ্রান্ত আড্ডা, আরো পরে প্যারেডের কোনায় তুমুল গল্প বা ক্যাফে জয়নগরে সিঙারা চা।
বিকেল মনে হলেই তার মনে আসে টাইগারপাসের বড় মাঠটি ধরে সূর্যের কোনাকুনি পড়ন্ত আলোয় হেঁটে আসা ছোট্ট ছেলেটি , কুউউঝিকঝিক ডাক দিয়ে সামনের লাল জংশান ফেলে ট্রেন চলে যায় স্টেশানের দিকে না হয় পাহাড়তলীর দিকে। কলেজিয়েটের বিশাল মাঠটিতে দাপাদাপি করেও কেটে গেছে অনেক বিকেল। আরো পরে চকবাজারের গুলজার বা জয়নগরের মোড়ে আশা-হতাশা আনন্দ আক্ষেপ উচ্ছাস বেদনার অনেক বিকেল গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছিলো...
কলেজিয়েটের দেয়ালের পাশে সন্ধ্যায় হেঁটে আসতে আসতে আসতেই প্রথম অনুরাগের অনুরনন ছেলেটির মনে, (আইস ফ্যাক্টরি রোডের ভৌতিক আবছায়ায় দীঘল কদমে আমরা হেঁটে গিয়েছি আমার বা আমাদের নিঃসংগ উৎকল্পনার ভেতর দিয়ে )অব্যাখ্যাত ও অজ্ঞাত সামঞ্জস্যহীনতায় কানাগলিতে যার পরিনতি, আবার ছোট্ট সে ছেলেটিকে মনে পড়ে, ফুটবল হাতে কাদামাখা কাপড়ে ভীরু ভীরু পায়ে বাসায় ঢোকা, মাগরিবের আযানের সীমাসূচক পার হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। উচ্চমাধ্যমিকের সময় ইস্টার্ন রিফাইনারীর বন্ধুদের সাথে কাছের সৈকতে গানের আসর...
তারপর রাত গিয়েছে দিন গিয়েছে কর্ণফুলীর মোহনায় অনেক বাতাস ও এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। সেই ছোট্ট ছেলেটি অনেকটা বড় হয়েছে। বাস্তবতার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে সে থাকে আজ তিনশো কিলোমিটার দূরের এক শহরে, ঘুম থেকে উঠেই পান্থপথের নাগরিক ব্যাস্ততা ত্রস্ততা ঘাম ক্লেদ স্বেদ বা গুলশানের কর্পোরেট গুমোট অফিসগুলোতে সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা এমনকি মাঝে মাঝে সারারাত কাটিয়ে ফেরে , আর স্বপ্ন দ্যাখে দৌড়ে আবারো পাহাড়ে উঠার , টাইগারপাসের মাঠে শুয়ে শুয়ে তারা দেখার , ইস্টার্ণ রিফাইনারীর দিকের সমুদ্র সৈকতে রাতে শুয়ে হেড়ে গলায় অঞ্জন-নচিকেতা-সুমন গাওয়া। পালানোর স্বপ্ন সে দ্যাখে না, চায় শুধু একটু অবসর এই বড্ডো বেশী নাগরিক শহর থেকে। পালানো সম্ভব না, এই শহরই এখন তার অন্নদাতা ,বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েছে সে।
গত কয়েকবছরে অনেক বেশী সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে এই শহরটিতে , কিছু কিছু প্রিয় জায়গাও তৈরী হয়েছে। পরিবার নির্বাসিত জীবনের নিত্যসঙ্গী ডিম-দুধ-কলা-পাউরুটি-নুডুলস তে ও অনেক অভ্যস্ত। কিন্তু এখনো বাসায় ফিরে ধাতব তালাটির অভ্যর্থনা সহ্য করে নিতে পারেনি সে, অনেকটা ঘরকুনো স্বভাবের ছেলেটির এই প্রতিক্রিয়া কিছুটা মাত্রাসঙ্গতই। তাই এখনো তার রক্তে নাচন উঠে বৃহঃস্পতিবার রাতের বাসে উঠে শুক্রবার সকালে অলংকারের মোড় পেরিয়ে ফয়েজ লেকের পাহাড় দেখলেই, সীতাকুন্ড পেরিয়ে আর ঘুমই আসে না... তাই শুক্রবারের এলার্মহীন সকালে সব বন্ধুদের ফোন করে জাগিয়ে গালি খেয়েও আনন্দে হাসে ছেলেটি, এ শহরে তার পড়ে পড়ে ঘুমাতে যেও অনেক ভালো লাগে!
মানুষ হয়ত আবেগিকভাবে চিন্তা করে কিন্তু দিন শেষে তাকে যৌক্তিক ভাবেই নিজের সিদ্ধান্তটা নিতে হয়। তাই পিতার অসুস্থতা, ভাইদের ক্যারিয়ার ইত্যকার জাগতিক ভাবনার ঘেরাটোঁপে ছেলেটিকে ঘুম থেকে উঠে কর্ণফুলীর মোহনা দেখার সুযোগ ছেড়ে অচেনা এই শহরটিতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সবাইকে নিয়ে। সান্তনা ? আসলে নাই। আনন্দময়ী 'নিজের' শহরটি জন্মস্থানটি ছেড়ে চলে যাবার বেদনা বিষন্নতার পরিমাপ কিছু দিয়েই হয় না।
সান্তনা এইটুকূই, এই অচেনা শহরটিও আমাদের মতো সুখে দুঃখে আশা হতাশায় ভরা মানুষদেরই শহর, অনেকদিন পর হয়ত একদিন এটিও অনেকটা নিজের শহরই হয়ে উঠবে।
আপাতত কিছুদিন খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা পরিবর্তনের সাথে আর হয়ত নিজের লেখা লাইনের মতই দীঘল কদমে হেঁটে যাওয়া নিঃসংগ উৎকল্পনার ভেতর দিয়ে।
[অনেকদিন পর ব্লগে ফেরা বা অনেকদিন পর বাংলা লেখা বা নিজস্ব হাবিজাবি বিষন্নতায় ভরা এলোমেলো একান্ত কথনে কি বলেছি নিজেই জানি না। অগ্রিম ক্ষমামার্জনা।


সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০০৯ রাত ৮:৪০