১৯৩৯ সাল। পোল্যান্ডের ওয়ারসিয়া নাৎজি জার্মান বাহিনী দখলে নিয়ে ফেলেছে। যখন তখন তারা শহরের দালান গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ট্যাংকের গোলা দিয়ে। মানুষকে গুলি করে মারছে পোকার মতো। হ্যাঁ, ইহুদিরা তখন নাৎজি জার্মান বাহিনীর কাছে পোকাই। শহরের পার্কে ঢোকার অনুমতি নেই তাদের, রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসার অনুমতি নেই।
সেই গোলাগুলি আর সাঁজোয়া বাহিনীর ত্রাসের মাঝেই চলছিল ওয়ারসিয়ার দিনরাত্রি। রেডিও স্টেশন গোলার আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়ায় স্থানিয় রেস্তোরার অতিথিদের পিয়ানো বাজিয়ে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে ওয়াদিস্ল স্পিলম্যান। সে সময়ের বিখ্যাত পিয়ানোবাদক। লোকের মুখে ফেরে ওয়াদিস্ল’র চেয়ে শ্রেষ্ঠ পিয়ানোবাদক সম্ভবত সারা পৃথিবীতে নেই।
একদিন দখলকৃত শহরের কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিল, পোলিশ ইহুদিদের সরে যেতে হবে শহরের একটা নির্দিষ্ট যায়গায়। যে যায়গাটা খুবই সংকীর্ণ আর জীর্ণ। ওয়ারসিয়ার পরিত্যাক্ত এলাকা। দলে দলে ইহুদিরা সেই যায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিল। পরিত্যাক্ত এলাকা অতঃপর দেয়াল তুলে আলাদা করা হলো ওয়ারসিয়া থেকে। শুরু হলো একদল মানুষের দুঃসহ সময়ের করুণ সঙ্গিত। মানবেতর অবস্থানে থাকা সেই একদল মানব সন্তানদের ভিড়ে অন্তর্ভুক্ত হল পিয়ানিস্ট ওয়াদিস্ল আর তার পরিবার।
একজন শিল্পির চোখ দিয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধ’র ভয়াবহতা আঁকা হয়েছে, এমন কি বলা যায় “দ্যা পিয়ানিস্ট” ছবিটিকে? নাকি দ্যা পিয়ানিস্ট আরো কিছু দাবি করে? মানুষ গৃহহীন ছুটছে প্রাণের আশায়, পিছনে অস্ত্রধারী হানাদার বাহিনী, প্রতিরাতেই বিভিন্ন বাড়িতে হানা দিয়ে মানুষ ধরে আনা, লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে তাদের খুন করা কিংবা হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গু লোকটি দাঁড়িয়ে কেনো সৈন্যদের সম্মান দেখাচ্ছেনা, তাকে হুইলচেয়ার সমেত চারতলা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া! এসব নৃশংশতার মাঝেও মূল ব্যাপার, জীবনের বয়ে চলা। একদিন সূর্য উঠবে, এই আশাতেই তো মানুষ রাত পার করে।
এসবের চেয়েও করুণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, পিয়ানিস্ট এর বেঁচে থাকা। একজন শিল্পি যুদ্ধকে কিভাবে গ্রহণ করে? সে বরাবর শান্তিকামী। অত্যাচারিত হবার পরেও তার মাঝে প্রতিবাদের সাহস ভর করেনা। তার কাছে মনে হয়, নিজের মতো করে বেঁচে থাকাটা মোটেই ছোটো ব্যাপার হতে পারেনা। নিজেকে বিক্রী তো সে করছেনা। সে পালিয়ে থাকছে। বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছে।
সেই বেঁচে থাকার অলৌকিক গল্পটাই আসলে আমাদের দেখিয়েছেন পরিচালক রোমান পোলান্সকি। যতক্ষণ ছবিটা দেখেছি, বুঁদ হয়েই দেখেছি। যেমন চোখ ফিরিয়ে নিতে পারিনি ভায়োলেন্সের দৃশ্যে, তেমন করেই আঁটকে ছিলাম বরফের বিষন্নতায় ওয়াদিস্ল স্পিলম্যানের পিয়ানোর শব্দে! তার অনাহার, তার অসুখ, তার প্রেম আপনাকেও অনাহারি হবার অনুভূতি দেবে, অসুখি অস্থির করে তুলবে কিংবা তার হারানো প্রেমের সাথে হঠাৎ দেখা আপনাকে করে তুলবে অবসন্ন!
২য় বিশ্বযুদ্ধের বিপন্ন গল্প নিয়ে বানানো এই ছবিটা হয়তো সর্বকালের অন্যতম সেরা ছবি। নিঃসন্দেহে একবিংশ শতকে বানানো এই জেনারের শ্রেষ্ঠ ছবি। এর পিছনে কনকনে শীতের অবদান আছে, অবদান আছে পিয়ানোর টুংটাং সঙ্গিতের। আর আছে কঠিন বাস্তবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বয়ান হয়ে ওঠার।
ইতিহাস তৈরী হয়। এভাবেই ইতিহাস শিল্পির হাতে পুনর্জন্ম লাভ করে। হারানো গল্প ফিরে আসে বইয়ের পৃষ্ঠা কিংবা সিনেমার রুপালী পর্দায়। এক দুঃসহ আর বিষন্ন ইতিহাসের চাক্ষুষ হতে চাইলে দেখে ফেলতে পারেন “দ্যা পিয়ানিস্ট।“
মুভিঃ দ্যা পিয়ানিস্ট (২০০২)
জেনারঃ ওয়ার, ড্রামা, বায়োগ্রাফি
অভিনেতাঃ অড্রিয়ান ব্রডি (পিয়ানিস্ট)
পরিচালকঃ রোমান পোলানস্কি
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১১