এইতো কয়েকটা বছর আগেও ঈদগুলি কতই না আনন্দময় ছিল!! রোজা'র ঈদে হয়তো সব চাচা আসতে পারতেন না, তবে কোরবানি ঈদে সবার উপস্থিতি ছিল একান্তভাবে কাম্য। বড় চাচা উভয় ঈদেই আসার চেষ্টা করতেন। মেজ চাচা পুলিশের চাকুরী করার দরুন ছুটি কম। তাই স্বল্প ছুটি হলেও কোরবানি ঈদের দিনটা অন্তত সবাই মিলে একসাথেই কাটাতেন। আমার বাবা, আমার পরিবার তো বাড়িতেই থাকতাম। সুতরাং আমরা ভিত্তিমূল সদস্য। সেজ কাকা দেশের বাহিরে থাকার দরুন হয়তো উনাকে ছাড়াই ঈদ করতে হতো। তবে কয়েক বছর পরপর উনি ঈদের সময়ে এসে ঈদের আনন্দটাকে যেন কয়েকগুন বাড়িয়ে দিতেন। আর ছোট কাকা'র তো প্রতিটা ঈদ গ্রামের বাড়িতেই করা চাই-ই চাই। বাকি রইলো শুধু একমাত্র ফুপুটা। ফুপাও দেশের বাহিরে থাকতেন বিধায় ঈদের সময়টা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। বাড়িতে এতগুলো রুম থাকা সত্ত্বেও শোয়া'র জন্য যায়গা হতো না। মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়েও মনে হতো স্বর্গের বিছানায় শুয়ে আছি। এতদিন পরপর ভাইবোন'রা একসাথে হওয়াতে রাতভর গল্প-গুজব করে মাঝ রাত্রির পরে ঘুমিয়ে পড়তাম। যদিও ঘুম আসতো না, তবুও দাদি আর চাচা-চাচীদের বকুনি খেয়ে ঘুমুতে হতো।
ঈদের আগে রাতে ছিল মেহেদী লাগানোর ধুম। পালা করে সবাই সবার হাতে মেহেদী লাগাতাম। মা'চাচীরা ব্যস্ত থাকতেন সকালে রান্না'র জন্য মশলা পিসতে কিংবা আদা-রসুন ছিলানোর পাশাপাশি গল্প-গুজব নিয়ে। রাতে বাপ-চাচাদের বাৎসরিক মতবিনিময় সভা বসতো। মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে বসে উনারা গল্প করতেন। আমরা ভাইবোনগুলো প্রতিযোগিতা করতাম দাদী'র নিকট শোয়া নিয়ে। কারন দাদী অনেক সুন্দর করে চুলে বিলি কেটে দিতেন। এই দু'একদিনে যদিও সেই সুযোগটা আমি পেতাম না; ওদের জন্য বৎসরের দু'চারদিন এক আত্মত্যাগ করাই যেতে পারে।
ঈদের দিন সকালে গোসল করে এসেই নামাজে যাবার আগে সবাইকে সালাম করতাম, অনেকগুলি টাকা সালামীও পেতাম। সারাদিন খাওয়া, মাংস বিলি করতেই দিনটা কেটে যেত। ঈদের দু'একদিন পরেই সবাই আবার চলে যেত। তখন যে কতটা খারাপ লাগতো সেটা শুধু নিজেই বুঝতাম। ভাবতাম ইশ! এভাবে যদি সারাটা বছর সবাই মিলে একসাথে কাটাতে পারতাম!!
আজ বড্ড মনে পড়ছে সেইসব দিনগুলির কথা। বিগত কয়েক বছর ধরে আগের মতো সেই ঈদগুলি আসে না। প্রতিটা ঈদের সময় প্রচন্ড ভাবে মিস করি সেই পাঁচ বাবা-চাচা এবং এক ফুপুসহ ত্রিশের উপর সদস্যের এক বিশাল পরিবারকে। একান্নবর্তী পরিবারটা আর একান্নবর্তী নেই, অনেকটা কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবার মন-মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটছে। বয়স বাড়লে হয়তো আত্মকেন্দ্রিক হবার প্রবনতাটাও বাড়তে থাকে। হয়তো বয়স বেড়েছে, কিন্তু সেই আবেগটা এখনো যায়নি, তাই হয়তো এখনো একসাথে ঈদ করা'র ইচ্ছে জাগে। তবে একটা সময় আসবে, তখন এই পরিবর্তনটাই হয়তো স্বাভাবিক মনে হবে। হয়তো আমারো পরিবার হবে, তখন হয়তো আমিও ভাববো একা একা নিজ পরিবার নিয়ে ঈদ করা'র কথা। এটাই হয়তো স্থান, কাল ভেদে সামাজিক পরিবর্তন।।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৪