কাপট্যবর্জিত মানবতাবাদী বাঙালি ভাবুকদের সারিতে কাজী আবদুল ওদুদ এক স্মরণীয় নাম । তিনি ছিলেন র্যা শনালিস্ট পন্ডিত। এই ধরনের ব্যক্তিত্ব সর্বদা যুক্তি ও বিচার বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয় । রক্ষণশীল গোঁড়ারা অবশ্য এঁদের পছন্দ করেন না , কারন মতাদর্শের ক্ষেত্রে , বিশেষ করে ধর্মীয় মতাদর্শের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের নামে প্রচারিত যেসব বিধি বিধান জীবনের উন্নতির জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে , এঁরা সেগুলো নির্দ্বিধায় বর্জন করতে বলেন । ওদুদের জীবনদর্শনেও এটি একটি বড় দিক – সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী ।
সাহিত্যিক ও সমালোচক হিসেবে ওদুদ সে-সময়ে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই ভারতবর্ষ পত্রিকার চৈত্র ১৩২৩ সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের বিরাজ বৌ উপন্যাসের সমালোচনামূলক প্রবন্ধ “বিরাজ বৌ” (চরিত্রবিবৃতি)’ প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যপ্রয়াস। ১৯১৮ সালে বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ “মীর পরিবার”, পরের বছর উপন্যাস নদীবক্ষে। মীর পরিবার পড়ে শরৎচন্দ্র ও শশাঙ্কমোহন সেন লেখককে উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আর নদীবক্ষে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা। প্রবাসী-তে (পৌষ ১৩২৫) ও মোসলেম ভারত-এ (বৈশাখ ১৩২৭), প্রকাশিত যথাক্রমে “মুসলমান সাহিত্যিক” ও “সাহিত্যিকের সাধনা “ প্রবন্ধ দুটি ওদুদের গভীর রসবোধ ও সাহিত্যতত্ত্ব ভাবনার পরিচয় বহন করে।
ত্রিশ বছর বয়সে লেখা ওদুদের রবীন্দ্রনাথকাব্য পাঠ (১৩৩৩) পুস্তিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন “আমার রচনায় এমন সরস বিচারপূর্ণ সমাদর আর কারো হাতে লাভ করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও ভাসানৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে তা স্মিয়কর। তোমার মতো পাঠক পাওয়া কবির পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয় ।“ এর ৩০ বছরেরও বেশি পর লেখেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নামের বিশালায়তন বই, বাংলা একাডেমির রয়াল সাইজের মুদ্রণের নয় শতাধিক পৃষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথের নিজের স্বীকৃতির সত্ত্বেও রবীন্দ্র পুরস্কার ওদুদের প্রাপ্য হয় না। বাঙালি জাতিকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কি বলা যাবে ?
কাজী আবদুর ওদুদের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার (বর্তমানে রাজবাড়ি জেলার অন্তর্গত) বাগমারা গ্রামে। এই গ্রামেই জন্মেছিলেন তাঁর আরেকজন সহযাত্রী খ্যাতনামা কাজী মোতাহার হোসেন। ওদুদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বছরেই সেখানে যোগ দেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহের হোসেন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি। কাজী আবদুল ওদুদ সহ এদের এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম হলের ইউনিয়ন কক্ষে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে “মুসিলম সাহিত্য সমাজ “ নামীয় সংগঠনের। নামের সঙ্গে “মুসলিম” শব্দটি থাকলেও এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ। এর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন- একজন ভাবুক, অন্যজন কর্মী। মুক্তবুদ্ধিতে চিন্তাচর্চা করতে গিয়ে সাহিত্য-সমাজের ওপর ঝড়-ঝাপটা যা এসেছিল তা এই দুজনকে কেন্দ্র করেই।
সাহিত্য-সমাজের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে সাংগঠনিকভাবেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্রের নাম ছিল শিখা। পত্রিকার মুখবাণীতে- “জ্ঞান যেখানে সামীবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব” - এঁদের লক্ষ্য দীপ্তিমান রয়েছে। কিন্তু কেবল ঢাকার নয়, সমগ্র মুসলিম বাংলায় এটি ছিল মাহমুদ হোসেন কথিত new school of thought আরও গৌরবের বিষয় এই যে সমাজ-রূপান্তরের লক্ষ্যে এ রকম সংঘবদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন মুসলিম-বিশ্বের কোথাও এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
ঢাকা অবস্থানকালে গল্প-উপন্যাস নাটিকা-প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনা মিলিয়ে আবদুল ওদুদের সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অন্য যাবতীয় গ্রন্থ কলকাতা যাওয়ার পর প্রকাশিত হয়।
আধুনিক কবিতাই শুধু নয়, আধুনিক গদ্যও আজ অনেক ক্ষেত্রে জটিল হয়ে পড়েছে। অনেক রচনারই ভাবোদ্ধার প্রায় দুরূহ, এর কারণ “সমারসেট মম্” - যা বলেছেন মনে হয় তাই: এঁরা লেখার আগে বিষয়বস্তু সম্বন্ধে চিন্তা করেন না, যতখানি ভাবার ততখানি ভাবেন না, লেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবেন। ফলে ভাব সুস্পষ্ট রূপ নিতে পারে না, লেখকের মন যা পারে না, পাঠকের মন তা কি করে পারবে? কাজী আবদুল ওদুদ এর বিপরীতধর্মী লেখক। তিনি যতখানি লেখেন তার অনেক বেশি ভাবেন এবং লিখতে বসার আগেই তিনি সেই ভাবনা সেরে ফেলেন। লেখা নিয়ে তিনি এত বেশি ভাবেন যে, লেখার আগেই তাঁর ভাষাও নাকি তাঁর মনে গড়ে ওঠে। সে ভাষা ও ভাব তাঁর মনের ভিতর কাগজে-কলমে রূপ নেওয়ার আগে, এত বেশি পুনরাবৃত্তি হতে থাকে যে তা তাঁর প্রায় মুখস্থ হয়ে পড়ে। ফলে এমন কি তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ তিনি মুখে মুখে শুনিয়ে দিতে পারেন। এভাবে ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভাষাও গড়ে ওঠে, মনে মনেই চলতে থাকে তার মাজাঘষা। তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈলী এভাবেই রূপ গ্রহণ করে এবং তা যে সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব, এ বিষয়ে তখন তিলমাত্রও সন্দেহ থাকে না। আশ্চর্য, তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরক্ত পাঠক, রবীন্দ্রনাথের মুক্ত-বুদ্ধি ও সাহিত্যাদর্শের ঘনিষ্ঠ অনুসারী, শুধু রবীন্দ্রনাথের রচনাশৈলী থেকে তাঁর রচনাশৈলী সম্পূর্ণ পৃথক। প্রাচীন ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর- তবু তাঁর রচনাশৈলীর সঙ্গে অন্য কারো রচনাশৈলীর এতটুকু সাদৃশ্য নেই। বড় লেখকের এ এক বড় গুণ, তাঁদের ব্যক্তিগত মনোদর্শন যেমন স্বতন্ত্র তেমনি তাঁদের রচনাশৈলীও স্বতন্ত্র।
যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল কাজী আবদুল ওদুদের জীবনদর্শনের বিরোধী। সে কারণে এবং নিজের চিন্তা চর্চার সুবিধার কথা ভেবে নিজের জন্মভূমি পূর্ব বাংলায় তিনি গেলেন না। অথচ এই অঞ্চলের যাদের জন্ম, দুই-একজন বাদে সবাই এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক পেশাজীবী-লেখক-সাংবাদিক অপশন দিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে যান। একমাত্র কন্যা ও দুই পুত্রের একজন তখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু ওদুদ কলকাতা ছাড়লেন না। আমৃত্যু ওখানেই রয়ে গেলেন। শোনা যায় পাকিস্তানের একজন মন্ত্রী তাকে প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে গেলে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে। এই লোভনীয় প্রস্তাবও তাঁকে মোহগ্রস্ত করতে পারেনি। তাঁর প্রজ্ঞা তাঁকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছিল যে পাকিস্তানে তিনি টিকতে পারবেন না। এটা যে কতটা সত্য তা বোঝা যায় দৈনিক আজাদ ও সরকারি পত্রিকা মাসিক মাহে-নও-এ যে-কোন ছুতোয় তাঁর বিরুদ্ধে লেখাপত্র থেকে। এমনকি তাঁকে পাকিস্তান-বিরোধীও বলা হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের গেলে কবিগুরু গ্যেটে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ , বাংলার জাগরণ, ইত্যাকার অসামান্য বই লেখা সম্ভব হতো না। সুতরাং তাঁর সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তাতে দ্বিমতের কারণ নেই।
কাব্যে, গল্প-উপন্যাস-নাটকে, যুক্তি তর্কের সীমা অত্যন্ত সংকীর্ণ। কাব্য ছন্দ, সুর ও নানা আলঙ্কারিক বিধি-নিষেধের দ্বারা আর গল্প-উপন্যাস-নাটক চরিত্র ও ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই ঐসব রচনায় প্রজ্ঞায় বিশদ ব্যাখ্যা, যুক্তি-তর্কের সাহায্যে তার প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশের ক্ষেত্র খুব সীমাবদ্ধ। এত গল্প, উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক লিখেও যেন রবীন্দ্রনাথ মনের কথা মন খুলে বলতে পারেননি। প্রবন্ধের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যুক্তি-তর্কই প্রবন্ধের প্রাণ, তার জন্য বিচারবুদ্ধি ও মননশীলতা অপরিহার্য (অবশ্য তথাকথিত রম্যরচয়িতাদের কথা স্বতন্ত্র) । বিচার-বুদ্ধির চেয়ে লোকরঞ্জনই রম্যরচনার প্রধান লক্ষ্য। ইউরোপীয় সাহিত্যেও এমন কোন মহৎ ভাবুক নেই, যিনি প্রবন্ধে নিজের মনের ভার লাঘব করতে চাননি। প্রবন্ধ কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্য নয়- পাঠক সংখ্যা চিরকালই বিরল। বিশেষ করে আমাদের দেশে অনেক সাহিত্যিকও প্রবন্ধের নামে আঁতকে ওঠেন। অথচ যে কোন দেশের মন-মানসের, মননশীলতা ও জীবন-জিজ্ঞাসার পরিচয় বহন করে সে দেশের প্রবন্ধ সাহিত্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি প্রবন্ধ-সাহিত্য ইংরেজ জাতির মননশীলতা ও জ্ঞান-সাধনার এক চূড়ান্ত পরিচয়। জাতির চিন্তা, ভাবনা, আশা-আকাঙক্ষা, দ্বন্ধ-সমস্যা বিশেষ করে মানসিক বিকাশের পরিচয় সাধারণত বিভিন্ন প্রবন্ধেই ফুটে ওঠে। আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্য অনুন্নত, তার মানে আমাদের মেধাবুদ্ধি চর্চার মান অনুন্নত, পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ! কাজী আবদুল ওদুদের বিভিন্ন রচনা ও প্রবন্ধে মেধাবুদ্ধি চর্চার খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস সেই পরিচয় নেহাৎ অগৌরবের নয়।
বাংলাদেশের যেটা সৃষ্টিশীল যুগ অর্থাৎ রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ- এ যুগ সম্বন্ধে আবদুল ওদুদ এক রকম বিশেষজ্ঞ। ঐতিহাসিক ধারা অনুসরণে ও তাঁর মূল্য বিচারে তাঁর সঙ্গে অনেকের হয়ত মতের অমিল হতে পারে। বলাবাহুল্য সাহিত্যের ব্যাপারে মতের মিল খুব বড় কথা নয়। ওদুদ সাহেব স্বাধীনভাবে, সব রকম পল্লবগ্রাহিতা বর্জন করে নিজের মতাএর, তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর রচনার এক বড় আকর্ষণ বহু বিষয়ে তাঁর অনন্য মৌলিকতা। গতানুগতিক চিন্তাধারার অনুসরণ তিনি করেননি- নুতন করে ভেবেছেন আলোচ্য সব বিষয়েই। ফলে তাঁর রচনা অন্যের চিন্তাকে নাড়া দেয়, ভেঙে দেয় অনেক পূর্বধারণা, পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলে নুতন জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের এযুগের চিন্তাশীলদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কাজী আবদুল ওদুদের স্থান প্রথম সারিতে। রচনার বৈচিত্র্যে ও গভীরতার দিক দিয়ে প্রবন্ধ-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। প্রমথ চৌধুরীর পরে এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে আর কেউ প্রবন্ধ লিখেছিন কিনা সন্দেহ। প্রমথ চৌধুরীর রচনার সরসতা অবশ্য আবদুল ওদুদের রচনার নেই, তাঁর রচনা আরো গম্ভীর ও ভারী। প্রমথ চৌধুরীর কন্ঠে সব সময় একটা চটুল পরিহাস ফুটে রয়েছে- ওদুদের রচনায় তাঁর অতলস্পর্শী গাম্ভীর্যের নীচে সব রকম পরিহাস পড়েছে চাপা, তাতে হালকা হাসি, চটুলতা এতটুকুও প্রবেশাধিকার পায়নি।
ইউরোপের রেনেসাঁস শুধু ইউরোপের নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্যই একটি স্মরণীয় ব্যাপার। এরপর থেকে ধর্মান্ধতা ও নানা কুসংস্কারে সীমা পেরিয়ে ইউরোপের মানব-বুদ্ধি বিদ্যার বিচিত্র পথে জয়যাত্রা শুরু করেছে- যুক্তিবাদ, মনুষ্যত্ববোধ ও আধুনিকতার রাজপথেই এ জয়যাত্রা। মানুষ যেন এবার থেকে নুতন করে নিজেকে আবিষ্কার করল- মানব-মনীষার বন্ধনমুক্তি ঘটল নানা বিচিত্র পথে, শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, ধর্ম-জিজ্ঞাসা ও মনুষ্যত্ব চেতনায় তা নুতন করে সার্থক হয়ে উঠল এখন থেকে। গ্যেটে প্রতিভা এই রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ ফসল- নব মানবতাবাদের এক মহিমোজ্জ্বল প্রতীক। রেনেসাঁস বা নবজন্মের ফলে জাতীয় মনীষার কিভাবে বন্ধনমুক্তি ঘটে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জার্মান জাতি। তার পরিচয় দিতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর ‘কবিগুরু গ্যেটের’ অবতরণিকায় লিখেছেনঃ একটা দেশের বা জাতির নবজন্মে, প্রতিবিম্বিত যেন বসন্ত ও বর্ষাব নৈসর্গিক প্রাচুর্য। বসন্তের আগমনে দেখা দেয় গাছে গাছে নুতন পাতা, ডালে ডালে লাখো পাখির আনন্দগান, বর্ষায় দেখতে নদী নালা ভরে ওঠে উপরের নিরন্তর বর্ষণে ; একটা জাতির নবজন্মকালে তেমনি একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু ¯স্রষ্টার আবির্ভাব ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান নবজন্মে দেখতে পাই-চিত্রের ক্ষেত্রে এজর, ভিঙ্কলম্যান , সঙ্গীতে মোৎসাট , বেটোফন , সাহিত্যে লেসিং , ক্লপস্টক , ভীল , হের্ডর , গ্যেটে , শিলার , শ্লেগেল , দর্শনে কান্ট, হেগেল, ফিকটে, শোপেন হাউয়র ইত্যাদি। এ-যেন দেখতে দেখতে গগন বিদীর্ণ করে দাঁড়ালো বিচিত্রশীর্ষ বিরাট পর্বতমালা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ শৃঙ্গমালার উচ্চতম ও মহত্তমটির নাম গ্যেটে ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে বাঙ্গালি সমাজেও রেনেসাঁস তথা নবজন্মের কিছুটা আভাস দেখা দিয়েছিল। ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল ধর্মান্দোলন তথা শাস্ত্রের নবতর ব্যাখ্যায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, সাহিত্যে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ , চিত্রকলায় রবি বর্মা থেকে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল , বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা , ইতিহাসে রমেশ দত্ত, যদুনাথ সরকার, রমেশ মজুমদার , রাজনীতিতে ও দর্শনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন শীল, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়- এমনি আরো বহুদিকে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর অর্থাৎ ইউরোপীয় বিদ্যার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে বাঙালি প্রতিভা নানা দিকে সার্থক হয়ে উঠেছিল। বাঙালি মনীষার এই বিচিত্র পর্বতমালা যে কোন জাতির পক্ষেই গৌরব ও শ্লাঘার বিষয়। জার্মানির অনুকরণে এখানেও বলা যেতে পরে এই পর্বতমালার উচ্চতম ও মহত্তমটির নাম রবীন্দ্রনাথ।
আমাদের মুশকিল- আমরা পুরোপুরি মানুষ কখনো হতে পারিনি। আমরা আগে মানুষ না আগে হিন্দু বা মুসলমান, এ অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্ধে আমাদের সমাজ-মনের এক ত্রিশঙ্কু দশা। তাই বাংলার নবজাগরণের হাওয়া আমাদের গায়ে লেগেছে মাত্র, আমাদের চিন্তায় চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেনি।
ওদুদ বিশ্বাস করতেন- রাজনৈতিক মুক্তি তো জীবনের বাইরের মহলের একটি খন্ড দিকমাত্র। বুদ্ধির তথা মনের মুক্তি না ঘটলে অর্থাৎ অন্তরে যদি মানুষ মুক্ত-বুদ্ধি না হয় তাতে যে কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের সহায়ক না হয়ে, হয়ে পড়ে প্রবল বাধা। তাই রেনেসাঁস অর্থাৎ জাগ্রত চিত্ততা চাই। এই রেনেসাঁসের কিছু কিছু কথা আবদুল ওদুদের বিভিন্ন রচনায় রূপ পেয়েছে। এই দিক দিয়ে আমাদের সমাজ-জীবনে ও সাহিত্যে তাঁর রচনার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে।
স্বাধীনতার আগে আমাদের জাতীয় জীবনে যতটুকু উদ্যোগে-আয়োজন, উৎসাহ-উদ্দীপনা, আশঅ-আকাক্সক্ষা, সাধনা ও সংকল্পের রশ্মিরেখা দেখা দিয়েছিল, তার চিহ্নও এখন অবলুপ্ত। দেশের মাটি ও জল-হাওয়ায় তো কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের মনের মাটি ও জল-হাওয়ার অর্থাৎ মনের দৃষ্টিকোণ ও জীবন-বোধের। সাধনা ও অধ্যবসায়ের পথ ছেড়ে আমরা এখন সহজ সিদ্ধির রাস্তায় এসেছি অর্থাৎ না পড়ে পন্ডিত হওয়ার পথ ধরেছি। দেশব্যাপী দারিদ্র্য ও মানসিক বন্ধ্যাত্বের এই তো এক বড় কারণ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল ওদুদের রচনা এক অনন্য ব্যতিক্রম। সস্তা ভাব-বিলাসিতার পরিচয় তিনি কোথাও দেননি- বুদ্ধি, যুক্তি ও মননশীলতার স্বাক্ষর রয়েছে তাঁর প্রতিটি রচনায়। আজ খাঁটি মননশীল রচনা অনেকখানি উপেক্ষিত, মননশীল রচনার সমঝদারি করতে হলে মন ও মস্তিস্ককে যতখানি খাটাতে হয় ততখানি খাটাতে এই যুগে অনেকেই অনিচ্ছুক।
কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ এই যুক্তি-বিচারের পথে জ্ঞানচর্চার একটু খানি ‘শিখা’ জ্বালাতে চেয়েছিল এবং এ প্রতিষ্ঠানের মটোই ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। আজকের দিনেও এ আদর্শের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। মানুষকে জ্ঞানের চর্চা, বিচার বুদ্ধির চর্চা অব্যাহত রাখতেই হবে যদি জীবনে নব নব সিদ্ধি তার কাম্য হয়। মানুষকে যে উন্নত জীব বলা হয়, তারও কারণ মানুষ বুদ্ধি-বিচারের অধিকারী বলেই। বুদ্ধি-বিচারকে বিসর্জন দিলে মানুষের অনেক আচরণই পশুর আচরণে গিয়ে ঠেকে। এই বুদ্ধি-বিবেচনাকে বাদ দিয়ে অন্ধ শাস্ত্রানুগত্যেরই নাম। এর খপ্পরে একবার পড়লে আমাকে শুধু মানুষ হলে চলবে না, হতে হবে মুসলমান কি হিন্দু, তাতেও নিস্তার নেই- হতে হবে গোঁড়া মুসলমান অথবা গোঁড়া হিন্দু, অথবা গোঁড়া শিখ। ওদুদের এই ভাবনা-চিন্তা যে কতটা সত্য, তা তো আমরা এখন এদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি।
আলোচনার মাধ্যমে তিনি বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছেন পাঠক সমীপে, এখানেই কাজী আবদুল ওদুদের কৃতিত্ব সর্বাধিক। এই কৃতিত্বের একটা বড় অংশের দাবিদার তার 'শ্বশতবঙ্গ' গ্রন্থখানি। ‘নদীবক্ষে' (১৯১৮) কাজী আবদুল ওদুদের বিখ্যাত উপন্যাস ও ছোটগল্পগ্রন্থ 'মীর পরিবার' (১৯১৮)। রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৯২৭), নবপর্যায়—দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২৯), সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৯৩৬), আজকার কথা (১৯৪১), কবিগুরু গ্যেটে (১৯৪৬), শ্বশতবঙ্গ (১৯৫১), স্বাধীনতা দানের উপহার (১৯৫১), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-প্রথম খণ্ড (১৯৫৫), বাংলার জাগরণ (১৯৫৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৯৬৬), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬৯) প্রভৃতি তার প্রকাশিত গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত 'ব্যবহারিক শব্দকোষ' একখানি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৪:৫৮