বাংলা সাময়িক পত্রে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ও বাংলায় প্রকাশিত বিজ্ঞান পত্রিকাগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৮১৮ সালে পশ্চিম বঙ্গের শ্রীরামপুর এর মিশনারিগন কর্তৃক প্রকাশিত “দিগদর্শন” পত্রিকায় প্রথম বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয় ।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম পত্রিকা “বিজ্ঞান সেবধি” প্রকাশিত হয় ১৮৩২ সালে , Society for translating European sciences সংস্থার অর্থানুকূল্যে । এক বছর চলার পর “বিজ্ঞান সেবধি “ বন্ধ হয়ে যায় । ১৮৪২ ও ১৮৪৩ সাল থেকে অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদনায় “ বিদ্যা দর্শন” ও “তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে ।
১৯৪৮ সালে বিজ্ঞানী সত্যেন বোষ , মেঘনাথ সাহার উদ্যোগে , মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার লক্ষ্যে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠিত হলে , পরিষদের মুখপাত্র “জ্ঞান-বিজ্ঞান “ , বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা প্রকাশের মাধ্যমে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে ।
কিন্তু এই ধরনের পত্রিকা গুলো ছিল বাংলা ভাষায় “বিজ্ঞান” কে জনসাধারনের কাছে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে । যাকে আজকের যুগে আমরা বলে থাকি পপুলার সায়েন্স । কিন্তু কোন ধরনের মৌলিক গবেষণা বা রিসার্চ পেপার এই ধরনের পত্রিকা গুলোতে প্রকাশিত হয় নি ।
কিন্তু শুধুমাত্র গণিত শাস্ত্রের মৌলিক গবেষণা বা রিসার্চ পেপার বাংলা ভাষায় প্রকাশের উদ্দেশ্যে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল “ ত্রৈমাসিক অঙ্ক ভাবনা” । বাংলা ভাষায় গণিত শাস্ত্রের মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ গুলো এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয় । প্রবন্ধগুলোর মান ছিল সাধারন মানুষের ভাবনার স্তরের অনেক উপরে । শুধুমাত্র গণিতের ছাত্র ও বিশেষজ্ঞ রাই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন । পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন “কমলকুমার মজুমদার “ ।
কে এই কমলকুমার মজুমদার ? বিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক যিনি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিগণিত । তাঁকে বলা হয় 'লেখকদের লেখক' । তার উপন্যাস “অন্তর্জলী যাত্রা” এর অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ । বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস , ইয়োরোপীয় উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠেছে, কমলকুমার মজুমদার সেই অনুসরণতা পরিহার করেছিলেন ।
খ্যাতিমান এই ঔপন্যাসিক জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। সৃষ্টিতে, আড্ডায়, পাণ্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা–পরচর্চায়, নতুন নতুন কাহিনি সৃষ্টি করতে করতে তিনি নিজেই পরিণত হয়েছিলেন বিভিন্ন কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্রে।
চল্লিশের দশকের শুরুতে কফি হাউসে কলকাতার চলচ্চিত্র আন্দোলনকর্মীদের যে আড্ডা জমে ওঠে, তার নাটের গুরু ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। কমলকুমার, সত্যজিৎ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়দের এ আড্ডা থেকেই গঠিত হয়েছিল ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। সোসাইটির উদ্যোগে ঘরে বাইরে উপন্যাসটি চলচ্চিত্র করার পরিকল্পনা করা হয়। কমলকুমারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শিল্প নির্দেশনার। সত্যজিতের দায়িত্ব ছিল চিত্রনাট্য রচনার। এরপর শরৎচন্দ্রের অভাগীর স্বর্গ আর রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস চলচ্চিত্রের জন্য দুই হাজারের বেশি স্কেচ করেছিলেন কমলকুমার। এর কোনোটিই সে সময় শেষ পর্যন্ত আর নির্মিত হয়নি। একমাত্র নির্মিত হয়েছিল পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায়ের এ ছবির ডিটেলের কাজগুলো কমলকুমারের।
প্রথাগত কোন বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও কমলকুমার সাহস করেছিলেন গণিত শাস্ত্রের মৌলিক প্রবন্ধ গুলো সম্পাদনা করে মলাটবদ্ধ করার । ত্রৈমাসিক ‘অঙ্ক ভাবনা ‘ বাংলাভাষায় প্রকাশিত সার্থক প্রথম গণিত পত্রিকা কেবল নয় , বাংলা সাহিত্যেও অন্যতম সংযোজন । চর্যাপদের যুগে পদকর্তারা পদ রচনায় যেমন করে জীবনের ভাষা গাণিতিক ভাষাকে কাব্যে সম্পৃক্ত করেছিলেন , কমল্ কুমার যেন সেই ভাবনাকেই আধুনিক পরিভাষায় ব্যাপৃত করতে চেয়েছিলেন ! কী সাহস ! কী প্রত্যয় !
“অঙ্ক ভাবনা” – র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালের ১ লা জানুয়ারি । বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারনে সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে আনন্দমোহন ঘোষ কে সাথে নেন । প্রথম সংখ্যার ঘোষণা অনুযায়ী পত্রিকাটি ছিল ত্রৈমাসিক। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ চিত্রে ছিল প্রাচীন ঈজিপ্তীয় পরিমাপের বাটখারা’। যথা নিয়মে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়; যা এপ্রিল-জুন সংখ্যা।
প্রথম সংখ্যার বিষয়সূচিতে ছিল: লীলাবতী, বিমান গতিবিধির অঙ্ক, ন্যায়তত্ত , ইউক্লিডীয় জ্যামিতি বিষয়ক আলোচনা, বীজগণিতের ইতিকথা, ত্রৈমাত্রিক আয়তন, ম্যাজিক স্কোয়ার, বিজ্ঞান ও প্রকল্প।
প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকের স্পষ্ট বক্তব্য-
ইদানীং আমাদের দেশে খোশ গল্প ও পদ্যের যথেষ্ট মান, অন্য যে-কোনো বিষয়ক আলোচনাই পথভ্রষ্ট হইয়াছে; অথচ একদা যে-সকল বিষয়ে, পুরাতন পত্রিকা পুস্তকাদি পাঠে জানা যায় যে বাংলার জনসাধারণ খুবই আগ্রহশীল ছিল; এখনকার দু’য়েকটি বিজ্ঞান পত্রিকার চেহারা দেখিলে নিশ্চিত ধারণা জন্মিবে মুষ্টিমেয় উৎসাহীর আশায় তাহা বাঁচিয়া আছে, তবুও আমরা নিরাশ হই নাই।
আরও লিখেছেন-
যেহেতু অঙ্কশাস্ত্র সকলতত্তের সম্বন্ধের আদি কারণ, ইহাই শক্তি এবং মাতৃস্থানীয়, সৎ এবং অসৎ, বিচারের জন্য প্রকৃষ্ট ন্যায় এবং বিজ্ঞানের-বিজ্ঞানচিন্তার মূল।
তাই অঙ্ক ভাবনার মতো পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টার প্রয়োজন আছে বলে সম্পাদক মনে করেন। একাজে যে কয়েকটি কঠিন বাধার সম্মুখীন হইতে হয় তারও সম্যক জ্ঞান সম্পাদকের ছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তা উল্লেখও করেছেন। নিজের অবস্থান সম্পর্কে, বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে অঙ্ক ভাবনা’ পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে সম্পাদক জানান:
‘আমাদের উদ্দেশ্য, অঙ্কশাস্ত্র জিজ্ঞাসু পাঠকবর্গকে অঙ্কধারণা সম্পর্কে জ্ঞাত-করা কারণ ইতিহাস জানার মূল্য আমরা নিশ্চয় সকলেই স্বীকার করিব-ইহা ব্যতীত আমাদের পাঠক্রম যাহাতে অত্যন্ত আধুনিক-নিয়ম অনুযায়ী হয় তাহার আভাস দেওয়া...।
সেজন্যই গণিতশাস্ত্রে ভারতীয় প্রাচীন রচনা লীলাবতী’-র অনুবাদ প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখা। অনুবাদটি দীর্ঘ। তৃতীয় আধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত উক্ত সংখ্যা ছাপা হয়েছিল। পরবর্তী অংশ পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশের ঘোষণাও করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাস্কর-এর লেখা গণিতবিষয়ক গ্রন্থ ‘লীলাবতী’ ১১৫০ সালে প্রকাশিত; যা তার সিদ্ধান্ত শিরোমণির চারটি অংশ লীলাবতী, বীজগণিত, গ্রহগণিত ও গোলাধার এর একটি অংশ। লীলাবতী’তে পাটিগণিত, জ্যামিতি, অনির্ণেয় সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নিত্যকার জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য গাণিতিক বিষয় লীলাবতীর আলোচ্য বিষয় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় গণিত পুস্তক।
দ্বিতীয় লেখাটি বিমান গতিবিধির অঙ্ক’। লেখাটির শুরুর অংশে কেন অনুরূপ লেখা প্রকাশ করা হয়েছে তা জানিয়েছেন।
যে যুগে আমরা বাস করি, নিঃসন্দেহে তাহাকে বিমানেরই যুগ বলা যায়। এ যুগে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এবং যুদ্ধকালে বিমান বিশেষ অংশ গ্রহণ করে। আমরা প্রত্যেকেই বিমানের খুঁটিনাটি এবং উহার গতিবিধি জানিতে খুবই উৎসুক, আকাশপথে কীভাবে বিমান যাতায়াত করে, কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কীভাবে উহা সুদূর নিউইয়র্কে পৌঁছায় এবং কোন অঙ্ক বিমান চালককে পথ নির্ণয় করিতে-স্থান নির্ণয় করিতে সাহায্য করে তাহা বুঝিয়া দেখিতে চাহি।
তৃতীয় লেখাটি ‘ন্যায় তত্ত্ব - লেখক শান্তি বসু। লেখক শুরুতেই বলেন ভারতীয় চিন্তায় জ্ঞানের কথা আত্যন্তিকভাবে পারমার্থিক তত্ত্ব এর সহিত জড়িত।তত্ত্ব আবার আত্মজ্ঞানেই একমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আত্মজ্ঞান নিরন্তর শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের বিষয়। তবু বিচার জ্ঞানের আদ্যন্ত সমস্ত স্তরেই উপস্থিত থাকে, যেহেতু, বিচারেই নিত্যনিত্য বস্তুবিবেক জানা যায় এবং আত্মজ্ঞানের বিষয়ীভূত হইয়া জিজ্ঞাসুকে সচেতন করে।
তারপরের লেখাটি ‘সংখ্যাতত্ত্ব” এর সূচনা। লিখেছেন অন্যতম সম্পাদক আনন্দমোহন ঘোষ। মানবজীবনের বিশেষ লগ্নে সংখ্যা আবিষ্কার হলে মানুষের ভাষা নতুন রূপ পেয়েছে। তারপর হয়েছে সংখ্যার কত না ব্যবহার- যা আজও অব্যাহত। ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি। তারই উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ‘সংখ্যাতত্ত্ব - যা একটি জটিল বিষয়। কিন্তু লেখক অসাধারণ দক্ষতায় সাধারণ পাঠকের বোধগম্য করে প্রাঞ্জল ভাষায় বিষয়টি সম্পর্কে লিখেছেন।
সৗম্য চক্রবর্তীর ইউক্লিডীয় জ্যামিতি বিষয়ক আলোচনা’য় অতি সংক্ষিপ্ত আকারে মনোগ্রাহীভাবে প্লেটো থেকে ইউক্লিড পর্যন্ত জ্যামিতি চর্চার কথা লিখেছেন। প্লেটো ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ দার্শনিক। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০ অব্দে তিনি ‘আকাদমি’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার অসামান্য প্রভাব শুধু সমকালেই নয় উত্তরকালীন পন্ডিতদের উপরও বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি বলতেন, ‘দর্শন শিক্ষার জন্য জ্যামিতিচর্চা অপরিহার্য’। তাঁর আকাদেমির প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা থাকত, যিনি জ্যামিতি জানেন না তার এখানে প্রবেশের অধিকার নেই। আদর্শ ও পূর্ণতাই প্লেটোর দর্শনের মূলগত ভাব। তিনি স্বতঃই মনে করতেন, বৃত্তেই আকৃতি পূর্ণতা লাভ করেছে। প্লেটোর আকাদেমির জ্যামিতির ঐতিহ্যের একজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যাখ্যাকারী ছিলেন ইউক্লিড। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ২৭৫ অব্দের মধ্যে তিনি যে পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত তাই জ্যামিতির একমাত্র পাঠ্যপুস্তক হিসাবে প্রচলিত ছিল। রীমান ও লোবাচেভস্কি প্রমুখ ‘অ-ইউক্লিডীয়’ জ্যামিতির আবিষ্কারের ফলে জ্যামিতিচর্চা নতুন ধারায় হলেও ইউক্লিডীয় জ্যামিতি সম্পূর্ণভাবে গুরুত্বহীন হয়নি আজও। সেজন্য ‘অঙ্ক ভাবনা’র এই লেখাটির গুরুত্ব পাঠকের কাছে আলাদা।
অসীম চট্টোপাধ্যায় এর বাস্তব জীবনের চারপাশে দেখা ত্রৈমাত্রিক বস্তুর আয়তন সম্পর্কিত রচনা ‘ত্রৈমাত্রিক আয়তন’। রাসেল ক্লিফোর্ডের লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বস্তুর পরিমাপ নির্ণয়, আকৃতি বিচার বা দুই বস্তুর দূরত্ব নির্ণয় নিত্যকার ঘটনা। এবং এই ক্রিয়ায় ত্রিমাত্রিক আয়তন নির্ণয় স্বাভাবিক ক্রিয়া। এই স্বাভাবিক কাজটি মানুষ করে অবলীলায়; কিন্তু তা যে জ্যামিতিক জ্ঞান সমৃদ্ধ তা মনে করে কয়জন ! সাধারণের এই বোধ জাগ্রত হলে ‘অঙ্কভাবনা’ এক নতুন রূপ পায় এটা মনে রেখেই ‘ত্রিমাত্রিক আয়তন’ শীর্ষক লেখা।
দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল নানাঘাট শিলালিপি-র ছবি। অশোকের রাজত্বের একশতক পরে খোদিত এই প্রাচীন ভারতীয় শিলালিপিতে শূন্য ও বিভিন্ন সংখ্যার ব্যবহার আছে। নানাঘাট পর্বত পুণা থেকে ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত। সম্পাদকীয়তে জানানো হয়, অঙ্ক ভাবনা পত্রিকা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে ; ভাগ্যশ ইহা পাঠক সাধারণ হইতে সমাদর লাভে বঞ্চিত হয় নাই,....’
দ্বিতীয় সংখ্যার বিষয়সূচিতে ছিল বিজ্ঞান ও প্রকল্প, গাণিতিক সম্ভাব্যতার উপক্রমণিকা, বীজগণিতের ইতিকথা, ত্রৈমাত্রিক আয়তন, আর্কিমিডিসের পাটিগণিত, দশমিকের রহস্য, কার্ল ফ্রিডরিক গায়স, সংখ্যা তত্তে¡র সূচনা, নন-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি।
দ্বিতীয় সংখ্যায় আকর্ষণ হচ্ছে বেলাল চৌধুরীর দুটি লেখা। প্রথমটি ‘কার্ল ফ্রিডরিক গায়স” ’ এবং দ্বিতীয়টি ‘অনইউক্লিডীয় জ্যামিতি” । বেলাল চৌধুরী বাংলা সাহিত্য ও নাটকের জগতে পরিচিত নাম; কিন্তু তার গাণিতিক জ্ঞান সম্পর্কে জানে কয়জন? লেখা দুটি পাঠে স্তুম্ভিত হতে হয় বেলাল চৌধুরীর গাণিতিক জ্ঞানের গভীরতা দেখে । কমলকুমার মজুমদারের স্বার্থকতা বোধ হয় এখানেই একঝাক মানুষকে অঙ্কভাবনায় ভাবিত করতে পেরেছিলেন।
জার্মানির ছোটো শহর ব্রান্সউইকের শ্রমিক ও নিরক্ষর পরিবারের সন্তান জহন কার্ল ফ্রিডরিক গ্যয়স। অখ্যাত পটভূমিকায় দরিদ্র পরিবারের সন্তান অঙ্কশাস্ত্রের ইতিহাসে সাফল্যের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। গ্যয়সিয়ান মডেল আধুনিক বিজ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে আজও প্রয়োগ হয়।
কার্লের বাবা, কার্লের দাদু যোহান বেনজের মতো একজন সুদক্ষ তাঁতি হবার বাসনায় কার্লকে তাঁতের কাজে লাগান। কালের বিস্ময়কর প্রতিভার কথা ব্রান্সউইকের ডিউকের কানে পৌঁছলে তিনি কার্লকে দুর্গে ডেকে আনেন। এবং অচিরে দুজনের বন্ধুত্ব হয়। যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। ভাষা না অঙ্কশাস্ত্র কোনটা পড়বেন, কার্লের তা নিয়ে প্রাথমিকভাবে মানসিক দ্ব›দ্ব থাকলেও শেষ পর্যন্ত অঙ্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করাই স্থির করলেন কার্ল ১৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ। ওইদিনটি তার কাছে অতি স্মরণীয় দিন কেননা ওইদিনেই তিনি কেবলমাত্র একটি কম্পাস ও একটি মাপকাঠির সাহায্যে সতেরো দিক বিশিষ্ট বহুভুজ অঙ্কন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন।
প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ইউক্লিডীয় জ্যামিতি বিষয়ক আলোচনা শীর্ষক নিবন্ধ। পৃথিবীর পরিবর্তন যেমন কোথাও থেমে থাকেনি তেমনি জ্যামিতি চর্চায় ইউক্লিডীয় জ্যামিতির মাইল ফলক হলেও অচিরে পরিলক্ষিত হয় তার সীমাবদ্ধতা। শুরু হয় নতুন ভাবনার; জন্ম হয় অনইউক্লিডীয় জ্যামিতির। অঙ্ক ভাবনা’ সেই পরিবর্তনের ধারাকে পাঠকের সামনে আনতে দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশ করে অনইউক্লিডীয় জ্যামিতি’ শীর্ষক প্রবন্ধ। ছবি সহ বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি থেকে অনইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে উত্তরণের নিখুঁত আলোচনা গণিতের ছাত্র না হয়েও অনুসন্ধিৎসু পাঠক পড়তে পারেন। এখানেই কমলকুমার মজুমদারের সার্থকতা।
কিন্তু দুঃখজনক হলওে সত্য পর পর দুটো সংখ্যা প্রকাশতি হওয়ার পর “অঙ্ক ভাবনা” বন্ধ হয়ে যায় ।
প্রশ্ন থেকেই যায়, মৌলিক চিন্তার ফসল ‘অঙ্ক ভাবনা”’ বন্ধ হল কেন। সম্ভবতঃ, বন্ধ হবার কারণ নিয়ে ভাবলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় ভাবনা উন্নত, পরিবেশনা নজর কাড়া হলেও এধরনের পত্রিকা চালানোর প্রধান অন্তরায় বিপণন ও অর্থ জোগান। এ দুটির কোনওটিই একা কমলকুমার মজুমদারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মতো বন্ধুরা কিছু অর্থ সাহায্য করলেও তা যে যথেষ্ট ছিল না এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিপণনের কোনও সার্থক প্রয়াসই ছিল না। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো তার উজ্জ্বল প্রমাণ। দুঃখের হলেও মেনে নিতেই হয় আমাদের সমাজের বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মী অঙ্ক থেকে সহগ্র যোজন দূরে থাকা নিরাপদবোধ করেন; অন্যদিকে গণিত চর্চাকারীরা সাধারণভাবে গল্প উপন্যাস কবিতা পড়লেও নূন্যতম সাহিত্য চর্চা করা থেকে দূরে থাকতে নিজে গর্ববোধ করেন। সুতরাং অঙ্কভাবনা তাদের কোন পক্ষকেই ভাবিত করেনি। অঙ্কভাবনায় প্রকাশিত লেখা স্কুল কলেজের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদেরও নজর কারেনি। প্রকাশিত লেখাগুলোর স্তর ছাত্রছাত্রীদের, ভাবনার স্তরের উপরে ছিল। সর্বোপরি গতানুগতিক পড়ানোয় অভিস্ত বেশিরভাগ শিক্ষক নিজেদের সমৃদ্ধ করে অঙ্কভাবনায় ভাবিত হওয়া এবং তাদের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে অঙ্ক ভাবনার পাঠক করার প্রয়াসও ছিল না। ফলে এই পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ছিল। তবে দেরিতে হলেও সময়ের চাহিদায় পিছু পরিবর্তন হচ্ছে । ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে বাংলায় একাধিক গণিত পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে, হচ্ছে গণিত উৎসব।
"অঙ্ক ভাবনা" কে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের বাংলাদেশের মীজানুর রহমান সাহেব প্রকাশ করেছিলেন “ মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা – গণিত সংখ্যা পর্ব ১ ও ২ । গণিত প্রেমীদের সংগ্রহে রাখার মতো প্রকাশনা ।
তথ্যসূত্রঃ কমলকুমার মজুমদার ও অঙ্ক ভাবনা – হৃত প্রকাশন কোলকাতা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:৪৬