নিশাপুরের ওমর খৈয়ামকে আমরা রুবাইয়াতের কবি হিসেবেই জানি । আর এ কাজটি অর্থাৎ ওমর খৈয়ামকে বাঙ্গালীদের মাঝে যিনি ছড়িয়ে দিলেন তাঁর অনুবাদের মাধ্যমে , তিনি কান্তিচন্দ্র ঘোষ । এ পর্যন্ত ১২০০ রুবাই অর্থাৎ চতু:পদী কবিতা আবিষ্কৃত হয়েছে । কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কবি হিসেবে পরিচিত হওয়ার পূর্বে বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল একজন গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে । গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় তিনি ছিলেন সেকেলের একজন মহাপণ্ডিত ।
পারস্যের খোরাসান প্রদেশের নিশাপুরে তাঁর নিবাস ছিল । আন্দাজ একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর জন্ম হলেও প্রকৃত জন্মতারিখ আজ পর্যন্ত নির্ণীত হয় নি । তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে জন্ম ১০৭১ । তাঁর পুরো নাম ছিল গিয়াস উদ্দিন ইবনে আবুল ফাতাহ ওমর বিন ইব্রাহিম আল খৈয়াম । তবে সংক্ষিপ্ত ওমর খৈয়াম নামেই তিনি পরিচিত ।
তিনি প্রথম জীবনে জ্যোতির্বিদ (Astronomer) হিসেবেই অর্থোপার্জন করতেন । মালিক শাহের দরবারে বিজ্ঞান পরিষদভুক্ত হওয়ার পর নিজ প্রতিভাগুণেই তিনি মুনাজ্জিম -ই-শাহীর রাজজ্যোতির্বিজ্ঞানী পদে প্রতিষ্ঠিত হন । জ্যোতির্বিজ্ঞানও তার অসাধারণ প্রতিভার দানে সমুজ্জল হয়ে রয়েছে । সুলতান অনেক পূর্বে থেকেই পারস্যের প্রচলিত পঞ্জিকার সংস্কার করবার আকাক্সক্ষা মনে মনে পোষণ করেছিলেন । কিন্তু উপস্থিত লোকের অভাবে এবং পঞ্জিকা সংস্কার ধর্মানুমোদিত হবে কিনা এই দ্বিধাতে ভুগছিলেন বলেই তিনি নিজের আকাঙ্ক্ষা বাইরে বিশেষ প্রকাশ করেন নি । ওমরের প্রতিভায় এই অভাব পূর্ণ হওয়ায় তিনি শীঘ্রই অন্য বাধা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহে হন ওলামাদের অভিমত গ্রহন করেন । ওলামাগণ একবাক্যে সংস্কারকার্য সমর্থন করেন ।
এখানে প্রস্ঙ্গত বলে রাখা গেতে পারে যে আরব মুসলিমগণ পারস্য অধিকার করে নিলেও তাদের আচার ব্যবহারের উপর হস্তক্ষেপ করে নি । ধর্মকার্যে হিজরী সন ব্যবহার করলেও অন্যান্য কাজে পারস্যের পুরাতন সনই বজাই ছিল। তাই পঞ্জিকার সংস্কার হওয়ার পূর্ব পয্যন্ত সৌরমাস হিসেবে রাজস্ব আদায় করা হতো কিন্তু ব্যয় হোত চান্দ্রমাস হিসেবে। ফলে রাজকার্যের হিসেবে অনেক অসুবিধা দেখা দিত । ৪৬৭ হিজরী /১০৭৫ খৃস্টাব্দের হিসেবে দেখা যায় রাজকোষ কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছে। এই সমস্ত কারণেই সুলতান প্রচলিত পঞ্জিকার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে চান্দ্রমাসের পরিবর্তে সৌরমাস প্রবর্তনের জন্য দৃঢ প্রয়াসী হন । এই সংস্কারের পূর্বে পারস্যে যে বষপঞ্জী প্রচলিত ছিল সে বিষয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যায় এই সংস্কার কেন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল ।
ওমরের পঞ্জিকা সংস্কার কার্যের সুবিধার জন্য মালিক শাহ ৪৬৬ হিজরী /১০৭৪ খৃ: অব্দে এক মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । ওমর কাজ শুরু করেন ৭ জন সুবিখ্যাত জ্যোতির্বিদ সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রণা পরিষদের মাধ্যমে । এই ৭ জনই ওমরের নির্বাচিত লোক ।
পারস্যের জোরোস্তার ধর্মাবলম্বীদের অনুসৃত বর্ষপঞ্জী খুব সম্ভব খৃ.পৃ. ৫ম শতাব্দী থেকে শুরু হয় । এতে ১২ মাস এবং ৩৬৫ দিনে বৎসর ধরা হোলেও প্রত্যেক মাস ছিল ৩০ দিনের । অতিরিক্ত ৫ দিন জোরোস্তার ধর্ম প্রবর্তনের সময় থেকে বৎসরের শেষ মাস – ইসফানদারাজ মাসের শেষে জুড়ে দেওয়া হোত । ফারসীতে অতিরিক্ত এই নিবেশিত মধ্যস্থকে বলা হোত আন্দারগাহ এবং আরবীতে আলমুসতারাকা।
বর্তমানেও পারস্যের জোরোস্তার এবং ভারতবর্ষের পারসী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বর্ষপঞ্জীতে এই অতিরিক্ত ৫ দিন বৎসরের শেষ মাসের জুড়ে দেওয়ার প্রথাই প্রচলিত আছে ।
যতদূর জানা যায় জোরোস্তার ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিভেদের সৃষ্টি হোলে এক সম্প্রদায়ের বিজ্ঞ পন্ডিতগণ ‘আন্দরগাহ’ বা অতিরিক্ত ৫ দিনের সন্নিবেশন শেষ মাস ‘ইসফানদারাজ’ এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পরিবর্তে পালাক্রমে অন্যান্য মাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রথা প্রবর্তন করেন । তারা নানা প্রকার গণনা করে ঠিক করলেন যে প্রত্যেক ১২০ বৎসরে পালাক্রমে বৎসরের প্রত্যেক মাসে জুড়ে দিতে হবে। এই সংস্কার প্রবর্তন করে প্রথম ১২ বৎসরের প্রথম মাস "ফারওয়ারদিনে’ এই ৫ দিন জুড়ে দেওয়া হোল । পরবর্তী ১২০ বৎসরে ‘ফারওয়অরদিন’ বাদ দিয়ে ২য় মাস ‘আরদিবাহিস্তে’ এই ৫ দিন জুড়ে দেওয়া হোল । তৃতীয় ১২০ বৎসরে জুড়ে দেওয় হোল তৃতীয় মাস ‘খুরদাদ’- এর সঙ্গে। এই ভাবে খুব সম্ভব ৫ম শতাব্দীতে এই ৫ দিন জুড়ে দেওয়া হোল ৮ম মাস ‘আবান’-এ সঙ্গে । নিয়ম করে পালাক্রমে এইভাবে অতিরিক্ত ৫ দিন সৌর বর্ষপঞ্জিতে সরান হোত । এ করা হোত জোরোস্তর ধর্মের ৫ দিন ব্যাপী ৬টি ধমীয় পর্ব ‘গাহানবারে’র সময়সূচী ঠিক রাখার জন্য যাতে এই পর্বগুলি আদিকালে যে সময়ে অনুষ্ঠিত হোত ঠিক সেই সময়েই অনুষ্ঠিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে এই অতিরিক্ত ৫ দিন (epagomenae) হোল জোরোস্তার ধর্মগ্রন্থ আভেস্তা গাথা দিবস । এ হোল ‘গাহানবারে’র ষষ্ঠতম পর্ব । আভেস্তাতে একে বলা হয় Hamaspa Qmatoaya । সেই জন্য এটি সৌর বর্ষপঞ্জীর অন্যান্য ‘গাহানবারের’ মতই এর তারিখও বদলে যেত । পৌর বর্ষপঞ্জীতে এই ভাবে পালাক্রমে ‘গাহানবারের’ ফলে epagomenae এর তারিখ বদলে যাওয়ার প্রথাকে মুসলিম বর্ষপঞ্জীকারদের গ্রন্থে বৎসরে এক মাসে অতিরিক্ত সন্নিবেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । একটি জটিল গাণিতিক অনুশীলনের দ্বারাই এটি ঠিক করা হোত ।
প্রাক- ইসলামে যুগে এই পালাক্রমে অতিরিক্ত ৫ দিনের সন্নিবেশনা সাসানীয় বংশের রাজত্বকালের শেষ দুই শতাব্দীতে লোপ পায়। ফলে মুসলিম রাজত্বকালে পারস্যের দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশসমূহে ৩৯০ হিজরী / ১০০০ সাল পর্যন্ত পূর্বেকার মতই ৮ম মাস ‘আবান’ মাসে ৫ দিন জুড়ে দেওয়ার প্রথাই চলে আসছিল । মালিক শাহ এই প্রথা পরিবর্তনের জন্য পঞ্জিকা সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। ডাক পড়ে ওমর খৈয়ামের ।
জালালী মাসের প্রবর্তনের ফল হোল : (১) পারস্যের সৌর বৎসরের প্রথম দিন হোল বসন্ত বিষুবের দিন (vernal equinox) অর্থাৎ বৎসরের ১ম মাস ফারওয়ারদিনের ১ম দিন। ৪৬৭ হিজরী/১০৭৫ সালে যখন এই সংস্কার সাধিত হচ্ছিল তখন, কিন্তু এই দিনটি লিপইয়ার বা বৎসরের অতিরিক্ত ১/৪ দিন গণনা না করার ফলে , শুরু হতো জুলিয়ান বর্ষপঞ্জীর ২৬ এ ফেব্রুয়ারী । ১ম মাস ফারওয়ারদিনের ১ম দিন এবার ঠিক হোল জুলিয়ান বর্ষপঞ্জীর ১৫ই মার্চ। এই দিন হোল ‘বসন্ত বিষুব’- এর দিন।
(২) প্রত্যেক বৎসর যাতে বৎসরের ১ম দিন এই দিনেই হয় সে জন্য অতিরিক্ত ১/৪ দিনের কথা মনে রেখে প্রত্যেক ৪র্থ বৎসর ৩৬৫ দিনের পরিবর্তে ৩৬৬ হবে বলে ঠিক করা হোল । তবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৎসর (tropical year) এ আরও যে ১১ মিনিট বেশী থাকে তাতে ১২৮ বৎসরে আরও ১ দিন বেড় যায় । এ বিসয়টি অনুধাবন করে জালালী বর্ষপঞ্ঝীতে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হয় ।
সুদীর্ঘ ৩ বৎসরকাল অনন্য অধ্যবসায়, প্রাণপাত পরিশ্রম ও সাধনায় এই সংস্কারকার্য শেষ হয়। সুলতানের নাম অনুসারে এই সংস্কৃত পঞ্জিকার নাম দেওয়া হয় তারিখ-ই- জালালী। এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখা যেতে পারে যে সুলতানের প্রকৃত নাম, সাধারণ ধারণা অনুযায়ী জালাল উদ্দীন নয়, বরং জালারুদদ্দৌলা। জালালী অব্দ ১০ই রমজান ৪৭১ হিজরী/১৬ই মার্চ ১০৭৯ সালের শুক্রবার থেকে আরম্ভ। এই দিন বসন্ত বিষুব ঘটে গ্রীনউইচ সময় ২ ঘ: ৬ মিনিটে এবং ইসফাহানী সময় ৫ ঘঃ ৩৩ মিনিটে। এই সাল প্রচলনের পূর্বে সূর্য মীনলগ্নে অর্ধ মাধ্যাবস্থায় অবস্থান করত বলে ওমর খৈয়াম ফারওয়অরদিন মাসের প্রথম থেকে ( যে সময় দিন রাত সমান, , equinox) বৎসর গণনা আরম্ভ করেন। এই সময় বৎসরের ২৮ দিন অতীত হয়েছিল কিন্তু তবুও ওমর ফারওয়ারদিন মাস থেকেই গণনা আরম্ভ করেন।
ওমরের পঞ্জিকা গণা যে কত সূক্ষ ও নিখুত ছিল সে বর্তমানে প্রচলিত গ্রেগরি পঞ্জিকার (Gregorian Calendar) সঙ্গে তুলনা করলেই সম্যকভাবে বোঝা যাবে। ১৫৮২ খ: অব্দে রোমের ধর্শগুরু পোপ ১৩‘শ গ্রেগরীর রাজত্বকালে খৃস্ট পঞ্জিকার সংস্কার করা হয়। এর সঙ্গে ওমরের পঞ্জিাকার তুলনা করে পাশ্চাত্য পন্ডিপতমন্ডলী একবাক্যে ওমরের পঞ্জিকার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেন। তাদের মতে গ্রেগরী পঞ্জিকার চেয়ে জালালী পঞ্জিকা সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ , সূক্ষ ও সমীচীন। ওমরের সংস্কারপ্রণালী রাজকার্য়ের জন্য সবদিক দিয়ে সুবিধাজনক। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এডওয়অর্ড গীবনের মতে জুলিয়াস সীজরের প্রবর্তিত পঞ্জিকার চেয়ে জালালী পঞ্জিকা গণনার সূক্ষতায় ও ভ্রমশূর্ন হিসেবে অধিকতর উৎকৃষ্ট । গীবনের কথায় , a computation of time which surpasses the julian and approaches the accuracy of the Gregorion style ( ইসলামিক বিশ্বকোষ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ৬ষ্ট খন্ড, পৃ.৪৬ )
ওমরের এই সংস্কারের বহু ভাষ্য দেখা যায়। এখানে তিনটি ভাষ্যের কথা উল্লেখ করা গেল । প্রথমটি হোল ১৪ শ শতাব্দার শিরাজী মাহমুদ ইবন মাসুদ ইবন মুসলিহ কুতুব উদ্দীন ,মৃ: ৭১১/১৩১১ কর্তৃক। তার মতে এতে ৭০ বৎসরের ১৭টি দিন আছে এবং তার ভাষ্য অনুসারে এতে ১৫৪০ বৎসরের গণনায় ১ দিন ভুল হবে । দ্বিতীয়টি হোল ১৫শ শতাব্দীর বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক উলুগবেগ ৭৯৬/১৪৯৪- ৮৫৩/১৪৪৯ কর্তৃক। তার মতে এতে ৬২ বৎসরে ১৫টি intercalary দিন পাওয়া যাবে এবং ৩৭৭০ বৎসরের গণনায় ১ দিন ভুল হবে । তৃতীয়টি হোল বর্তমান ভাষ্য । এ ভাষ্য অনুসারে এতে ৩৩ বৎসরে ৮ টি intercalary দিন পাওয়া যাবে এবং ৫০০০ বৎসরের গণনায় ১ দিন ভুল হবে । গ্রেগরী পঞ্জিকা অনুসারে ৩৩৩০ বৎসরে গণনায় ১ দিন ভুল হয়।
ওমরের মানমন্দিরের স্থান সম্বন্ধে মতভেদে দেখা যায়। কারুর মতে এ ছিল রাইতে, কারুর মতে নিশাপুরে, কারুর মতে ইস্পাহানে। ফিটজজের্যান্ডের মতে এই পঞ্জিকা সংস্কার ও জালালী সাল প্রবর্তনের কাজ হয়েছিল মার্ভেতে।
যাহোক প্রধানত পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য মানমন্দিরের কাজ করলেও, ওমর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যান্য অংশকেও উপেক্ষা করেন নি। নিজের ও সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণের ফল লিপিবদ্ধ করে তিনি একটি যীজ অর্থাৎ জ্যোতিষীয় তালিকা তৈরী করেন। হাজী খলিফার মতে রাজভক্তির নিদর্শনস্বরূপ তিনি পঞ্জিকার মতই মালিক শাহের নাম অনুসারে এর নাম রাখেন“আলযীজ-ই-মালিকশাহী”।
ওমরের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে কতকগুলো রুবাইয়াত এবং অন্য দিকে সম্পূর্ণ নির্ভুল সৌর পঞ্জিকা প্রণয়ন থেকে যে কথাটি মনে হয় সে হোল, তিনি কি তখনকার ভূ-সৌর পঞ্জিকা প্রণয়ন থেকে যে কথাটি মনে হয় সে হোল, তিনি কি তখনকার ভূ-কেদ্রিক geo-centric মতবাদ সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন এবং সূর্যকেদ্রিক helio centric মতবাদের আচ করছিলেন? তার একটি রুবাইয়াতে দেখা যায় যে তিনি গ্রহগুলিকে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলে বর্ণনা করেছেন। রুবাইয়াতটি হোল:
ঘূর্ণমান ঐ কুগ্রহ ঐ কুগ্রহ-দল-সদাই যারা ভয় দেখায় -
ঘুরছে ওরা ভোজবাজির ঐ লণ্ঠনেরই ছায়ার প্রায়।
সূর্য যেন মোমবাতি আর ছায়া যেন পৃথ্বী এই,
কাপছি মোরা মানুষ যেন প্রতিকৃতি আকা তায়।
ফিটজজের্যাল্ড – অনুবাদের বিশেষ সংস্করণের সম্পাদক অধ্যাপক মেইন তার ভূমিকাতে এ বিষয়ে তার মনে এ সম্বন্ধে যে প্রশ্ন জেগে ওঠে তা প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, তবে ওমর কি জানতেন যে পৃথিবী মহাশূন্য-পথে পরিভ্রমণ করে এবং সূর্যের চার দিকের্ ঘুরছে। সমগ্র সৌরমন্ডলও কি আরও বৃহত্তর মহাশূন্য পথে পরিভ্রশণ করছে? প্রাচীন মিশরীয়দের এমনি একটা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রাচ্যের জ্ঞানী ব্যক্তিগণও খুব সম্ভব এ জ্ঞান পোষণ করতেন। Main G.F Rubiaiyat of Omar Khayyam , bgy Ed . FitzGerald. Landon. Collins. 1963.p.32
ওমরের রুবাইয়াতে সূর্যের ৭ টি গ্রহের কথাও উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। তার একটা রুবাইয়াত হোল:
দশ বিদ্যা, আপট স্বর্গ, সাত গ্রহ আর নয় গগন
করল স্রষ্টা সৃষ্টি রে ভাই , দেখছে যাহা জ্ঞান-নয়ন।
চার উপাদান, ইন্দ্রিয় পাচ, আত্মা তিন ও দুই জগৎ-
পারল না সে সৃষ্টি করতে আরেকটি লোক মোর মতন।
মার্ভের মানমন্দিরে গবেষণা করতে করতে তিনি একটা গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন এবং গ্রহটির নামকরণ করেছিলেন পৃষ্ঠপোষক জালালদদ্দৌলার এ নাম অনুসারে ‘জালাল’। কারুর কারুর মতে এই গ্রহটি হোল বর্তমানে ইউরেনাস নামে পরিচিত গ্রহ। (ইসলামিক বিশ্বকোষ, পৃ.৪৬)
পারস্যে জালালী সন বেশী দিন না চললেও এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে সেখানকার রাষ্ট্রীয় সালের পাশাপাশি জালালী সালও উল্লিখিত হোত। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে হিজরী সালের পাশাপাশি এই জালালী সালও প্রচলিত ছিল। সম্রাট আকবরের ৯৬৭/১৫৬০-১০১৪/১৬৫০ সভাসদ আবুল ফজল তার আকবরনামা তে বলেছেন। সম্রাট আকবর ৪৭৭ জালালী সনে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
বর্তমান ইরানী সাল ১৯২৫ সালে প্রচলিত হয়। এই সালটি একই সঙ্গে হিজরী ওসৌরবর্ষের সমন্বয়ে পরিকল্পিত হয়েছে এবং এই সৌরবর্ষের গণনা ওমরের জালালী সালের গণনাকে ভিত্তি করে করা হয়েছে। বর্তমানের বঙ্গাব্দ সম্রাট আকবরের ফসলী সাল বা আকবরী সন এই জালালী সনের প্রত্যক্ষ অনুসৃত ।
প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই, বিশেষ করে মধ্যযুগ, জ্যোতিষিক গণনার জন্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করা হোত। প্রত্যেক জ্যোতির্র্বিদই তাই জ্যোতিষ নিয়েও আলোচিনা করেছেন। ওমর খৈয়ামও এর হাত থেকে রেহাই পান নি । সুলতানের আদেশ অনুযায়ী তাকে অনেক সময় অন্যান্য জ্যোতির্বিদের গণনা, ভবিষ্যদ্বাণীর বিচার ও গণনার অভিমত সম্বন্ধে চূড়ান্ত অভিমত দিতে হোত । এ ছাড়া সুলতানের কাজের জন্য নৃপতিদের এই আগ্রহের কারণ বোঝা মুস্কিল । এর মধ্যে বোধ হয় মানব মনের চিরদুর্বলতা ছাড়া অন্য কিছুই নেই। অনেক সময় গণনা অনুযায়ী ফল না হোলে জ্যোতিষীগণের লাঞ্চনারও সীমা থাকত না । ওমর খৈয়ামের জীবনকালেও এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে বলে জানা যায় । চাহার মাকালা’য় এমনি একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। মালিক শাহের রাজত্বকালে আরব নরপতি সাদাকা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন । পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি বাগদাদ আক্রমণ করতে রওয়ানা হয়ে পড়েন । মালিক শাহ এই বিদ্রোহ দমনের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করার ভার দেন এক ইস্পাহানী জ্যোতিষীর উপর । জ্যোতিষী গণনায় এক সপ্তাহের মধ্যে কোন শুভদিন খুজে পান নি। তিনি সুলতানকে সেই কথাই জানান । কিন্তু সুলতান এত দেরী করতে রাজী হতে পারেন নি । তিনি জ্যোতিষীকে শীঘ্র শুভ মুহূর্ত নির্ধারণ করতে আদেশ দেন; জ্যোতিষী অনন্যোপায় হয়ে প্রাণভয়ে ইস্পাহান থেকে পলায়ন করেন। একজন বিদেশী জ্যোতিষীও এই সময় ইস্পাহানে বাস করতেন। তিনি রাজঅনুগ্রহ লাভের এ সুযোগ না হারিয়ে একটি মুহূর্ত নির্ধারণ করে দেন্ সুলতান সেই অনুযায়ী বিদ্রোহ দমনে গমন করেন এবং আরব নরপতি সাদাকাকে পরাজিত করতে সর্ম হন। ইতিমধ্যে পলায়নপর ইস্পাহানী জ্যোতিষী ও পথিমধ্যে ধৃত হয়ে বন্দী হন। বাদশাহ বিদেশী জ্যোতিষীকে পুরস্কৃত করেন এবং ইস্পাহানী জ্যোতিষীকে বিশ্বসঘাকতক হিসেবে বিচারের আদেশ দেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হোল তিনি সাদাকার নিকট থেকে ঘুষ খেয়ে শুভমুহূর্ত নির্ধেশ করে দেননি । জ্যোতিষী কিন্তু জানান তার গণনায় কোন ভুল হয় নি। গণনায় যে সব লগ্ন পাওয়া গিয়েছিল তার সবই অশুভ। জ্যোতিষীরা অশুভ মুহূর্তে কোন কাজ কোনো কাজ করার পরামর্শ দিতে ভয় পান- সেইজন্যেই তিনি পলায়ন করেছিলেন । তার গণনার সতাসত্য বিচারের জন্য তিনি ওমর খৈয়ামের নিকট তার গণনা পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব করেন । সুলতান তৎক্ষণাৎ নিশাপুরে ওমরের নিকট গণনা করবার জন্য দূত প্রেরণ করেন। ওমর গণনা করে সুলতানকে জানান যে ইস্পাহানী জ্যোতিষীর গণনা নির্ভল। জ্যোতিষীর প্রাণ রক্ষা পায়।
ওমর নিজে জ্যোতিষে কতটা শ্রদ্ধাবান ছিলেন বলা যায় না। তবে তিনি যে ভবিষ্যদ্বণী করতেন সে বিষয়ে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। তার প্রিয় ছাত্র সুপন্ডিত নিজামী আরুজী তার চাহার মাকাল গ্রন্থে এ সম্বন্ধে দুইটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। নিজামীর কথাতেই এখানে ঘটনা দুটির উল্লেখ করা গেল।
৫০৬ হিজরীতে খোয়াজা ইমাম ওমর খৈয়াম এবং খোয়াজা ইমাম মজাফ্ফর আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে ওমর খৈয়াম বললেন আমার এমন স্থানে কবর হবে যে মৌসুমী বায়ুর প্রতিটি প্রবাহ আমার কবরের উপরের ফুল ঝরিয়ে দেবে। তার কথা তখন আমি বিশ্বাস করি নি।
এই ঘটনার ২৫ বৎসর পরে একবার নিশাপুরে যাই। তখন ওমর ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তার ভবিষ্যদ্বানীর কথা স্মরণ হয়। এ বাণী কতদূর সফল হয়েছে দেখবার জন্যে আমি একজন পথ প্রদর্শককে সঙ্গে নিয়ে সাবই-জুম্মার দিন তার কবর দেখতে যাই । হীরা গোরস্থানের বামদিকে দেওয়ালের কোণে তার কবর রয়েছে । কবরের চার ধার লাল পীচ এবং নাসপাতি ফুল ঝরে পড়ছে কবরের উপর । তার বলখ নগরের ভবিষ্যদ্ববাণীর কথা মনে পড়ল। তার কথা স্মরণ করে তার প্রত্যেকটি বানী সফল হয়েছে দেখে আমি আর ক্রন্দন সম্বরণ করতে পারলাম না ।
“অন্য ঘটনাটি হোল নৃপতির শিকার সম্বন্ধে । বোখারার নৃপতি সুলতান খাকান শামস-উল-মূলক ওমরকে শিকারের জন্য একটি শুভ দিন স্থির করে দেবার আদেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গে এ আদেশও দেন যে দিনটিতে যেন মেঘের কোন চিহ্নও না থাকে এবং আকাশ পরিষ্কার হয়। ওমর খৈয়াম দুইদিন গণনার পর একটি দিন স্থির করে দেন এবং নিজেও সুলতানের শিকার যাত্রার সঙ্গী হন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরই সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে ফেলল। রাজপরিষদগণ ওমরকে বিদ্রুপ করা শুরু করল। সুলতানও বিমর্ষ চিত্তে ফিরে যাওয়অর আদেশ দিলেন । ওমর কিন্তু দৃঢ চিত্ত । তিনি বললেন এ মেঘ দেখে চিন্তা করবার কোন কারণই নেই। এক ঘন্টায় মধ্যে আকাশ মেঘশূন্য হয়ে পড়বে এবং ৫ দিন পর্যন্ত মেঘশূন্য থাকবে। ওমরের ভবিষ্যদ্বাণী একটুও ক্ষুন্ন হয়নি।
একজন গনিতবিদ হিসেবে , গণিতশাস্ত্রে তাঁর মৌলিক অবদান হচ্ছে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করা ।
যতদূর জানা যায় , ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে ওমর খৈয়ামের মৃত্যু হয় ।
রেফারেন্সঃ
১) ইসলামিক বিশ্বকোষ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা
২) Main G.F Rubiaiyat of Omar Khayyam , bgy Ed . FitzGerald. Landon. Collins.
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২২