১. আইনের সাধারণ নীতি হচ্ছে আইনদ্বারা মানুষের কোন কর্ম যেদিন অপরাধ হিসেবে সাব্যস্থ হবে সেদিন থেকে ঐ কর্ম বিচারের আওতাভুক্ত হবে, সাব্যস্থ হওয়ার আগের ঘটনা ঐ অপরাধে বিচারের আওতায় আসবে না। অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ ভূতাপেক্ষ করা যায় না। আইন বিজ্ঞানে এই নীতি ল্যাটিন ভাষায় Nullum crimen, nulla poena sine praevia lege poenali বা "No crime, no punishment without a previous penal law" হিসেবে বহুল পরিচিত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫। (১) অনুচ্ছেদে এই নীত স্বীকৃত হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।'
পক্ষান্তরে আন্তর্জতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে যে ৩(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ, এই আইন প্রণয়নের আগে অথবা পরে সংগঠিত হয়ে থাকলেও তা ট্রাইবুনাল কর্তৃক বিচারযোগ্য হবে। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সংবিধানের আইন প্রণয়নের পর বলবৎ হওয়ার নীতির ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।
২. সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে আইনের ভূতাপেক্ষ প্রয়োগ রহিত করায় এবং তা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইনের ৩(১) ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সংবিধানের ৪৭(৩) অনচ্ছেদে এই ব্যতিক্রমের বৈধতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা অন্য কোন ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না ।'
৩. একটি দেশের সকল নাগরিক আইনে একই মর্যাদা লাভ করা নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে ২৭ অনুচ্ছেদে এই অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।' পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইনে অভিযুক্তব্যাক্তিগণ বিচারের ক্ষেত্রে অন্যান্য নাগরিকের মতো বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফৌজাদারি মামলা সমূহে ফৌজাদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং সাক্ষ্যগ্রহনে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য হলেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইনের ২৩ ধারায় অভিযুক্তদের ঐ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে যে ফৌজাদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের বিধান সমূহ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইনে প্রযোজ্য হবে না।
৪. সাধারণ আইনে রায় ব্যতীত অন্যান্য আদেশের বিরুদ্ধে আপীলের সূযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইনের ২১ ধারায় কেবলমাত্র চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সীমিত সময়ের মধ্যে আপীলের অধিকার দেয়া হয়েছে।
৫. মৌলিক অধিকার বলবতে সংবিধানের ১০২ ধারা মোতাবেক যে কোন নাগরিক সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৪৭ক (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারাধীন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত যেসব আইন প্রযোজ্য হয়, ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীন নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হবে না। ফলে কার্যত বাংলাদেশের সকল নাগরিকদের জন্যে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকলেও আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে এই অধিকারের ব্যত্যয় ঘটলো। তদুপরি একই অনুচ্ছেদের (২) উপ অনুচ্ছেদে সুপ্রীমকোর্টে চুড়ান্ত রায় ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে আপীলের অধিকার রহিত করা হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের জন্যে সংবিধানের সকল বিধান সমভাবে প্রযোজ্য নয়। একজন সাধারণ নাগরিক ফৌজদারি অপরাধে বিচারের ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা লাভ করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযুক্তদের জন্যে সেসব সুবিধা কতিপয় ক্ষেত্রে রহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, যুদ্ধপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত নূরেনবার্গ ও টোকিও সামরিক আদালতের ট্রায়ালেও আইনপ্রয়োগে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। নূরেনবার্গ ট্রায়ালের আইনগত ভিত্তি ছিল ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্টে প্রণীত লন্ডন চার্টার (London Charter of the International Military Tribunal )। লন্ডন চার্টারের ভিত্তি ছিল ১৯৪৩ সালে মস্কো কনফারেন্সে গৃহীত মস্কো ঘোষণা। কিন্তু মস্কো ঘোষণায় জার্মানীর সম্মতি না থাকায় আন্তর্জাতিক আইনে ঐ ঘোষণা জার্মানীর উপর বাধ্যতামূলক ছিল না। তারপরও ঐ বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে বিজয়ী শক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতাবলে। তবে নূরেনবার্গ ট্রায়ালের পর থেকে যুদ্ধপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩ সালে প্রণীত হলেও ২০০৯ ও ২০১২ সালে এ আইন পুনরায় সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু হাল আমলে এই সব সংশোধনী আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী চলমান বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তনকে প্রতিফলনের পরিবর্তে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়টিকে কঠিনতরো করে তুলেছে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে International Covenant on Civil and Political Rights বা আইসিসিপিআর অনুমোদন করেছে। আইসিসিপিআর অনুযায়ী 'All persons shall be equal before the courts and tribunals.' এবং বাংলাদেশ ২০০০ সালে এই নীতি অনুসরণের প্রশ্নে সম্মতি প্রদান করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ১ম সংশোধনী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩ ঐ নীতির সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা উপরের আলোচনা থেকেই অনুমান করা যেতে পারে।
পূর্ব সুত্র:
১. যুদ্ধপরাধের বিচারঃ ১ম কিস্তি - যুদ্ধপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক আইনের বিবর্তন
২.যুদ্ধপরাধের বিচারঃ ২য় কিস্তি - বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩ ও রোম স্ট্যাটুস-এর বৈশিষ্ঠসমূহের তুলনামূলক পর্যালোচনা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৫১