
সম্প্রতি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন ১৯৭৩ মোতাবেক ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারি এবং পাকিস্তান বাহিনীকে সহায়তাকারিদের বিভিন্ন দুস্কর্মের জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার হচ্ছে। এ নিয়ে উৎসাহের যেমন কমতি নেই, তেমনি কোন কোন পক্ষ বিচারের মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সেজন্যে যুদ্ধপরাধের বিচারের বিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন ১৯৭৩ মোতাবেক বাংলাদেশে যে নীতি অনুসরণ করে বিচার হচ্ছে সে বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
প্রাচীনকালে যুদ্ধের জন্যে সুস্পষ্ট কোন সম্মত নীতিমালা ছিল না। সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ জয়ের জন্যে যেকোন ব্যবস্থা নেবে এবং যুদ্ধের শেষে পরাজিত সৈন্যদের ও সেই দেশের জনগণকে কচুকাটা করবে বা দাস হিসেবে আয়ত্ব করবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। ইহুদী গ্রন্থ প্রাচীন টেস্টামেন্টে সর্ব প্রথম নির্দেশনা হিসেবে যুদ্ধের সময় ফলবান বৃক্ষরাজি ধ্বংস না করার নীতি পাওয়া যায়। চতুর্থ শতাব্দিতে ক্রিস্টান সেইন্ট রোম অধিবাসী অগাস্টিন (Saint Augustine 354–430 A.D.) সর্ব প্রথম ন্যায় যুদ্ধের ধারণার অবতারণা করেন। পরবর্তীতে ইসলামের অভ্যুদয়ের সাথে যুদ্ধ আইনের ধারা কিছুটা উন্নতি লাভ করে। সুরা আল বাকারায় উল্লেখ করা হয় যে যুদ্ধে একজন মুসলমান আত্মরক্ষার্থে পাল্টা আঘাত হানবে, তবে শত্রু আক্রমণ বন্ধ করলে মুসলমানরা তাদের উপর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে। সপ্তম শতকে খলীফা আবু বকর যুদ্ধের জন্যে যে দশটি আদেশ (এ নিয়ে কিছুটা মতান্তর আছে) দেন তা যুদ্ধ নীতিমালায় বড় ধরণের সংযোজন। তিনি যুদ্ধে প্রতারণার কৌশল নিষিদ্ধ করেন, শত্রুর লাশকে অসম্মান না করা, শিশু, নারী ও বৃদ্ধলোককে হত্যা নিষিদ্ধ করেন। ফলবান গাছ ধ্বংস না করারও নির্দেশ প্রদান করেন। তবে যুদ্ধপরাধের ধারণার উদ্ভবে সবচেয়ে সহায়ক ছিল আমেরিকার সৈন্যদের জন্য ১৮৬৩ সালে ফ্রান্সিস লিবার প্রণীত নির্দেশাবলী যা ইতিহাসে লিবার কোড নামে খ্যাত। লিবারকোড আন্তর্জাতিক আইন ছিল না, এর প্রয়োগ ছিল আমেরিকার সৈন্যদের মাঝে সীমাবদ্ধ। তবে যুদ্ধের নীতির অগ্রগতি যাইহোক না কেন যুদ্ধপরাধের বিচারের ধারণার উদ্ভব ঘটে ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময়।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী কর্তৃক পরাজিত অক্ষশক্তির দ্বারা সংগঠিত যুদ্ধপরাধের বিচারের জন্যে একটি কমিশন গঠন করে। তবে এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়। মিত্রদের নিজেদের মধ্যে এবং মিত্র ও জার্মানীর মধ্যে মতান্তরের জন্যে পরাজিত জার্মানদের বিচার জয়ীদেশগুলো করতে ব্যর্থ হয় এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে খোদ জার্মানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জার্মান লোকদেখানো কিছু বিচার করে সামান্য শাস্তি দিয়ে বিষয়টি নিস্পত্তি করে, এ বিচার ইতিহাসে লাইপজিগ যুদ্ধপরাধ ট্রায়াল নামে পরিচিত।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধপরাধের বিচারে বড় ধরণের অগ্রগতি ঘটে।

মিত্রবাহিনী যুদ্ধে জার্মানী ও জাপানীদের পরাজিত করার পর যথাক্রমে নুরেনবার্গ আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইবুনাল ১৯৪৫ এবং দুর প্রাচ্যের জন্য আন্তর্জাতিক মিলিটারি আদালত ১৯৪৬ গঠন করে বিচারকার্য সম্পন্ন করে। বাংলাদেশে যুদ্ধপরাধের বিচারে অনেকে নূরেনবার্গ ট্রাইবুনালের বিচারের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু নূরেনবার্গ ট্রাইবুনালের

প্রথমদিককার বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রবল সমালোচনা রয়েছে। নানা কারণে এ দুটো বিচার অত্যন্ত বিতর্কিত। প্রথমত নূরেনবার্গ সামরিক আদালত গঠনের আগে যুদ্ধপরাধের বিচারের জন্যে সম্মত কোন আইন ছিল না। নূরেনবার্গ ট্রায়ালের আইনগত মূল ভিত্তি ছিল ১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন। এছাড়া ১৯৪৩ সালের মস্কো ডিক্লারেশন ও ১৯৪৫ সালের পোস্টডাম ডিক্লারেশন। কিন্তু এসব আইনে জার্মানী বা জাপানের পূর্বসম্মতি না থাকায় তা তাদের উপর আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা ছিল না। মস্কো ও পোস্টডাম ডিক্লারেশন ছিল মিত্র বাহিনীর একতরফা সিদ্ধান্ত। তারপরও বিজয়ী রাষ্ট্রসমূহ পরাজিত জার্মান ও জাপানের সৈন্যদের বিচার করে। মিত্র বাহিনীর পক্ষে বিচারের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে অবশ্য আত্মসমর্পন দলিলে দোষী ব্যাক্তিদের বিচারের উল্লেখ থাকার বিষয়ে জোর দেয়া হয়। উল্লেখযোগ্য যে ঐ সময় বৃটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধেও যুদ্ধপরাধের অভিযোগ উঠে। বিশেষত জার্মানীর ড্রেসডেন শহরে বৃটিশবাহিনী কর্তৃক বোমাবর্ষন করে ১০ হাজার নীরিহ জনগণকে হত্যা করা এবং আমেরিকা কর্তৃক নাগাসাকি ও হিরোশিমা শহরে আনবিক বোমাবর্ষণ করে

লক্ষাধিক নীরিহ বেসামরিক লোক হত্যা জার্মানীর প্রচন্ড দুস্কর্মকে ছাড়িয়ে গেলেও এর বিচার হয়নি, যেজন্যে নূরেনবার্গ ট্রায়ালকে অনেকে বিজয়ীর একতরফা বিচার হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। নূরেনবার্গ ট্রায়েলের আইনগত বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যেকোন দেশের আইন ব্যবস্থায় কোন কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় ঐ কাজকে আইনদ্বারা অপরাধ ঘোষণার পর থেকে। নূরেনবার্গ ট্রায়েলে ১৯৪৫ সালে প্রণীত লন্ডন চার্টারের ভিত্তিতে ১৯৪৫ সালের আগে সংঘটিত কাজকে অপরাধগণ্যে বিচার করায় খোদ তৎকালীন মার্কিন প্রধান বিচারপতি Harlan Fiske Stone নূরেনবার্গ ট্রায়ালকে ফ্রড বলে অভিহিত করেন। নূরেনবার্গ ট্রায়ালে জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গের অভিযোগও আনা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জেনেভা কনভেনশন সেই সব রাষ্ট্রের উপর প্রয়োগ হয়, যারা এই কনভেনশনসমূহ রেটিফাই করেছে। নূরেনবার্গ ট্রায়ালের অন্যতম পক্ষ রাশিয়া জেনেভা কনভেনশন রেটিফা্ই না করেই বিচারের অন্যতম পক্ষ হয়েছিল। নূরেনবার্গ ট্রায়ালের বড় ত্রুটি ছিল বিচারপতিদের কেবলমাত্র বিজয়ী দেশসমূহ থেকে নির্বাচন করা। ফলে বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
যুদ্ধপরাধ আইনের বিবর্তনের ধারায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ১৯৪৯ সালের ৪র্থ কনভেনশনের জন্যে। উল্লেখ্য ১ম জেনেভা কনভেনশন ১৮৬৪ সালে সেনাবাহিনীর আহত ও রুগ্ন সৈন্যদের নিরাপত্তার জন্যে প্রণীত হয়। ২য় জেনেভা কনভেনশন ১৯০৬ সালে সমুদ্রে সশস্ত্র বাহিনীর আহত, রুগ্ন ও ডুবন্ত জাহাজের সৈন্যদের নিরাপত্তার জন্য প্রণীত হয়। ৩য় জেনেভা কনভেনশন ১৯২৯ বন্দী সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য প্রণীত হয় এবং ৪র্থ জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ প্রণীত হয় যুদ্ধে বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে। এছাড়া জেনেভা কনভেনশনের ৩টি প্রটকল রয়েছে। ১৯৭৭ সালের দুটো প্রটকলে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধকেও কনভেনশনের আওতায় আনা হয়। জেনেভা কনভেনশন ঐসব রাষ্ট্রের উপর প্রয়োগযোগ্য যারা এই কনভেনশন মেনে স্বাক্ষর করেছে। জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগের দায়িত্ব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উপর। কিন্তু এতকিছুর পরও বিশ্বে যুদ্ধের প্রকোপ হ্রাস পায়নি। এর মধ্যে সংঘটিত হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ভারত-চীন যুদ্ধ, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন জড়িত থাকায় সেখানে সংঘটিত গণহত্যা ও বেসামরিক জনগণের উপর বোমাহামলাসহ নানা উপদ্রবের জন্যে বিচার দূরের কথা কোন কমিশনও গঠিত হয়নি। কেবল মাইলাই গ্রামের

ভয়াবহ গণহত্যা মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ণ তুললে, আমেরিকা তার অভ্যন্তরীণ আইনে মূল আসামীদের বাদ দিয়ে বলির পাঠা হিসেবে ল্যাফটেন্যান্ট কেরীকে যৎসামান্য শাস্তি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে।
নূরেনবার্গ ট্রায়ালে প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৯৩ সালের মে মাসে বলকান এলাকা কেবল রণক্ষেত্র নয়, স্মরণকালের গণহত্যা, জাতিগত সহিংসতা ব্যাপকাকার ধারণ করে। জাতিগতনির্মূল ঠেকাতে ও শান্তি স্থাপনের জন্যে নিরাপত্ত পরিষদ অর্পিত ক্ষমতাবলে আইসিটিওয়াই (International Criminal Tribunal for the Prosecution of Persons Responsible for Serious Violations of In ternational Humanitarian Law Committed in the Territory of the Former Yugoslavia since 1991) গঠন করে। দি হ্যাগ শহরে এ আইনের অধিনে সার্বনেতা ও সেনাপতিদের বিচার চলমান রয়েছে।
১৯৯৪ সালে রূয়ান্ডায় হুটু ও তুতসি সম্প্রদায়ের মধ্যে গণহত্যা ও জাতিগত সহিংসতা ব্যাপকাকার ধারণ করলে গণহত্যার বিচারের জন্য নিরাপত্ত পরিষদ গঠন করে আইসিটিআর (International Criminal Tribunal for the Prosecution of Persons Responsible for Genocide and Other Serious Violations of International Humanitarian Law Committed in the Territory of Rwanda.) এদুটো ট্রাইবুনালই গঠনের দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক। এছাড়া ট্রাইবুনালের অবস্থান ছিল সংশ্লিষ্ট দেশের বাইরে, দি হেগ ও তানজানিয়ার একটি শহরে এবং শাস্তির ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড রহিত ছিল। এছাড়া ছিল আসামীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের অবাধ অধিকার।
১৯৯৮ সালে যুদ্ধপরাধের বিচারে জাতিসংঘ কর্তৃক স্থায়ী আদালত গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধপরাধের বিচারে সর্বাধিক অগ্রগতি সাধিত হয়। ১২০ দেশ ইতালির রোম শহরে নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে যুদ্ধপরাধের বিচারের জন্যে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি স্থাপনে সম্মত হয়।

২০০২ সালের ১ জুলাই দি হেগ শহরে এই আদালত কার্যক্রম শুরু করে। যুদ্ধপরাধের বিচারে মানবজাতির ইতিহাসে এটাই সর্বশেষ অগ্রগতি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৮