রামায়নে অপহৃত সীতার অন্বেষণে সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশঃ
ব্রহ্মপুত্র তরি রঙ্গে করিহ প্রবেশ
মন্দর পর্বতে যাইও কিরাতের দেশ।।
যাইবে কর্ণাট দেশ আর শাকদ্বীপে।
কিরাত জানিবা আছে অত্যদ্ভুত রূপে।।
কনক চাপার মত শরীরের বর্ণ।
ঊঠানখানার মত ধরে দুই কর্ণ।।
থালাহেন মুখখান তাম্রবর্ণ কেশ।
এক পাশে চলে পথ বলেতে বিশেষ।।
(কৃত্তিবাসী রামায়ন, রাজেন্দ্র লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ, পৃ ২৩৩)
উপমহাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতরাজী, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পূর্বে মণিপুর, ত্রিপুরা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলময় পাহাড় পর্বত। তাই এ তিন দিক থেকে ভারতে কোন মানবগোষ্ঠির আগমণ তুলনামূলকভাবে কঠিন ছিল। পশ্চিম দিক ছিল সহজতর। তাই পশ্চিম থেকেই বেশীর ভাগ মানুষের এসেছে উপমহাদেশে। তবে প্রাচীনকালের কষ্টসহিসষ্ণু সংগ্রামী মানবজাতির জন্য উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা কোন দুর্ভেদ্য প্রাচীর ছ্লিনা। হিমালয়ের পাদদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে বসবাসরত মঙ্গোলীয জনগোষ্ঠির প্রভার উপমহাদেশের জনতত্বতে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।
আর্যজাতির আগমণের পূর্ব থেকেই উত্তর-পূর্ব ভারত ছিল মঙ্গোলিয় জাতির আবাসস্থল। তাদের পরিচিতি ছিল কিরাত। মহাভারত, রামায়ন, কালিকাপুরাণ, যোগিনীতন্ত্রে কিরাতের দেশকে ‘‘প্রাগজ্যোতিষপুর’’ বলে আখ্যাযিত করা হয়েছে। প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্য আসামের পূর্ব সীমান্ত থেকে পশ্চিমে উত্তর ভারতপর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রাগজ্যোতিষপুর পরবর্তীতে কামরূপ রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। কিরাতগণ আর্যদের পূর্ব থেকে প্রাগজ্যোতিষপুরের বাসিন্দা। সেজন্য রাবণ সীতাহরণ করার পর সীতার অন্বেষণে বিভিন্ন দিকে যখন সৈন্যদল প্রেরণ করা হয় তখন তাদেরকে কিরাতের দেশেও অনুসন্ধান চালানোর আদেশ দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে বুঝা যায় যে প্রাচীন কামরূপ বা প্রাকজ্যোতিষপুরের বাসিন্দারা ছিল কিরাত। তাদের "কনক চাপার মত শরীরের বর্ণ” কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে কিরাতগণ মঙ্গোলিয় নরগোষ্ঠির অন্তর্গত। আসামের পূর্বদিকের গিরিপথ বেয়ে কিরাত জাতি প্রাগজ্যোতিষপুর আগমণ করে এবং রাজ্য স্থাপন করে। মহাভারতের কাহিনীতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। মহাভারতে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রাগজ্যাতিষপুর ছিল দানব বংশীয় অসুরদের রাজ্য। জনকের যজ্ঞভূমিতে জন্মলাভ করা নারায়নের পুত্র নরক পিতার সহায়তায় প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ঘটকাসুরকে বধ করে, সেখানে রাজ্য স্থাপন করেন (^ সুত্র ১৪) । নরকের পুত্র ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে লড়াই করে নিহত হন। মহাভারতে ভগদত্তকে কিরাত, চীনা ও ম্লেচ্ছদের রাজা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মঙ্গোলিয় জাতির উপস্থিতি থাকলেও, উপমহাদেশে তাদের প্রাচীন কোন সভ্যতার চিহ্ন দেখা যায় না এবং প্রাগজ্যোতিষপুর দখলের পর আর্য ও মঙ্গোলিয় জাতির মধ্যে কোন দ্বন্দ্বও পরিলক্ষিত হয় না। সম্ভবত প্রাগজ্যোতিষপুরে আর্য জাতির শাসন কায়েমের পর সেখানে মঙ্গোলিয়দের উপর জাতিগত নিপীড়নের পরিবর্তে উভয় দলের সন্মিলনের বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ভগদত্তের সেনা বাহিনীতে চৈনিক সৈন্যদের উপস্থিতি ঐ সন্মিলনীর বড় প্রমাণ। আর্যদের সাথে মঙ্গোলিয় জাতির বিরোধ নিস্পত্তি হয়ে যাওয়ায় জাতিগত মিশ্রণ যে ব্যাপক হয়েছে, তা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। কেউ কেউ মনে করেন ভগবান বুদ্ধ ও ঋষি বাল্মিকী কিরাত জাতির লোক। এমনকি শিবকেও কিরাত সভ্যতার অবদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ থেকে আর্যদের সাথে কিরাত তথা মঙ্গোলিয় জাতির ব্যাপক মিশ্রণের বিবরণ অবহিত হওয়া যায়।
বাঙালি জাতির প্রেক্ষাপটে কিরাত, চীনা-তিব্বতি, গারো, খাসিয়া প্রভৃতি মঙ্গোলিয় গোত্রভুক্ত জাতির ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। দশম শতকে গৌড়ে চীন-তিব্বতী বংশীয় রাজবংশের শাসন, কামরূপ অধিপতি ভাস্কর বর্মার উত্তর বঙ্গ সহ কর্ণ-সুবর্ণ অধ্কিার বাংলাদেশের নৃতত্বে মঙ্গোলীয় রক্তধারার সংযোজনে নিশ্চিতভাবে ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গ সম্রাট শশাঙ্ক এর মৃত্যুর পর অর্জুন নামে তার এক অমাত্য সিংহাসন দখল করেন। তিব্বতী রাজদূত ওয়াং হিউয়েন চি অর্জুনের হাতে নিগৃহীত হন। ফলে ওয়াং হিউয়েন চি তিব্বতের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অর্জুনের রাজ্য আক্রমণ করেন। ভগদত্তের উত্তরপুরুষ কামরূপাধিপতি ভাস্কর বর্ম্মা তখন ওয়াং হিউয়েন চি কে সহায়তা দান নিমিত্ত নিজে সৈন্যবাহিনী নিয়া সহায়তা প্রদান করেন।
এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বত ও চীনের সাথে উপমহাদেশের যোগাযোগ ছিল। চীনা সুত্রে প্রাচীন কালে দক্ষিণ চীন বা টঙ্কিং থেকে উত্তর মিয়ানমার-মণিপুর-কামরূপ হয়ে সূদূর আফগানিস্থান পর্যন্ত চলাচলের একটি রাস্তার বিবরণ জানা যায। হিওয়েন শাঙ কামরূপ ভ্রমণ কালে ঐ রাস্তার বিয়য় অবহিত হন। কিয়া তান (৭৮৫-৮০৫ খ্রীস্টাব্দ) এর বর্ণনায়ও টঙ্কিং থেকে কামরূপ হয়ে মগধ পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তার বিবরণ পাওয়া যায়। চীন থেকে সম্ভবত ওই পথ বেয়ে অনেকগুলো মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠির উপজাতি উপমহাদেশের সীমান্তে বসতি স্থাপন করে। তিব্বত থেকেও বাংলাদেশে বানিজ্যের ভালো যোগাযোগ ছিল। তিব্বতের টাট্টু ঘোড়া বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তিব্বতীর প্রতি বছর বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ টাট্টু ঘোড়া লক্ষণাবতীতে নিয়ে আসত। সুতরাং ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষেও চীনা-তিব্বতী জাতি তথা মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠির সাথে বাংলাদেশের লোকজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তুর্কীরা ভারত জয় সুনিশ্চিত না করেই তিব্বত অভিযান শুরু করার মধ্য দিয়েও তিব্বতের সাথে বাংলা তথা উপমহাদেশের পূর্ব সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া যায।
এছাড়া চীনাদের প্রভাব যে উপমহাদেশে ছিল, তা কতিপয় নদীর নামকরণ থেকেও সম্যক অবগত হওয়া যায়। গঙ্গা, বঙ্গ প্রভৃতি নদীর নামের হোয়াং হো, ইয়াংসিকিয়াং এর মত অং অংশটি যে চীনা ভাষা থেকে আগত, তা এখন সকলেরই ভাবনা ও গবেষণার বিষয়। ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে, “বঙ্গ’ নামটার অর্থ লইয়া পন্ডিতেরা আলোচনা করিয়াছেন। কেহ কেহ মনে করেন, নামটির মূলে ছিল চীন-তিব্বতি গোষ্ঠীর কোন শব্দ।’ (^ সুত্র ১৫) । ড. সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মনে করেন বাংলাদেশের বানিয়াচং, পাঘাচং, বুড়ীচং ইত্যাদি নামের মধ্যে চীনা প্রভাব রয়েছে (^ সুত্র ১৬)। গঙ্গা বঙ্গ প্রভৃতির নামকরণ যদি চৈনিকদের অবদান হয়ে থাকে, তাহলে আর্যদেরও পূর্বে উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে চীনা-তিব্বতীদের ভূমিকা অবশ্যই থাকবে। ফলে পশ্চিম সহজতর হলেও, দূর্গম উত্তর থেকেও উপমহাদেশে মানুষের আগমণ ঘটেছে। এছাড়া নরতত্বে মঙ্গোল নরগোষ্ঠিভুক্ত খাসিয়া স¤প্রদায়ের মাতৃভাষায় অস্ট্রিক প্রভাব অধিকতর গবেষণার দাবী রাখে। কারণ এ থেকে অন্তত প্রতীয়মান হতে পারে যে মোঙ্গলরা অস্ট্রিক জাতির আগমণের সাথে বা কিছু আগুপিছু হয়ে অন্তত বঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং ভাষার মিলন থেকে দুই জাতির ব্যাপক মিশ্রণের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিচারের দাবী রাখে। রিবার্ট রিজলী ত বলেই দিয়েছেন যে বাঙ্গালী জাতি আর্য় ও মোঙ্গলীয় রক্তের মিশ্রণে গঠিত। তার কথা সর্বাংশে গ্রহণ করা না গেলেও উত্তর দিক থেকে উপমহাদেশে মানুষের আগমণের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনার অবকাশ রাখে। নীহার রঞ্জন রায় রবার্ট রিজলীর সাথে স্পষ্টভাবে দ্বিমত পোষণ করলেও তিনি স্বীকার না করে পারেননি যে, “সেনদের সময়ে প্রাগজ্যোতিষপুরবাসীরা নানা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিক্ষিপ্ত হইয়া যায়Ñ রাজবংশী, কোচ, মেচ, চাকমা প্রভৃতি শ্রেণীর নেতাগণ পূর্ব ময়মনসিংহের নানা দুর্গম স্থানে বাস স্থাপন পূর্বক সর্ম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করিল। এই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিবাসীরা বাঙ্গালাদেশে সাধারণত কিরাত ও রাজবংশী নামে পরিচিত ছিল। তাহারা আর্য-সমাজের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল। (সেন, ২০০৬, পৃ ৮৫)।
সার্জন জেমস টেলর সেই শতকে কোচ ও রাজবংশী জাতির উপস্থিতি থেকে অনুমান করেন যে কামরূপ রাজ্য দক্ষিণে ও পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও যমুনা পর্যস্ত বিস্তার লাভ করেছিল ( সুত্র ১৭) । জেমস টেলরের মতে এসব অঞ্চল ছিল মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠীর কোচ ও রাজবংশীদের আবাসস্থল। ড. সিরাজুল ইসলামও এমত ব্যক্ত করেছেন যে সুদূর অতীতকাল থেকে হাল বৃটিশ আমলেও বাংলার পূর্বাঞ্চলে মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল (^ সুত্র ১৮) ।
পূর্ব সুত্রঃ
১. কে আদিবাসী? বাঙালি ও বাঙলার বিবর্তনঃ প্রসঙ্গ - অস্ট্রালয়েডঃ ১ম পর্ব
২. কে আদিবাসী? বাঙালি ও বাঙলার বিবর্তন প্রসঙ্গ - দ্রাবিড় জাতি ২য় পর্ব
৩. কে আদিবাসী? বাঙালি ও বাঙলার বিবর্তন প্রসঙ্গ - আর্য জাতি ৩য় পর্ব
৪. কে আদিবাসী? বাঙালি ও বাঙলার বিবর্তন প্রসঙ্গ - আলপাইন জাতি ৪র্থ পর্ব
^ সুত্র ১৪ পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, কামরূপ শাসনাবলী, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ, পৃ ৩-৪
^ সুত্র ১৫ সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ১৯৭০, পৃ ২৮
^ সুত্র ১৬ সৈয়দ মুর্তাজা আলী, বাংলাদেশের স্থানীয় নামের ইতিহাস, ম্যাগনাম ওপাস, ঢাকা ২০০১, পৃ ১০
^ সুত্র ১৭ কোম্পানি আমলে ঢাকা, মূল জেমস টেলর, অনুবাদ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অবসর , ঢাকা, ২০০১
^ সুত্র ১৮ Dr. Sirajul Islam, Studies in Socio-Cultural Changes in Rural Villages in Bangladesh.
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৮:৪৩