বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ছয় দফা আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়নি তখনও, কয়েকমাস বাকী। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন রীতিমত উত্তপ্ত। তবে জাতীয় রাজনীতির সে উত্তাপ তেমন ছড়ায়নি মুক্তাগাছার মোগলটুলা গ্রামে। সে গ্রামের বাসিন্দারা গ্রাম্য আর পারিবারিক রাজনীতি নিয়েই ছিলেন যেন বেশী সন্তুষ্ট। তেমন একটি পারিবারিক রাজনীতির শিকার মাসউদা তাঁর আঠাশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ষষ্ঠ সন্তানের মা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নোংরা পারিবারিক রাজনীতির আঘাতগুলো তাকে তেমন স্পর্শ করতে পারছেনা। তিনি বিভোর হয়ে আছেন আপন সংসারে পা দেয়ার স্বপ্নে। গত এগারটি বছর এ স্বপ্ন দেখা যায়নি। সরলমতি গ্রাম্য প্রাইমারী স্কুল মাস্টারের স্ত্রী হয়ে এজাতীয় স্বপ্ন দেখা যায়না। মাসউদা স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষাটুকু শেষ করতে না পারলেও সন্তানদেরকে গড়ে তুলতে চান মানুষের মতো মানুস হিসেবে। তাঁর চেষ্টাতেই স্বামীপ্রবর মোগলটুলা গ্রামের ময়নদ্দি মাস্টর (মঈন উদ্দিন খান) আজ স্যানিটারী ইন্সপেক্টর হিসেবে সরকারী চাকরিটি পেলেন। পোস্টিং হলো নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া থানায়। কাজে যোগ দিয়েই তিনি চিঠি লিখলেন সন্তানদের নিয়ে মাসউদাকে চলে আসতে। ভাবলেন না স্ত্রীর অত্যাসন্য প্রসবকালীন জটিলতার বিষয়টি। অনিচ্ছায় নয়, ভাবতে জানেন না আসলে!
সাতপাঁচ ভেবে দৃঢ়চেতা মাসউদা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যাওয়ার। কিন্তু চাইলেইতো আর হয়না। যাবেন কিভাবে? গ্রাম্য এক হতভাগ্য গৃহবধু ছাড়াতো কিছু ছিলেন না তিনি। টাকা-কড়ি কিছুই সাথে নেই, কখনও ছিলোওনা। এক আত্বীয়ের কাছ থেকে পয়ষট্টি টাকা ধার করা সম্ভব হলো একটি পালিত বাছুর ও ছাগলের বিনিময়ে। যাওয়ার টাকা নাহয় হলো জোগার, কিন্তু সাথে কে যাবে সে প্রশ্নটি সামনে চলে এলো। দয়ার সাগর এক মামা-শ্বশুর বৌমাকে শরীরের এ অবস্থা নিয়ে একা কোনভাবেই ছাড়লেন না। দায়িত্ববান কোন একজনকে খুঁজতে লাগলেন। অনেক খুঁজে পেতে সতের পেরুনো এক ছেলেকে পাওয়া গেল, সম্পর্কে ভাতিজা, যে কিনা সম্প্রতি কেবল ময়মনসিংহ শহরটি চিনেছে কলেজে ভর্তি হওয়ার সুবাদে। জগতের বাকী সব জায়গা তার অচেনা। এই অপ্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্ববান ছেলেটির হাতে (আসলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হাতেই) আসন্নপ্রসবা মাসুদাকে ছাড়া হলো। তার সাথে "ডিফল্ট" হিসেবে লেগে থাকল সাড়েতিন থেকে দশ বছর বয়স সীমার চার চারটি শিশু। শুরু হলো যাত্রা, প্রায় অজানার পথে!
সেসময় যশোরে যাওয়ার জন্য ট্রেনই ছিল সুবিধাজনক, একবার টিকেট কেটেই চলে যাওয়া যেত। মাঝে যমুনা পারাপারও হতো সে টিকেটেই। লঞ্চে মাঝ যমুনার অপরূপ সৌন্দর্য্য তিনি একদমই উপভোগ করতে পারলেন না। বরং তীব্র এক আতংক ঘিরে ধরল তাকে। মা হওয়ার অভিজ্ঞতা তার ভালই আছে। সন্তান হওয়ার আগের লক্ষণগুলো পরিস্কারভাবেই টের পাচ্ছিলেন তিনি। মাসউদা একমনে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করলেন। ইউনুস নবীর বিপদ এরচেয়ে অনেক বেশী ছিল। মাছের পেট থেকে আল্লাহ্ তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন এই দোয়ার কারনেই। বিপদে-আপদে এই দোয়ার উপর তাঁর অনেক ভরসা। দোয়া ইউনুসের জন্যেই হোক অথবা অন্যকোন উছিলায়ই হোক সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় তারা কোন অঘটন ছাড়াই পরদিন ভোরে পৌঁছলেন যশোহর। সেখান থেকে বাসে নড়াইল হয়ে লোহাগড়া পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল আসল মানুষটিকে। মাসউদাকে তিনি নিয়ে গেলেন সদ্য বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারী কোয়ার্টারে। অগোছালো বাসাটিতে উঠেও সবাই যেন দিগ্বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতে লাগল। গোছগাছ আর আনন্দের মিশেলে মাসউদা নিজের শারিরীক বাস্তবতা আর বলতে চাইলেন না। বরং সব বেদনা দাঁত কামড়ে সহ্য করে সবার আনন্দের সাথী হয়েই থাকলেন। আহা সন্তানদের এ আনন্দটুকু এতদিন দেয়া যায়নি, থাকুক মেতে ওরা আনন্দে। রাতে সবাই খেয়ে ঘুমালে মাসউদার সূযোগ হল স্বামীপ্রবরের সাথে দরকারী কথাটি তোলার। 'কাছেপিঠে এমন কেও কি আছে যার সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে?' মাসউদার কৌতুহলে জানা গেল, একজন পুলিশের কথা যিনি স্বস্ত্রীক থাকেন কাছেই। আর সবাই ব্যাচেলর।
ভোর পাঁচটায় ইন্সপেক্টর সাহেবকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলেন মাসউদা সেই পুলিশের বউকেই ডেকে আনতে, অন্তত একজন নারীতো থাকবেন পাশে। শরীরের ওই অবস্থাতেই সন্তানদের জন্য নাস্তার আয়োজন করলেন, সাথে নিয়ে আসা চিড়া, নাড়িকেল আর গুরের সহজ নাস্তা। খাওয়া শেষে থালা-বাসন মেজে রাখলেন আর ঘরটাও ঝাড়ু দিয়ে রাখলেন তিনি। নাস্তা খেয়ে সেই ভাতিজা ছোট ভাইদের নিয়ে এলাকা ঘুরে দেখতে বের হল। ততক্ষনে মাসউদার অবস্থা শোচনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাহসও কমে আসছে দ্রুত। কাকে জানাবে সে এ অবস্থার কথা, কাওকেইতো চিনেনা নতুন জায়গায়। নিজের অবস্থার সাথে যুদ্ধে যখন সে প্রায় পরাজিত ঠিক তখন দড়জায় জড়োয়া গহনা ও দামী শাড়ি পরিহিতা কমবয়সী এক মহিলাকে দেখা গেল, এসেই সালাম দিলেন। কিন্তু মাসউদার তখন সেই মহিলার পরিচয় নেয়ার মত অবস্থা নেই। কোনভাবে সেই মহিলার হাতে নিজের ঘরে পড়ার একটা শাড়ি তুলে দিয়ে দড়জাটি বন্ধ করে দিলেন। এর ঠিক পনের মিনিটের মাথায় কোন ধাত্রী বা সাহায্যকারী ছাড়াই একটি নতুন শিশু পৃথিবীর আলো দেখল।
কিছুক্ষনের জন্য সম্পূর্ণ অচেতন হয়েছিলেন মাসউদা। জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারলেন সেই কমবয়েসী মহিলাটি প্রচন্ড ভীত আর অসহায়ভাবে মাসউদার মাথায় হাত রেখে স্থবির হয়ে বসে আছে। সে তার করনীয় বুঝতে সম্পূর্ণ অপারগ, যেন সে স্বপ্ন দেখছে কোন। মাসউদা তার মুখের দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ভাল আছেন। ততক্ষনে বাইরে নতুন হাসপাতালের অল্প কিছু কর্মচারীকে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে আনাগোনা করতে দেখা গেল, একজন আয়া এসে শিশুর নাড়ি কাটা ও পরিচর্জার দায়িত্ব নিল। ডাক্তারও এলেন, মাসউদার নাড়ী পরীক্ষা করে খুশী হয়ে উঠলেন, সব ঠিক আছে, কোন ভয় নেই আর। অন্য সন্তানদের মাঝে কেও কাঁদছে আবার কেওবা হাসছে, এর সাথে নতুন শিশুটির দূর্বল আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। চারপাশের নানান ধরনের শব্দের মিশেলকে মাসউদার কাছে মনে হতে লাগল ছন্দপতনহীন এক সমবেত সংগীত। মাসউদা, যিনি নিতান্তই আটপৌরে জীবনের একজন অতি সাধারণ নারী, তিনি জানতেও পারলেন না নবীন এ শিশুটির জীবনে তিনি হয়ে উঠলেন এক অসাধারণ জননী!
উতসর্গঃ
মাসউদা মঈন, "এক সাধারণ মহিলার আত্মজীবনী" গ্রন্থের লেখক।
ও
জগতের সকল মা এবং যাদের মা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১:১৯