ছোটবেলায় আব্বুর চাকরির কারনে বিভিন্ন সময়ে খুলনা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। দেড় দুই বছরে একবার খুলনায় বেড়াতে আসতাম তখন। দুই চাচা থাকতেন খুলনায়। দু’চার বছর বয়সের গোটা তিনেক চাচাতো ভাই এর একটা বোন ছিল। এই ভাই বোনগুলো সবাই মিলে আমাকে অনেক পঁচাতো। ফাজিলের হাড্ডি ছিল একেকটা। আর আমিও বরাবরই একটু গাধা টাইপের ছিলাম বলে ওরা সুযোগটা আরও বেশি পেত। খুব সহজেই বিভিন্নভাবে আমাকে বোকা বানিয়ে ওরা অনেক মজা নিত। ওদের সাথে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারতাম না নিজেকে। নিজেকে মানিয়ে নিতে যতো সময় লেগে যেত ততোদিনে আমাদের ফিরে যাওয়ারও সময় হয়ে যেত।
বিকেলে বাড়ির সামনের মাঠে সবাই মিলে বউছি, ডাংগুলি, সাত চারা, দাড়িয়াবাঁধা আরও অনেক কিছু খেলত। আমি খেলাধুলা তেমন ভালো পারতাম না। দুই দলে ভাগ হয়ে যেসব খেলা খেলতে হতো তাতে আমাকে কেউই দলে নিতে চাইতো না! আর যে খেলায় কোন দল নেই, সবাই সমান, সেসব খেলায় ওরা যুক্তি করে আমাকে চোর বানিয়ে মজা নিত! পারতাম না দেখে পরে আর নিজেও খেলতে চাইতাম না। চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের খেলা দেখতাম। তাতেও শান্তি ছিল না, আমার চেয়ে বয়সে বছর খানেকের ছোট যে ভাইটা ছিল, ও ইচ্ছে করেই দৌড়ের সময়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত, কিংবা খেলার গুঁটি বা বল ছুঁড়ে মারত আমার দিকে প্রায়ই। আমি আবার কখনো কারো নামে কোথাও নালিশও করতাম না! আর ওরাও এই সুযোগটা নিয়ে আরও বেশি ফাযলামি করত।
তো এমনই একবার অনেকদিন পর খুলনায় এসেছি। কাজিনরাও কিছু মজা লোটার সুযোগ পেয়ে যারপরনাই খুশি। সুযোগ পাওয়া মাত্রই আমাকে ধরল সবাই মিলে।
- চল একটা প্রশ্নের উত্তর দে, দেখি তোর কতো বুদ্ধি!
সবাই আমাকে ঘিরে ধরে আছে! আমি তো ভাবছি কি না কি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আবার! ঠিক মতো উত্তর দিতে না পারলে তো বুদ্ধির পরীক্ষায় হেরে যাব!
- দুই ভাই এক বাড়িতে থাকে, একজনের নাম একিল আরেকজনের নাম দেকিল। একদিন একিল গেলো বাজারে, বাড়িতে কে থাকল বলতো?
আরে এতো সোজা প্রশ্ন!
- দেকিল! বিরাট কনফিডেন্স সহকারে উত্তর দিলাম
সাথে সাথেই ধুমধাম করে পিঠের উপর কয়েকটা কিল বসিয়ে দিল ওরা! আমি তো হতভম্ব! কি হইলো! ব্যথায় চোখে পানি চলে এলেও অনেক কষ্টে কান্না আটকে রাখলাম।
- আমাদের কিন্তু কোন দোষ নাই! তুইই কিল দিতে বলছিস তাই মারছি!
- আমি কখন কিল দিতে বললাম?
- মাত্রই তো বললি দে কিল!
এতক্ষণে ওদের এতো সহজ প্রশ্নের মাহাত্ম্য বুঝতে পারি!
তারপর ওরাই আবার ভাল ভাল কিছু কথা বলে, এটা ওটা কিনে দেয়ার লোভ দেখিয়ে ধানাই পানাই করে কিলের ব্যথা ভুলিয়ে দিল।
খানিকক্ষণ পর বলে - চল, এবার আরেকটা প্রশ্ন!
- আমি আর খেলবনা!
শুনে সবাই মিলে হাসা শুরু করলো। বলে আমি নাকি ভয় পেয়ে গেছি তাই আর খেলতে চাচ্ছিনা! আমার আবার একটু আঁতে ঘা লাগলো।
- আচ্ছা বলো কি প্রশ্ন!
- বলতো, এঘুষি আর দেঘুষি, দুই ভাই। এঘুষি গেলো বাজারে, ঘরে কে থাকলো?
আমি তো এইবার আর এমন বোকামি করব না!
বললাম - কেউ থাকেনা!
ওরা আবারো হাসা শুরু করলো। একজন তো তালি দিয়ে সুর করে বলা শুরু করলো ‘পারে না, পারে না! এতো সোজা প্রশ্ন তাও পারে না ...!’
- আমি পারি। তোমরা আবার ঘুষি দিবা তাই বলিনি।
- আরে না ঘুষি দিব না! আগেরবার তো একটু দুষ্টামি করছিলাম! এবার অন্য একটা মজা দেখাব। তুই উত্তর দে!
- দেঘুষি থাকে!
আর যায় কই! আবারো ধুমধাম কয়েকটা খাইলাম! তারপর আর কোনদিনও এ খেলায় রাজী হই নাই!
সময়ের বয়স বেড়েছে! আমার সাথে সাথে এই কাজিনরাও অনেক বড় হয়ে গেছে। দুজন বিয়ে করেছে, আপুটার একটা ছেলেও হয়েছে। অনেকদিন পর পর ওদের সাথে দেখা হয়, ফরমাল কথাবার্তাই বেশি হয়। অল্প স্বল্প স্মৃতিচারণও হয়। অনেক কিছুই বদলে গেছে, তবে আমি এখনো সেই আগের মতো বোকাসোকাই রয়ে গেছি!