আজকেও একটুর জন্য ভার্সিটির বাসটা মিস হলো না! ভাগ্যিস হেল্পার মামা দেখতে পেয়েছিলো আর রাস্তায় অনেক লোকের ভিড়েও আমাকে তার একজন ভাগ্নি বলে চিনে নিতে পেরেছিল! বাসে উঠে দেখি সামনের সিট পুরোই খালি। যাক বাবা! কোন কোনদিন তো দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যায় না। সিটে বসেই ইয়ারফোন বের করলাম ব্যাগ থেকে। উফ! ইয়ারফোনের প্যাঁচ খুলতেই এতো কষ্ট! মনে হচ্ছিলো টেনে ছিঁড়ে ফেলি, এমনভাবে প্যাঁচ লেগে থাকে! আয়েশ করে বসতে বসতেই পরের স্টপেজের সামনে চলে এলো বাস।
হুড়মুড় করে কতগুলো মেয়ে উঠে পড়লো সামনের দরজা দিয়ে। আমার এক এক্স ক্রাশকে দেখলাম পেছনের দরজা দিয়ে বাসে উঠতে। ছেলেরা সাধারণত সামনের দরজা দিয়ে ওঠে না। বাস মোটামুটি ফাঁকা দেখে সবাই বেশ উৎফুল্ল। সকালে সাধারণত বাস এমন ফাঁকা পাওয়া যায় না। সবার শেষে উঠলেন এক খালা। এক ঝাঁক রঙিন মেয়ের মাঝে প্রায় বৃদ্ধ খালাকে কেমন যেন সাদাকালো বলে মনে হল। খালাকে প্রশাসনিক বিল্ডিঙে দেখেছি কয়েকবার, সম্ভবত ওখানেই আয়ার কাজ করেন।
আমার পাশেই বসলেন। ধপ করে নাকে কেমন একটা গন্ধ লাগলো, বাজে গন্ধ, খালার গা থেকে আসছে। এই গন্ধ সাথে নিয়েই আমাকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত যেতে হবে ভাবতেই প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম। কোন দুঃখে যে একদম সামনের সিটে বসতে গেছিলাম! খালাও আর বসার জায়গা পেল না। বিরক্ত নিয়েই খালার দিকে তাকালাম আর একবার। বিনিময়ে খালা হাসলেন, আমার বিরক্তিটা ধরতে পারেননি। বললেন, 'আর একটু হইলে বাসটা মিস হইত আজকে। আমার ছোট মাইয়াডার জ্বর দুই দিন ধইরা। সকালে বেলা এতো কাজ একলা কইরা কুলাইতে পারিনা।' আমি হাসির মতো একটা ভঙ্গি করে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ওনার এইসব সংসারের গল্প শোনার কোন ইচ্ছা নেই এখন আমার। তারচেয়ে আশিকি ২ এর গান শুনলে বরং ভালো লাগবে।
হঠাৎ মনে হলো এইসব খালাদের কতো কষ্ট! আমি তো সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে গিয়ে খাওয়ার টাইমই পাইনা। আম্মু মুখে তুলে খাইয়ে না দিলে হয়তো রোজই না খেয়েই ক্যাম্পাসে যেতে হতো! আর সেখানে হয়তো উনি সেই ভোরবেলা উঠেই কাজে লেগে গেছেন। আমার মতো পাঁচ মিনিট ধরে ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে, যত্ন করে সান্সক্রিন লোশান, আই লাইনার, মাশকারা লাগিয়ে, সদ্য ভাঁজ খোলা ইস্ত্রি করা জামা পরে বয়ফ্রেন্ডের গিফট করা দামি পারফিউম গায়ে মেখে বের হওয়ার মতো সময় বা সুযোগ কোনটাই নেই তার।
নিম্ন মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসার নিশ্চয়ই। সারাদিনের রান্না শেষ করে, ছেলে মেয়ে স্বামী সবার সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছে। আবার পাঁচটার বাসে বাড়ি ফিরবেন ঠিকই আমার মতোই, তবে সহকর্মীদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তপনদার দোকানে আড্ডা দেয়ার সময় হবে না তার। দুপুরে হই হুল্লোড় করতে করতে বন্ধুরা সবাই মিলে জিরো পয়েন্টে খেতে যেতেও পারবেন না। কর্মকর্তাদের চেয়ার টেবিল পরিস্কার করে আর চা দিতে দেরী হওয়ার কারনে ঝারি শুনেই দিন পার হয়ে যাবে তার। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে নিজেকে উৎসর্গ করতে করতেই এখন এই বৃদ্ধতার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। আর আমি শুধু খেয়ে, ঘুমিয়ে, মাস্তি করে আর নামমাত্র পড়াশোনা করে জীবনের প্রায় দুই যুগ পাড় করে দিলাম।
হঠাৎ করেই নিজেকে কেঁচোর মতো মেরুদণ্ডহীন বলে মনে হতে থাকে, আর খালাকে খুব মহান মানুষ গোছের কিছু বলে মনে হয়। খালার গায়ের উৎকট গন্ধটাও আর খারাপ লাগে না। কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়ে রাখি। চোখ বন্ধ করে ডুব দেই সেই গন্ধে...