somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেভাবে খুনের মামলার প্রধান আসামী বিচারপতি হতে চলেছেন

২৭ শে মে, ২০১০ রাত ২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রুহুল কুদ্দুস বাবু। ভাইসাহেবের দুটো পরিচয় আছে। আসলে আছে তিনটি, তো তৃতীয়টির জন্য সামান্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তাই সেটা পরে দেই। প্রথম পরিচয় হচ্ছে, তিনি খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় একজন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। একেবারে হাইকোর্টের জাস্টিস। নিয়োগ দিবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। এই গেল প্রথম পরিচয়।

দ্বিতীয়টা হচ্ছে, তিনি একজন প্রাক্তন ছাত্রনেতা। আগে জাসদ করতেন। পরে ছাত্রলীগের নেতা হন। উনি কিন্তু ঐ ঢাকা ইউনিভার্সিটির দুই সাংবাদিক পিটানো সৈকতের মত এলেবেলে ছাত্রলীগ নন। ইনি ছাত্রলীগের টিকেট নিয়ে রাকসুর জিএস হয়েছেন, সালটা ঠিক খেয়াল নেই, তবে আশির দশকের একদম শেষের দিকে রাকসুর কোন একটা ইলেকশানে। জনপ্রিয় নেতাই বটে।



খসরুজ্জামান সাহেব, যিনি বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন, ২০০৬ সালের ৩০শে নভেম্বারে প্রধান বিচারপতির এজলাসের দরজার কাঁচ লাত্থি দিয়ে ভাংছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর সিদ্দিকীর কথা নিশ্চয়ই ভুলিনি। এই আবু বকর সিদ্দিকীকে নিয়ে যখনই আলোচনা হবে, তখনই এটা উল্লিখিত হবে যে এই নিরীহ ও মেধাবী ছেলেটা ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছিল। রাজশাহীর ফারুক হোসেনের মৃত্যুর পর প্রায় দেড় হাজার গ্রেপ্তার করা হলেও, এই আবু বকর সিদ্দিকী মারা যাওয়ার পর ঐ মামলায় এখনও কোন গ্রেপ্তার হয়নি। আঘাতের ফলে বকরের মাথার পেছনের ছিদ্রটির ব্যাস দেড় ইঞ্চির বেশী হওয়া স্বত্ত্বেও নয়। কারণ একটাই, ফারুক ছাত্রলীগ সদস্য ছিল, আর বকর জানত না যে মৃত্যুর আগে তার ছাত্রলীগে যোগ দেয়া উচিত ছিল। লীগ-দল-পার্টি-মৈত্রী-সমাজ ইত্যাদির কোনটার সদস্য না হয়েও বকরের মৃত্যু হয়ছে ‘রাজনৈতিক সহিংসতায়’। দুটো দলের মারপিটও নয়, হল দখলে ছাত্রলীগের দুটো গ্রুপের মারপিট ও পরে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পুলিশের পদার্পণ।

আসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আবাসিক পরিচয় আব্দুল লতিফ হল। আবু বকরের মতই মেধাবী। আবু বকর কিন্তু শুধু পত্রিকার ভাষার মেধাবী ছাত্র ছিল না, সে একেবারে রেজাল্ট শিটের মেধাবী ছাত্র। ঢাবিতে ইসলামিক হিস্ট্রি বিভাগে তার ব্যাচে সে-ই ছিল সবচেয়ে বেশী সিজিপিএ-অলা ছেলে। এমনকি খুন হওয়ার তিন সপ্তাহ পরে দেওয়া রেজাল্টেও দেখা গেল বকরই ফার্স্ট হয়েছে।

১৯৮৮ সালের ১৭ই নভেম্বার। ঐ আব্দুল লতিফ হল দখল বা অনুরূপ কোন একটা মহৎ উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট ছাত্রনেতা রুহুল কুদ্দুস ভাইয়ের গ্রুপের সাথে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের একটা পানিপথের যুদ্ধ সেদিন হয়েছিল। এই পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদী বা বাবরের পক্ষের কজন সৈন্য শহীদ বা গাজী হল দুর্জনেরা তা বলে যায়নি। তবে সেই যুদ্ধে আসলাম গেল মরে। একেবারে আবু বকর সিদ্দিকীর মত আচমকা, কিংবা তার চেয়ে বেশী বা কম।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্রহত্যার যেকোন ঘটনার পরই অভিভাবক শ্রেণীর মানুষজন বলেন, “কেন যে তোরা যাস পলিটিক্স করতে, মা বাবা কত কষ্ট করে পড়ায়, পড়তে পাঠায়, আর তোরা এসব করে পরিবারটাকে ধ্বংস করিস”, ইত্যাদি। কিন্তু আবু বকর বা আসলাম কারও ক্ষেত্রেই একথা গুলো বলার সুযোগ নেই। কেননা তারা কেউ কোন দলের সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় কোন সদস্যই ছিল না।

যাই হোক, পরের দিন, অর্থাৎ ১৮ই নভেম্বার, বোয়ালিয়া থানায় আসলামের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটা হত্যা মামলা দায়ের করা হল। মামলার নাম্বার, ১৯৮৯ সালের নভেম্বার মাসের ১৪নং মামলা। আসামী ৩০ জন। প্রধান আসামী রুহুল কুদ্দুস বাবু। মামলার এজহারে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করলেন, “জাসদ ছাত্রলীগ নেতা রুহুল কুদ্দুস বাবু কিরিচ দিয়ে আসলামকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে”।

তদন্ত শেষে ১৬ জনকে বাদ দিয়ে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বাকি ১৪ জনের নামে পুলিশ চার্জ গঠন করে। রুহুল কুদ্দুস বাবু ১নং আসামী। চার্জ গঠনের শুনানি শেষে চার্জশিট থেকে কয়েকজনকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু হাইকোর্টে এই বাদ দেয়াকে চ্যালেঞ্জ করে রিভিশান দায়ের করা হলে হাইকোর্ট চার্জশীটের কাউকে বাদ না দেয়ার নির্দেশ দেন। এই শেষের রায়টি হয় ২০০৯ সালের ২রা জুলাই তারিখে, রায় দেয় হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ। অর্থাৎ মামলাটি আজও পুরোপুরি সচল ও জীবিত।

জনাব বা জনাবা পাঠক, কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে আসলামকে মারার অভিযোগে রুহুল কুদ্দুস বাবু-র বিরুদ্ধে মামলাটি আজও রাজশাহীর জেলা ও দায়রা জজ কোর্টে বিচারাধীন আছ, মামলা নং-২৫৯/২০০২। রুহুল কুদ্দুস বাবু ১নং আসামী, ভিক্টিমকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে মারার দায়ে অভিযুক্ত।

মাননীয়, শ্রদ্ধেয়, জাহাপনা, প্রিয় ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত পাঠক, আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছি বা লিখছি, ইনশাল্লাহ এই সপ্তাহেরই কোন একটা দিনে এই রুহুল কুদ্দুস বাবু, এই রুহুল কুদ্দুস বাবু মানে সেই রুহুল কুদ্দুস বাবু, যার নামে মামলার এজহারে ভিক্টিমকে কুপিয়ে মারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু তাই না, হাইকোর্টে তা গৃহীতও হয়েছে, সেই রুহুল কুদ্দুস বাবু হাইকোর্টের একজন বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন।
নিয়োগ লাভের জন্য অধীর অপেক্ষায় আরও কয়েকজন যারা আছেন, তারা রুহুল কুদ্দুস বাবুর তুলনায় রীতিমত বিনা বিচারে বেহেশ্ত নসিব হওয়ার যোগ্য। তারা হলেন-

আবু জাফর সিদ্দিকী, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৯৭-২০০১)
জাহাঙ্গির হোসেন সেলিম, বর্তমানে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের জুনিয়ার
খসরুজ্জামান, বর্তমানে ডেপুটি এ্যটর্নি জেনারেল ও আওয়ামী প্যানেল থেকে নির্বাচিত সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি
প্রমুখ

দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম তো নয়ই, এমনকি দ্বিতীয়ও নয়। বিগত বিএনপি সরকারের সময়ই মার্কশীটের ফ্লুইড চালিয়ে রেজাল্ট বদলে নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য পরে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে বিষয়টি তোলার আগেই আলোচিত ফায়েজী সাহেবের বিচারপতি জীবনের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। সংক্ষিপ্ত বিচারক জীবনে তিনি দুই বিএনপি নেতাকে খালাস দিয়ে যে দুটি রায় দেন, সেগুলোও বাতিল হয়ে যায়।

কিন্তু একটি সচল, জীবিত মামলার এজহারে যার নামে ভিক্টিমকে কিরিচ দিয়ে মারার কথা উল্লেখ করা আছে, সেরকম কোন মানুষকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম, এই বিষয়ে অনেক টাকা বাজি ধরা যেতে পারে।

একটি মামলার চার্জশীট থেকে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল হাজারীর নাম বাদ দেয়াকে অনুমোদন না করার অপরাধে বর্তমান আইন প্রতিমন্ত্রী (যিনি বটতলার উকিল হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার পর বেজায় রেগে যান) কামরুল ইসলাম একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এরকম হাস্যকর প্রস্তাবে নিতান্ত আনাড়ি আইনজীবিরাও মশকরা শুরু করে দেয়াতে কামরুল ইসলাম তা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ থেকে বিরত থাকেন।

তো, কামরুল ইসলামের মত লোকেরা যেখানে আইন প্রতিমন্ত্রী, সেখানে কি রুহুল কুদ্দুস বাবুর মত লোকদের বিচারক হওয়া স্বাভাবিক না?

না, স্বাভাবিক না। খুনের মামলার ১নং আসামীর বিচারক হওয়া তার চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার। তার চেয়ে কামরুল ইসলাম সাহেবের ঐসব মন্তব্যও অনেকটা সহ্য করে নেয়ার মত।

প্রিয় ব্লগ থেকে
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বৃথা হে সাধনা ধীমান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৯ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:৩২

বৃথা হে সাধনা ধীমান.....

বিএনপি মিডিয়া সেল এর সদস্য সচিব ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানী সকল পত্রিকা কতৃপক্ষের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ কর্মসূচি শুরু করেছেন- বিএনপির এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি কি দু’জন ভারতীয়র আচরণ দিয়ে পুরো ভারতকে বিচার করব?

লিখেছেন প্রগতি বিশ্বাস, ০৯ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:৩৬

সাম্প্রতিককালে একটি আন্তর্জাতিক কমিউনিটিতে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক কমিউনিটিতে ভারত এবং চীনের জনসংখ্যাগত আনুপাতিক কারণে অংশগ্রহণ বেশি। এই কমিউনিটিতে ভারত, চীন ছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল, ইউক্রেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধের মঞ্চে রাজনীতির খেলা: জনগণের বেদনা ও শাসকের বিজয়গাথা

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১০ ই মে, ২০২৫ রাত ১২:০৮


দীর্ঘ তিন বছরের কূটনৈতিক আলোচনার পর ৬ মে ভারত ও যুক্তরাজ্য একটি ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষর করে, যা উভয় দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তার মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"মা বড় নাকি বউ বড়", প্রসঙ্গ এএসপি পলাশ সাহার মৃত্যু

লিখেছেন সোহানী, ১০ ই মে, ২০২৫ সকাল ৭:৫৮



এএসপি পলাশ সাহার আত্মহত্যা নিয়ে অনলাইন গরম। কেউ মা'কে দোষারোপ করছে কেউ বউকে। আর কেউ অভাগা পলাশকে দোষ দিচ্ছে। অনেকটা শাবানা জসিমের বাংলা ছবির মতো, "মা বড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যত কি?

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১০ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৯

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি নামে যে দল গঠন করেছিলেন, তা থেকে বিএনপির অবস্থান যোজন যোজন দুরত্বে। তবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে সুশাষন প্রতিষ্ঠিত না করলেও বিএনপির বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×