১ম পর্বঃ Click This Link
ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেবার আগে যা করতে হবেঃ প্রত্যেকেরই নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রয়েছে, যেহেতু জীবনটা তার। জীবনের প্রয়োজনে যদি কখনো ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, তবে তার আগে ঠাণ্ডা মাথায় কিছু দিক ভেবে দেখতে হবে। দাম্পত্য সংকট ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারলে হয়ত আর ডিভোর্সের সিদ্ধান্তই নেবার প্রয়োজন পড়ে না। তাই নিজেদের মধ্যকার সংকট নিয়ে দুজনে মিলে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যায়। তাতেও সমাধানের পথ না পেলে দুজনে মিলে কাউন্সেলিং নিতে পারেন।প্রয়োজনে আইনী পরামর্শ নিতে পারেন। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি সংস্থা মনোসামাজিক কাউন্সেলিং ও আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য...
• • ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ভবন (৪র্থ তলা); ৩৭/৩, ইস্কাটন গার্ডেন রোড; ঢাকা-১০০০। ফোন:৮৩২১৮২৫; মোবাইল: ০১৭১৩১৭৭১৭৫
• আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
৭/১৭, বস্নক-বি, লালমাটিয়া, ঢাকা-১২০৭
ফোন- ৮১২৬১৩৭, ৮১২৬১৩৪, ৮১২৬৪০৭
সার্বক্ষনিক আইন সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন নং: ০১৭২৪৪১৫৬৭৭, ০১৭৫৭১১২২৬১
ই-মেইল: ask@citechco.net
• বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজ়ীবি সমিতি
৪৮/৩, মনিকো মিনা টাওয়ার,
পশ্চিম আঁগারগাঁও, ঢাকা, ফোন-৯১৪৩২৯৩
• বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)
YMCA ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ১/১ পাইওনিয়ার রোড, কাকরাইল, ঢাকা- ১০০০
ফোন- ৯৩৪৯১২৫, ৮৩১৩৬৮৯, ফ্যাক্স- ৯৩৪৭১০৭, ই-মেইল- mail@blast.org.bd
ওয়েব সাইট- http://www.blast.org.bd
• মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
• ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার
• বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুফিয়া কামাল ভবন, ১০/বি/১ সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০, ফোন -৭১৬৯৭০১, ফ্যাক্স ৮৮-০২-৯৫৬৩৫২৯, ই-মেইল-mahila@bd.com, ওয়েব- http://www.mahilaparishad.org
• সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ইত্যাদি।
দাম্পত্য সংকট চলাকালে অনেকেই মনে করেন, বাচ্চা হলেই বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু এতে অনেক সময় সমস্যা আরো বেড়ে যায়। সন্তানের কারণে অনেক সময় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যক্তির জন্য যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর সংকটের মধ্যে সন্তানটি নিজেও অনেক সমস্যায় পড়ে যায়। তাই সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সন্তান না নেওয়াই ভাল।
প্রিভেনশন ইস বেটার দ্যান কিউরঃ দাম্পত্য সংকট মোকাবেলার সবচেয়ে ভাল উপায় হলো, সংকট তৈরি হবারই কোন সুযোগ না রাখা। ‘’বিয়ে হয়ে গেলেই আর কোন সমস্যা হবে না’’ এমন মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।সেজন্য বিয়ের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রি-ম্যারিট্যাল কাউন্সেলিং-এর ধারণাটি আমাদের দেশে প্রায় নেই বললেই চলে।অথচ দুজন আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠা, আলাদা মানসিকতার দুজনের বিয়ের আগে প্রি ম্যারিট্যাল কাউন্সেলিং-এর অত্যন্ত দরকার।দুজনের দুজনে চিনতে, বুঝতে, দুজনার পছন্দ-অপছন্দগুলো জেনে নেওয়া ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব তৈরিতে এ কাউন্সেলিং সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও বিয়ের আগে ভাল মত একে অপরের তথ্যগুলো যাচাই করে নিতে হবে। মাদকাসক্তি বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি আছে কিনা জানার চেষ্টা করতে হবে।
বিয়ের পরে শত ব্যস্ততার মধ্যেও দুজন দুজনের জন্য কোয়ালিটি টাইম বের করে নিতে হবে। মাঝে মাঝে কোথাও ঘুরে আসা, একসাথে সিনেমা দেখা, উপহার দেওয়া, এ ধরনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো দিয়ে জীবনকে সাজিয়ে রাখতে হবে। একটি সম্পর্ক তৈরি করাটাই বড় কথা নয়, বরং তা সুন্দর করে রক্ষা করার কাজটিই কঠিন।একটি সম্পর্কের প্রথম শর্তই হচ্ছে দুজন দুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান, ভালবাসার চর্চা বজায় রাখলে সম্পর্কে ফাটল ধরার সুযোগ থাকে না। জীবনে চলার পথে দুজনের দাম্পত্যের বাইরেও তৃতীয় কোন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ করার কোন স্থান রাখা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। যদি কখনো এমন কারো অনুপ্রবেশ ঘটেও যায়, তবে সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার মানসিকতা রাখতে হবে। আর এতে স্বামী/স্ত্রীর সমর্থন ও শক্তি অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজনে দুজন দুজনকে ছাড় দিতে হবে। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভাল থাকলে সমঝোতায় কোন সমস্যা হয় না। সন্তান জন্মের পরেও পারিবারিকভাবে সবাই মিলে কোয়ালিটি টাইম মেইনটেইন করতে হবে।
সমাজ বিজ্ঞানী যা বলেনঃ
বিবাহ বিচ্ছেদ সামাজিক বিকাশের একটি বাস্তবতা
শিক্ষার হার, তথ্য প্রযুক্তি্র ব্যবহার, নারীর অধিকার সচেতনতা, নারীর ক্ষমতায়ন,নারীর শালীনতাবোধ, দেশ বিদেশে কর্মসংস্থান, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান্তরাল অংশগ্রহণ যতই বাড়বে সমাজের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে।সেই সাথে সমাজের মধ্যে মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতারও পরিবর্বতন আসবে। তখন বিবাহ বিচ্ছেদের হারও সেভাবেই বাড়বে।বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাওয়া সমাজ পরিবর্তনের কথাই যেন ঘোষণা দেয়। সেদিক দিয়ে বলা যায়, বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়া সামাজিক বিকাশেরই একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা।
সমাজ বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়।আদিম সমাজে অবাধ যৌনাচার, অজাচার ইত্যাদির প্রচলন ছিল।নৃতাত্বিক গবেষণায় দেখা যায় ম্যামাল অর্থাৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এধরনের যৌন আচরণ তাদের স্বাভাবিক প্রবনতা।প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এধরনের অবাধ যৌনাচারের ফলে একসময় নানা রকম দ্বন্দ্ব, সংকট, সমস্যা তৈরি হতে থাকে। সেসব সমস্যা কমিয়ে আনতে, মানুষকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সমাজের প্রতিনিধিরা নতুন কিছু মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রবর্তন করে।তারই ধারাবাহিকতায় পরিবার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।সেই সময়ে সমাজের বিকাশ এভাবে ঘটেছিল।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিবারে একসময় নারীর পছন্দ--অপছন্দ, ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা প্রকাশ করতে পারতো না।তাই কখনো শারীরিক বা মানসিক এমন কি যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও সে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারতো না।এখন নারীরা সাবলম্বী হচ্ছে। সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজ প্রতিনয়ত পরিবর্তিত হয়। সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, দেশ কাল ভেদে এর বিভিন্নতা দেখা যায়।সেই সমাজ পরিবর্তনের এই বাস্তবতা বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া।নারী ও পুরুষ বৈষয়িক, মনস্তাত্বিক ও জৈবিক কারণে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তও সমঝোতার মাধ্যমে নেওয়া হয়ে থাকে। দুজনেরই পারস্পরিক মতামত ও বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এমন সিদ্ধান্ত নেবার সামাজিক ও আইনগত অধিকার রয়েছে এবং তা থাকাই উচিত।
আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে নারীর উপর একটি অমানবিক দুঃসহ জীবন আমরা চাপিয়ে দেই।স্বাভাবিক, সামাজিক জীবন যাপনের উপায় আমরা তাদের জন্য রাখছি না। এটি আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।
মোঃ আবদুল মালেক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মনোবিজ্ঞানীর মতামতঃ
বিবাহ বিচ্ছেদের হলেও বাবা-মায়ের সুন্দর ছবিটা যেন সন্তানের কাছে নষ্ট না হয়ে যায়
পরিবার, সমাজ, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে সুস্থ মননশীলতার চর্চার খুব প্রয়োজন। এটি না থাকলে সবখানেই আমরা ভাংগনের চিত্রই দেখতে পাবো।পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে চাওয়া পাওয়ার ভিন্নতা থাকতে পারে। এই ভিন্নতা যদি একেবারেই সহনশীলতার বাইরে চলে যায়, তবে এমন সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।আর যদি কোন কারণে বিচ্ছেদের মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন করা না যায়, তবে ঐ সম্পর্কের মধ্যে কিভাবে বসবাস করতে হবে, সে উপায় গুলো তাকে জানতে হবে। যদি তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাদা হয়ে যান তবে যেন সন্তানদের মধ্যে বাবা-মায়ের সুন্দর ছবিটা নষ্ট হয়ে না যায়। বাবা-মায়ের নিজেদের মধ্যকার অশান্তি, বিদ্বেষ ও বিরোধ যেন সন্তানদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। বরং সন্তানকে এভাবে বোঝাতে হবে, ‘’তোমার বাবা/মায়ের সাথে আমার বিচ্ছেদ হলেও সে তোমার বাবা/মা।তুমি তার সাথে সব সময় যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখবে।‘’ উন্নত দেশগুলো এখন কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের পরবর্তী সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে।
ডঃ শাহীন ইসলাম
চেয়ারম্যান
এ্ডুকেশন ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:০১