ভাষা মহান আল্লাহর এক অপূর্ব দান। প্রতিটি প্রাণীরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা; যার মাধ্যমে তারা একে অপরের সাথে ভাব বিনিময় করে থাকে। সৃষ্টির শুরু থেকে মানবজাতি এই ভাষার ব্যবহার করে আসছে। তার রূপটা সব সময় এক রকম ছিলো না। সময়ের প্রয়োজনেই মানুষ তৈরি করেছে বর্ণ। তৈরি করেছে ব্যাকরণ ও ভাষা ব্যবহারের বিভিন্ন কলা-কৌশল। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। প্রাকৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত এই বাংলা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও প্রাচীনতম ভাষাগুলোর একটি। বাংলাদেশ, ভারত ও সিয়েরালিওনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ কথা বলে এই ভাষায়। তন্মধ্যে বাংলা প্রধান রাষ্ট্রভাষা একমাত্র এই বাংলাদেশেরই। যেহেতু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং প্রধান রাষ্ট্রভাষা; সেহেতু অন্যদের তুলনায় আমাদের জীবনে বাংলা ভাষা অনেক বেশিই ক্রিয়াশীল। তাই আমাদের একমাত্র অবলম্বন এই বাংলাকে সময়ের প্রয়োজনে আজ আমরা আরো গতিশীল, প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে পেতে চাই।
প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা ভাষাকে অপরাপর ভাষাগুলো থেকে বিশেষভাবে ভিন্নতা দেয়। ইংরেজি ভাষার Capital ও Small Letter, পেছানো বর্ণ, আরবি ভাষার حركة, مركب (হরকত, মুরাক্কাব) ও ডান থেকে বামে লেখার রীতি ইত্যাদি। বাংলা ভাষার যুক্তবর্ণ, মাত্রা এবং স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণের ভিন্ন অবস্থান ইত্যাদি হলো তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষা ও তার বৈচিত্র্যভেদে এমন ভিন্নতা থাকাটা যেমন উচিত; তেমনি সেই বৈচিত্র্যের বাড়াবাড়িটাও আবার একেবারেই অনুচিত। কোনো ভাষার জনপ্রিয়তা নির্ভর করে তার সরলতা, প্রাঞ্জলতা ও সমৃদ্ধির ওপর। ভাষার এই সহজপ্রবণতা ও সমৃদ্ধিই ইংরেজিকে বিশ^ব্যাপী করে তুলেছে এতোটা জনপ্রিয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে আরো গতিশীল ও সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য প্রয়োজন কিছু সংস্করণ। আশা করছি তা ভাষাকে আরো প্রাণ সঞ্চার করবে।
বাংলা আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত ভাষা হওয়াতে আমরা অনুভব করতে না পারলেও সত্য যে, এই বাংলা পৃথিবীর জটিল ও কঠিনতম ভাষাগুলোর একটি। এই সত্যটা প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চি অনুভব করেন যে-সব ভিন্ন ভাষাভাষী ব্যক্তি বাংলা ভাষা শিখার চেষ্টা করে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাটা দিতে গিয়ে অনুভব করেন তাদের শিক্ষক ও মা-বাবা। এছাড়াও ক্ষাণিকটা অনুভব করেন নিরক্ষর বাংলা ভাষাভাষী কোন ব্যক্তি যখন অক্ষরজ্ঞান লাভ করতে যায়। প্রবন্ধে আমি বাংলা ভাষার কিছু সমস্যা ও জটিলতা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস চালিয়েছি। যে সমস্যাগুলো আজ-কালের নয়। বরং অনেক পুরোনো। সমস্যাগুলো হয়তো অনেকেরই নজর কেড়েছে। এ যাবতকালে প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী এমন কি প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষীই বিপাকে পড়েছেন সমস্যাগুলো নিয়ে। এর পরও কেউ কিছু বলছে না কেন? ভাষা নিয়ে নতুন কিছু চিন্তা করা কি নিষিদ্ধ? বাংলা ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের চিন্তাগুলো কেমন যেন একটা ফানুসের ভেতর আটকা পড়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার যেন কোনো পথ খোলা নেই। ভাষা তো জীবিত একটা জিনিষ। ভাষার ভেতরে পরিবর্তন হতে থাকে। মৌখিক ভাষার সেই পরিবর্তন থেকে লেখ্য ভাষায়, ব্যাকরণের বর্ণনা ও বিশ্লেষণে নিয়ে আসতে হয় নতুন বিবেচনা। নইলে জীবিত ভাষা ও ব্যাকরণের মধ্যে সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে। জীবিত ভাষার সাথে ব্যাকরণের সম্পর্ক থাকে না বলেই স্কুলের বাচ্চাদের কাছে ব্যাকরণ এতো কঠিন মনে হয়। তাহলে একনজরে দেখে নিই বাংলা ভাষায় চলমান জটিলতা ও তা নিরসনের উপায় কি।
বর্ণ প্রসঙ্গ
* এমন কতগুলো ধ্বনি রয়েছে যেগুলোর জন্য বাংলা ভাষায় একাধিক বর্ণ প্রচলিত থাকলেও উচ্চারণে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। থেকে থাকলেও তা কেবল কাগজে-কলমে। জীবিত ভাষায় উচ্চারণের সেই পার্থক্য আজ আর বেঁচে নেই। বর্ণগুলো হলো- জ, ঝ, য। ড, ঢ। শ, ষ। ড়, ঢ়। ঋ, র। ত, ৎ। ঙ, ং। একটা ভাষার বর্ণ সংখ্যা যত বেশি হবে উচ্চারণে কোনো নতুনত্ব না আসলেও লেখ্য ভাষায় জটিলতা তৈরি হবে তত বেশি। এককথায় বলা যায়, একই উচ্চারণের একাধিক বর্ণ কেবল শব্দের বানানে জটিলতা সৃষ্টি করা ছাড়া তেমন কিছু দিতে পারে না। নতুন কয়েকটি শব্দ গঠন করতে পারে বটে। কিন্তু সেই শব্দগুলোর একমাত্র ভিন্নতা যে এই বাড়তি বর্ণগুলো তা কিন্তু নয়। এছাড়াও ভিন্নতা থাকতে পারে। আমরা চাই সাপও মরবে লাঠিও অক্ষুণœ থাকবে। অর্থাৎ, উচ্চারণে দ্বৈত বর্ণগুলো উঠে যাবে, শব্দও গঠন হবে। তখন হাতে-গুণা কয়েকটি শব্দের বেলায় এমন হতে পারে একাধিক শব্দের বানান একই রকম হয়ে গেছে। হতাশ হওয়ার কারণ নেই। এমন দৃষ্টান্ত প্রতিটি ভাষাতেই রয়েছে। এটা দোষের কিছু নয়। যেমন- ‘বল’ দুই বর্ণের একটা শব্দ হলেও এর অর্থ রয়েছে তিনটা। খেলার উপাদান, পাত্র ও শক্তি।
* বাংলা ভাষায় প্রচলিত সংস্কৃত ভাষার বর্ণগুলো বাংলা ভাষায় বিষ-ফোঁড়ার মতো কাজ করছে। বর্ধিত বর্ণ, শব্দের বানানে জটিলতা সৃষ্টি, ‘কার’ এর দ্বন্দ্ব। সব মিলিয়ে মস্তবড় এক জগা-খিচুড়ির আয়োজন। অবশ্য বর্ণগুলোর জটিলতা ইতোমধ্যে অনুভব করতে পেরেছে খোদ বাংলা একাডেমীও। তাই বিভিন্নভাবে সীমা টেনে দিয়েছে বর্ণগুলোর ব্যবহারের বেলায়। যাবতীয় বিদেশী শব্দে নিষিদ্ধ করেছে সংস্কৃত বর্ণ ঈ, ঊ, ঋ, ষ ও ণ এর ব্যবহার। আর কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা বা সীমা টেনে দেয়া নয়। এবার বাংলা ভাষা থেকে বর্ণগুলো একেবারেই বাদ দেয়া চাই। যেহেতু বাদ দেয়া প্রয়োজন কাজটা বাংলা একাডেমী ঠিকই করবে। দু’দিন আগে বা পরে। চাহিদা উপলব্ধি করে সময়ের কাজ সময়ে করবে বাংলা একাডেমী, এমনটাই চায় সচেতন বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী।
* এছাড়াও ই, ঈ এবং উ, ঊ। বর্ণজোড়া দু’টির মাঝে টেনে পড়া আর না টেনে পড়ার পার্থক্য থাকলেও তা কেবল কাগজে-কলমে। বাস্তবে তা মোটেও গুরুত্ব¡ পাচ্ছে না। অর্থাৎ, উচ্চারণে বর্ণগুলোর ভিন্নতা স্বীকৃত হলেও এই ভিন্নতা বাদ পড়ে যাচ্ছে ব্যবহারে। সুতরাং প্রচলিত দ্বৈত বর্ণগুলোর স্বল্প প্রচলিতটাকে তুলে দিলে আমাদের বিশ^াস বড় ধরনের জটিলতা নিরসন হবে বাংলা ভাষা থেকে।
* ‘ত’ এর ‘ ্’ (হস্) যুক্ত বা হসন্ত রূপকে একটি পূর্ণ বর্ণ হিসেবে আমরা চিনি ‘ৎ’ (খন্ড-ত) নামে। ‘ত’ এর সাথে হস্ চিহ্ন যুক্ত হয়ে যদি ভিন্ন বর্ণ গঠন হয় তাহলে বাকী বর্ণগুলোও তো তা হওয়ার দাবিদার। ফলে বর্ণটিকে বাড়তি হিসেবেই দেখে থাকেন ভাষাবিদগণ।
* উচ্চারণে মিল থাকায় ‘য়’ কে স্বরবর্ণে স্থানান্তর করা যেতে পারে।
প্রস্তাবানুসারে বাংলা বর্ণমালার উপর এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালালে স্বরবর্ণ দাড়াবে ৮টি ও ব্যাঞ্জনবর্ণ ২৭টি। মোট ৩৫টি। স্বরবর্ণ ৮টি হলো, অ, আ, ই, উ, এ, ঐ, ও, য়। এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ ২৭টি হলো,
ক, খ, গ, ঘ, ঙ/ং, চ, ছ, জ, ট, ঠ, ড, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, র, ল, শ, হ, ড়, ঁ।
‘কার’ প্রসঙ্গ
* স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘কার’ নিয়ে আছে কিছু কথা। ‘পড়েছি’ শব্দকে ভাংলে পাই, প+ড়+এ+ছ+ই। লক্ষনীয়, শব্দে উল্লেখিত স্বরবর্ণ দু’টি এ এবং ই, ড় এবং ছ এর পরে অবস্থিত হলেও লেখার সময় কিন্তু আগে লেখা হয়। অর্থাৎ, বর্ণের উচ্চারণ এক জায়গায় আর অবস্থান আরেক জায়গায়। এর ফলে দু’টো জটিলতা তৈরি হয়। এক হলো ভাষায় নবাগতদের বুঝার ক্ষেত্রে। অপরটি হলো কম্পিউটারে টাইপ করার ক্ষেত্রে। ইউনিকোড বর্ণে ‘কার’গুলো স্বতন্ত্রভাবে বসতে পারে না। না পারারই কথা। কারণ, এককভাবে শুধু ‘কার’র কোনো উচ্চারণ হয় না। ফলে ‘কার’র বোতামটা আগে চাপার পরও বর্ণের বোতাম চাপার পরে তা ভেসে উঠে। কিন্তু বাদ দিতে গেলে ঘটে তার উল্টো। ‘কার’টাই আগে বাদ পড়ে যায়। বিজয় ক্লাসিক বর্ণে এমনটা না ঘটলেও সেটা তো কেবলই প্রিন্টের জন্য। আর ইউনিকোড হলো ওয়েবপেইজ ও সফটওয়্যারের টেক্সট বক্সসহ সর্ব জায়গায় স্বীকৃত (সাপোর্টেড)। সুতরাং বলাই যায় ইউনিকোড বর্ণের দাপটে বিজয় ক্লাসিক এক সময় হারিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘ-ঈ বাদ যাওয়াতে বর্তমান ‘ ী’কে (দীর্ঘ-ঈ কার) হ্রস্ব-ই কার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
* হ্রস্ব-উ কার, দীর্ঘ-ঊ কার ও ঋ-কার জায়গাবিশেষ ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যবহার হয়। যেমন, ন্তু, গু, রু, হু। কূ, রূ। কৃ, হৃ। এগুলোকে কি অভিন্ন রূপ দেয়া যায় না? যে কোনো বর্ণের সাথেই বসুক ‘কার’গুলোর মূল রূপ অর্থাৎ, ু, ূ ও ৃ বহাল রাখতে কোনো অসুবিধা আছে বলে মনে করি না।
উচ্চারণ প্রসঙ্গ
* এমন কিছু বর্ণ ও যুক্তবর্ণ রয়েছে ব্যবহারের সময় যেগুলোর মূল উচ্চারণ একতরফাভাবে উপেক্ষিতই থেকে যায়। সেগুলো হলো, জ+ঞ=জ্ঞ। কখনো উচ্চারণ হয় ‘গ’ এর মত আবার কখনো ‘গ+গ’ এর মতো। যেমন, জ্ঞান, বিজ্ঞান। ক+ষ=ক্ষ। কখনো উচ্চারণ হয় ‘খ’ এর মতো আবার কখনো ‘খ+খ’ এর মতো। যেমন- ক্ষণ, লক্ষ ইত্যাদি। বর্ণ অনুসারে উচ্চারণ নির্ধারণ অথবা যুক্তব্যাঞ্জন দু’টি বাদ দিয়েও সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
* ‘ঃ’ (বিসর্গ) নিয়ে আছে মেলা কথা। নামের সাথে উচ্চারণের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া একই শব্দে জায়গাবিশেষ দু’ রকম উচ্চারণ হয়ে থাকলেও জানি না সমস্যাটা কোথায়। যেমন: দুঃখ ও দুঃখী। প্রথমটায় ‘খ’ এর দ্বিত্ব উচ্চারণ করি আর দ্বিতীয়টায় বিসর্গের কোনো প্রভাব নেই। ‘হ-জাত’ ও ‘র-জাত’ নামক দু’টো উচ্চারণ বিসর্গের থাকলেও তার ব্যবহার খুবই সীমিত। নিয়ম-নীতির গন্ডি পেরিয়ে শ্রুতিনির্ভর ব্যবহারই জুটে তার ভাগ্যে। বর্ণটিকে একেবারেই বাদ দেয়া যায় কি না ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
* বাংলা ভাষায় যে অপ-উচ্চারণটি খুব বেশি ক্রিয়াশীল তাহলো, ‘অ’ এর সংবৃত উচ্চারণ। প্রকৃতিগতভাবে প্রতিটি বাংলা ব্যাঞ্জনধ্বনীর সাথে একটা করে স্বরধ্বনী যুক্ত থাকে। শব্দের মধ্যে কিছু কিছু ব্যাঞ্জনবর্ণের সাথে বাহ্যিক স্বরবর্ণ বা ‘কার’ না থাকলেও যুক্ত থাকে উহ্য স্বরবর্ণ ‘অ’। এই উহ্য স্বরবর্ণ ‘অ’ এর উচ্চারণ সংবৃত অর্থাৎ, ‘ও’ এর মতো হয়। যেমন, হব। আমরা বলি হবো। এরকম আরও কয়েকটি শব্দ হলো, যাব/যাবো, ছিল/ছিলো, আসক্তি/আসোক্তি ইত্যাদি। যেহেতু ‘অ’ বর্ণ নিয়মিত ‘ও’ এর মতো উচ্চারণ হচ্ছে সেহেতু এরকম শব্দগুলোকে ও-কার দিয়েই লেখা যায় কি না ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
যুক্তবর্ণ প্রসঙ্গ
বাংলা যুক্তবর্ণ নিয়ে জটিলতার শুরুটা জানা থাকলেও শেষটা অজানা। যুক্তবর্ণ বাংলা ভাষার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি। এই যুক্তবর্ণ বাংলা ভাষাকে দিয়েছে বাড়তি শ্রুতিমাধুর্য। দিয়েছে বাড়তি শব্দ ভান্ডারও। এটি বাড়তি কিছু সুবিধা যেমন দিয়েছে, তেমনি তৈরি করেছে কিছু বড়তি জটিলতাও। কর্তৃপক্ষ চাইলে খুব সহজেই যৌক্তিক উপায়ে জটিলতাগুলো নিরসন করতে পারেন। সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে পারেন আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে। গঠনগতভাবেই সাধারণত প্রতিটি ব্যাঞ্জনবর্ণের সাথে একটি করে স্বরবর্ণ যুক্ত থাকে। প্রত্যক্ষ স্বরবর্ণ না থাকলেও অন্তত পরোক্ষ স্বরবর্ণ ‘অ’ যুক্ত থাকে। জায়গাবিশেষ সেই অদৃশ্য স্বর ‘অ’ বাদ দেয়ার জন্যই ব্যবহার করা হয় ‘ ্’ (হস্ চিহ্ন)। ব্যাঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণ না থাকলে অর্থাৎ, ‘ ্’ যুক্ত হলে বর্ণটি তার স্বাতন্ত্র ও স্বতন্ত্র-রূপ দু’টোই হারিয়ে ফেলে। স্বাতন্ত্র হারিয়ে ব্যাঞ্জনটি পরের ব্যাঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। দু’টো ব্যাঞ্জনের প্রথমটি থেকে স্বরবর্ণ উঠিয়ে দিলে একটি অপরটির সাথে যুক্তভাবে লেখার এই প্রক্রিয়াকে বলে যুক্তবর্ণ বা যুক্তব্যাঞ্জন। স্বরবর্ণ উঠিয়ে দেয়ার ফলে প্রথম বর্ণটি তার স্বাতন্ত্র হারিয়ে ফেলে বটে; তার মানে যে দু’টো বর্ণ মিলে ভিন্ন কোনো নতুন বর্ণ সৃষ্টি হয় তা কিন্তু নয়। যুক্ত হয়ে বসলেও উচ্চারণে যেহেতু বর্ণ দু’টি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে না। বরং বর্ণ দু’টোরই উচ্চারণ তথা অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে, সেহেতু যুক্ত হয়েও প্রতিটি বর্ণপ্রতীক স্বতন্ত্রভাবে ফুটিয়ে তোলা চাই। কদাচিৎ দু’-এক জায়গায় পূর্ণ-বর্ণ অক্ষুণœ রাখা না গেলেও মূল বর্ণের নমুনা অন্তত রাখা চাই।
* সংযুক্ত দ্বিতীয় বর্ণটি যদি ‘য’ হয় তবে তা সাধারণত ‘্য’ (য-ফলা) আকারে লেখা হয়। বর্ণটি ‘য’ এর প্রতিনিধিত্ব করলেও মূলের সাথে তার কোনো দৈহিক মিল নেই। অনুরূপ সত্য ‘ধ’ এবং ‘থ’ এর বেলায়। যেমন- প্রযোজ্য, অন্ধ, গ্রন্থ।
* কিছু যুক্তবর্ণ এমন রয়েছে যেগুলো প্রথম বর্ণ বা দ্বিতীয় বর্ণ যেকোন একটির নমুনা হারায়। অপরটির ঠিক থাকে। সেগুলো হলো, ক্র, ক্স, ঙ্ক, ঞ্চ, ট্ট, ষ্ণ। যেমন- বক্র, বাক্স, অঙ্ক, অঞ্চল, ছোট্ট, উষ্ণ ইত্যাদি।
* কিছু যুক্তবর্ণ রয়েছে যেগুলোয় দু’টি বর্ণই তার চেহারা হারায়। সেগুলো হলো, ক্ষ, হ্ম, ঙ্গ। যেমন- লক্ষ, ব্রাহ্মন, অঙ্গ ইত্যাদি।
* আবার কয়েকটি যুক্তবর্ণ রয়েছে যেগুলোতে উভয় বর্ণ ফুটে উঠলেও একটুখানি সংশোধন আনা প্রয়োজন। সেগুলো হলো, ক্ত, ঞ্ছ, ঞ্জ। ‘ক্ত’ এর ক্ষেত্রে পূর্ণ ‘ক’ এর নিচে পূর্ণ ‘ত’ বসিয়ে এবং বাকী দু’টোর শুরুতে ‘ণ’ চিহ্নিত অংশ বাদ দিয়ে এই সংশোধনী আনা যেতে পারে।
* কিছু যুক্তবর্ণের যুক্ত রূপ বাদ দিয়ে কেবল হস্ যুক্ত পরিপূর্ণ দু’টি বর্ণ পাশাপাশি বসিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
* দেখুন, একই বর্ণ কখনো সংযুক্ত হিসেবে আবার কখনো ‘ফলা’ হিসেবে দু’টি ভিন্ন রূপে ব্যবহার হচ্ছে। যেমন, পর্যন্ত, অবশ্য। একইভাবে দু’টি যুক্তবর্ণের প্রথমটি যদি ‘র’ হয় সেটি তার মূল চেহারা হারিয়ে ‘র্ ’ (রেফ) আকারে বসে। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ণটি যদি ‘র’ হয় তখন আবার ফলা হয়ে যায়। যেমন, কর্ম, ন¤্র।
* এ, ও এবং ত্র, ত্ত বর্ণ দু’টি ও যুক্তবর্ণ দু’টি গঠনগতভাবে একই রকম হওয়াতে নতুন জটিলতা তৈরি হয়। কেবল মাত্রাগত পার্থক্য থাকলেও এই দ্বন্দ্বটা একটু বড়ই বলা যেতে পারে। অথচ এই সাদৃশ্যপূর্ণ দু’টি বর্ণ ও যুক্তবর্ণের মধ্যে কেবল গঠনগত মিল ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ, একটি অপরটির যুক্তবর্ণেরও কোনো রূপ নয়।
পরিভাষা/সম্বোধন প্রসঙ্গ
* সম্বোধনগত পরিভাষা নিয়েও আছে দু’টো কথা। ছোটবেলা থেকেই স্বরবর্ণগুলোর নাম আমরা জেনে আসছি এইভাবে, ‘স্বর-অ’, ‘স্বর-আ’, ‘হ্রস্ব-ই’, ‘দীর্ঘ-ঈ’, ‘হ্রস্ব-উ’, ‘দীর্ঘ-ঊ’। আজ মনে হচ্ছে বারবার ‘স্বর’ আর ‘হ্রস্ব’ এর উচ্চারণটা আমরা অহেতুক করেছি। এগুলো যে স্বরধ্বনী আর দু’টো স্বরধ্বনীর উচ্চারণ যে সংক্ষিপ্ত হয় বাকী দু’টোর বেলায় দীর্ঘ হয় তা জেনে রাখলেই হতো। প্রতিবার উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিলো বলে মনে হয় না। তাহলে আমরা স্বরবর্ণগুলো এভাবে পড়তে পারি, ‘অ’, ‘আ’, ‘ই’ (না টেনে), ‘ঈ’ (টেনে), ‘উ’ (না টেনে), ‘ঊ’ (টেনে)।
* ‘ক’ আর ‘ষ’ মিলে যে যুক্তবর্ণটি গঠিত হয় তার রয়েছে স্বতন্ত্র নাম। খিয়ো। অন্য কোনো যুক্তবর্ণের ভিন্ন নাম না থাকলেও এটির বেলায় ভিন্নতা তৈরি করছে এক প্রকার বৈষম্য। জন্ম দিচ্ছে নতুন জটিলতার। অনেকে এটিকে একটি স্বতন্ত্র বর্ণ মনে করেন। ‘ক্ষ’ যুক্তবর্ণটি ভিন্ন নাম পেলে প্রতিটি যুক্তবর্ণই ভিন্ন নাম পেতে পারে। তদ্রুপ সংযুক্ত ‘র’ যদি ‘রেফ’ হিসেবে নতুন নাম পায় অন্যান্য বর্ণগুলোও যুক্ত হওয়ার সময়ে কেন নতুন নাম পাবে না? প্রস্তাব করছি, ‘রেফ’ নামটার বদলে র-সংযুক্ত নামকরণ করা হোক।
* ‘ফলা’ বলেন আর ‘সংযুক্ত’ বলেন দু’টো পরিভাষাই আমরা ব্যবহার করে থাকি যুক্তবর্ণদ্বয়ের দ্বিতীয়টির বেলায়। একই কাজে কেন দু’টো পরিভাষার ব্যবহার? আমরা কি পারি না দু’য়ো ক্ষেত্রে একই পরিভাষা ব্যবহার করতে? যেমন, স্বর-অ তালব্য-শ ব-সংযুক্ত (ব-ফলার পরিবর্তে); অশ^। কিংবা ক মূর্ধণ্য-ষ ট-ফলা (ট-সংযুক্ত এর পরিবর্তে); কষ্ট। অথবা চাইলে আরেকটি ভিন্ন উপায়েও বলা যায়। তাহলো, স্বর-অ দন্ত-ন’য় ত (ত-সংযুক্ত এর পরিবর্তে); অন্ত।
* এ পর্যায়ে একই উচ্চারণের দ্বৈত বর্ণগুলো বাদ পড়াতে কিছু বর্ণের নামও সংক্ষেপ হয়ে যাবে। তখন ‘জ’কে বর্গীয়-জ বলতে হবে না। শুধু ‘জ’ বললেই চলবে। একই কথা প্রযোজ্য ন, শ, ড়, অ, আ, ই, উ এর বেলায়।
বানানগত ও অন্যান্য
* য-ফলার সাথে আ-কার দিবো কি দিবো না সে নিয়ে আছে আরেক দ্বন্দ্ব। নেই কোনো নিয়ম-নীতি। সম্পূর্ণ অনুসরণ আর শ্রুতিনির্ভর ভাষার এই ব্যবহার আর ক’ কাল চলবে তা বোধ করি আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। উদাহরণ হিসেবে ব্যক্তি, ব্যয়, ব্যস্ত, ব্যাপী, ব্যাপক, ব্যাপার ইত্যাদি শব্দগুলোকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
* বাক্যের মধ্যে য-ফলার হরেক রকম উচ্চারণ তৈরি করে আরেক জটিলতা। কখনো ‘এ’ এর মতো। কখনো ‘য’ এর মতো। আবার কখনো দ্বিত্ব উচ্চারণ। যেমন- ব্যাঙ, উদ্যোগ, উদ্দেশ্য। য-ফলার এইসব ব্যবহার বাদ দেয়া যায় এ-কার, পূর্ণ ‘য’ ও দ্বৈত বর্ণের ব্যবহারের মাধ্যমে। একই রোগে আক্রান্ত ‘ম-ফলা’ ও ‘ব-ফলা’।
* এই য-ফলা আবার কখনো মূল অক্ষরের উচ্চারণটাই বদলে দেয়। যেমন, ঐতিহ্য, বাহ্য।
পরিভাষা, বানান, উচ্চারণ ও সম্বোধনের রীতি-নীতি নির্ধারণ করে দিবে বাংলা একাডেমী। বাস্তবায়নের পথে পরিচালনা করবে সরকারের শিক্ষা-মন্ত্রণালয় শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, গণমাধ্যমে প্রচার ও গণসচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে। কারণ, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সু-নিয়ন্ত্রিত না হলে ভাষা-বিক্রিতির সমূহ আশঙ্কা থাকে।
প্রবন্ধে উল্লেখিত বিশ্লেষণ, আপত্তি ও প্রস্তাবগুলো পড়ে অনেকে অনেক রকম মন্তব্যই করতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন, ভাষা গতিশীল একটি মাধ্যম। তা সব সময় এক রকম থাকে না। ভাষাভাষী ও সময়ের প্রয়োজনে তা পরিবর্তন হয়, হতে বাধ্য। তাছাড়া ভাষার এই যে নিয়ম-নীতি অর্থাৎ, ব্যাকরণ, তা কোনো মানুষই তো তৈরি করেছে। মানুষের প্রয়োজনে মানুষের জন্যই তৈরি করেছেন। এটা তো দৈব কোনো বাণী নয় যে, আর পরিবর্তন করা যাবে না। সুতরাং আসুন, যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই গড়ে নেই আমাদের বাংলা। ইংরেজি ভাষার মত হড় হড় করে বলতে থাকি আর লিখতে থাকি। আমাদের এই প্রাণপ্রিয় ভাষা বাংলাকে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য করে তুলি বিশ্বব্যাপী।
লেখক:
ইয়াছিন আরাফাত
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৯ ভোর ৪:০৫