ক্লাস সেভেন-এইট থেকে জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়তাম। আমি ঠিক জানি না, অন্ধভক্ত কাকে বলে? যদি এক বসাতে একজন লেখকের একটা বই শেষ করাকে বলে অন্ধভক্ত , তাহলে আমি উনার লেখার অন্ধভক্ত। তখন প্রথম আলোতে স্যার নিয়মিত লেখেন, আমি ও সেগুলো বেশ ভালো ভাবে পড়ি। স্যারের লেখাগুলো পড়লে সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে - এটা হচ্ছে উনার কলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক, আমার কাছে মনে হয়। এরকম অনেক বার হয়েছে স্যারের কলামের কোন একটা অংশ আমার কাছে একপেশে মনে হচ্ছে, কিন্ত তারপরেও স্যার লেখাটা এমনভাবে লিখেন, যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
যাইহোক, আব্বুর অনিচ্ছা সত্বেও ভর্তি হলাম স্যারের ডিপার্টমেন্টে। আব্বু চাচ্ছিলেন না, আমি এতো দূরে গিয়ে পড়াশুনা করি। আমি আবার ভর্তি পরীক্ষায় ৩য় হয়েছিলাম। ভর্তির দিন, যে প্রথম হয়েছিল তার আগে আমার ফর্ম ফিলাপ করা হয়ে গিয়েছিল, তাই স্যারের কাছে সবার আগে আমাকে ই যেতে হয়েছিল। খুঁজে খুঁজে স্যারের রুম বের করলাম, রুমের দরজার কাছ থেকে অনুমতি চাইলাম, স্যার আসব? স্যার বললেন, আসতেই হবে তোমাকে? আমি বললাম, স্যার আপনার একটা সিগনেচার ছাড়া আমার ভর্তি প্রক্রিয়াটা শেষ হবে না। স্যার বললেন, তাহলে তো তোমাকে আসতেই হবে। প্রথমবার আমার প্রিয় একজন লেখকের সঙ্গে কথা বলার অনুভূতিটা ছিল পুরাপুরি অন্যরকম। তো ভেতরে ঢুকার পরে, স্যার জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি ফার্স্ট হয়েছো? আমি বললাম না, ৩য় হয়েছি, যে ১ম হয়েছে তার আগে আমার ফর্ম ফিলাপ করা হয়ে গিয়েছে, তাই আমি ই প্রথম আপনার কাছে এসেছি। স্যার বললেন, একটু অপেক্ষা কর, আমি তোমাদের ভর্তি প্রক্রিয়াটা একটু জেনে নিই। এই বলে স্যার পাশের রুমে গেলেন, এবং একটু পরে স্যার আসলেন শীষ বাজাতে বাজাতে। একজন নামকরা বয়স্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যে ছাত্রের সামনে শীষ বাজাতে পারে - জীবনে প্রথম দেখলাম। ভবিষ্যতে দেখব বলে আশা করি না। যাইহোক, স্যার রূমে ঢুকে বললেন, হুমম কোন সমস্যা নাই, দাও তোমার ফর্মটা। আমার ফর্মটা হাতে নিয়ে স্যার আমার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করলেন এবং সবশেষে বললনে, তুমি কুষ্টিয়া থেকে এখানে পড়তে আসছো, ব্যাপারটা কি? আমার সরল উক্তি - স্যার আপনার জন্য, আপনি এই ভার্সিটির কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্টে আছেন, তাই। স্যার বললনে, তাই নাকি? খুব ভালো, মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।
আমি এই লেখার প্রথমে নিজেকে স্যারের অন্ধভক্ত বলে যে ধারনা করেছিলাম, সেটা মনে হয়, ঠিক না। কারন, অন্ধভক্ত হলে স্যার যে আমাকে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে বলেছিলেন, সেটা করতাম। কিন্ত আমি আমার ভার্সিটি লাইফ খুব মনোযোগ সহকারে স্যারের সেই কথাটি অমান্য করে পার করেছি। এতে অবশ্য পাশ করার পর আমার বিশেষ কোন অসুবিধা হয় নাই। কারন, পড়াশুনা না করলেও প্রোগামিং ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবেই মনে স্হান করে নিয়েছিল। আমার অধিকাংশ বন্ধুরা যখন প্রাইভেট টিঊটর হিসাবে নাম-ডাক করে ফেলেছে, তখন আমি সফটওয়্যার ফার্মে পার্ট টাইম কাজ করি এবং সেটা বেশ ইঞ্জয় করি।
কাজের কথায় আসি, যেদিন আমদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস, সেদিন ভার্সিটিতে উপস্হিত হলাম একটু আগেভাগেই। নির্দিষ্ট সময়ে আমি আমাদের হল রুমে উপস্হিত হয়ে বসে থাকলাম। একটু পরে পুরা হল রুম ভর্তি হয়ে গেল ছাত্র-ছাত্রীতে। আরো একটু পরে দেখি, জাফর স্যার আসলেন। স্যার এসে দেখলেন, স্যারদের বসার জন্য কোন চেয়ার-টেবিল নাই। সব বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই ফাকে সবাইকে একটা ব্যাপার বলে রাখি, জাফর স্যার কিন্ত একাধারে একজন অধ্যাপক এবং ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তো তিনি যদি একটু আওয়াজ দেন, তাহলে ৩/৪ জন পিয়ন ছুটে আসে কোন কাজ করার জন্য।কিন্তু দেখলাম, স্যার কাউকে না ডেকে নিজে সমস্ত চেয়ার-টেবিল(টিচারদের) ঠিক করে সাজালেন। পুরাপুরি অবাক করা ব্যাপার। এই জিনিস ও মনে হয় আর কখনো দেখব না। একটু পরে অন্যান্য স্যাররা ও আসলেন, এবং যথারীতি ওরিয়েন্টেশন শুরু হলো। সব স্যার আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। সবশেষে জাফর স্যার কিছু কথা বললেন।
স্যার বললনে, দেখো তোমারা অনেক আশা নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছো, কিন্তু আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পার ক্রেডিট ৩০০০ টাকা, আর আমাদের এখানে পার ক্রেডিট মাত্র ৩০টাকা। তাই সবসুবিধা হয়তো আমরা দিতে পারবো না, কিন্ত আমদের আন্তরিকতার কোন অভাব থাকবে না। স্যার আরো বললেন, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের হেড দের কাছে সরাসরি যাওয়া যায় না, অফিস সহকারীর রুম দিয়ে যেতে হয়। কিন্ত তোমারা যে কোন সমস্যা নিয়ে আমার কাছে সরাসরি চলে আসতে পারো, কোন সমস্যা নাই। যে কোন ব্যাপার শেয়ার করতে পার। আরো বললেন, ভার্সিটি লাইফ হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, তাই এটাকে এঞ্জয় করতে হবে, শুধু পড়াশুনা করলে হবে না, খেলাধূলা, গান, নাটক এসব ও করতে হবে। আরো বললেন, পাবলিক ভার্সিটিগুলো চলে মূলত সাধারন খেটে খাওয়া মানুষদের টাকায়, তাদের শ্রমে। তাই তোমারা এখানে পড়তে এসে মারামারি করবা, মিছিল করবা, এইটা হবে না। তারপর স্যার বললেন, দেখো তোমরা সবাই এখানে নতুন এসেছো, অনেক সমস্যা ফেস করবা, কিন্তু যখন ই কোন প্রবলেম ফেস করবা, তখন মনে করবা, একটা নতুন জিনিসের সাথে পরিচয় হচ্ছে।
এভাবে, সংক্ষেপে স্যার কিছু গুরুত্বপূর্ন কথা বলেছিলেন এবং স্যারের কথা শেষ হওয়ার পরে ই ভার্সিটি লাইফের প্রথম ক্লাস। সেই প্রথম ক্লাস ও জাফর স্যারের । এটা স্যারের একটা ইচ্ছা - প্রতিটি ব্যাচের ভার্সিটি লাইফের প্রথম ক্লাস এবং ভার্সিটি লাইফের শেষ ক্লাস স্যার নিবেন এবং ব্যাপারটা স্যার মেইনটেইন করেন প্রতি ব্যাচের ক্ষেত্রে। আমরা যখন ৪/২ সেমিস্টারে, তখন স্যার এর কারনটা ব্যাখ্যা করলেন। স্যার বললেন, আমি আসলে লাস্ট সেমিস্টারের একটা কোর্স (ফাইবার অপটিক্স) নিই মূলত দেখার জন্য - তোমরা গত চার বছরে কত্টা শিখেছো, কতোটা স্মার্ট হয়েছো, আমরা তোমাদের কতটা শিখাতে পেরেছি।
আজ এ পর্যন্ত ই।