রাতের তৃতীয় প্রহরে হঠাৎ উপলদ্ধি, ইলেক্ট্রনিক খাতাটা খোলা রেখেই অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলাম। ধবধবে পর্দায় ক্ষুদ্র, কৃষ্ণ বর্ণগুলো কী এক অভিমানে জ্বলজ্বল করছে! মিডিয়া প্লেয়ারে একটানা বেজে চলেছে 'ইসারা'। ব্যাগপাইপের মোহিনী সুরে হারিয়ে যাওয়া কিছুটা সময়ের জন্য। বারান্দার অন্ধকারে, হালকা হিম হিম বাতাসের চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আমি।
দূরে কোনও সুউচ্চ দালানের এগারো তলার এক কুঠুরীর তীব্র আলোয় ফিকে হয়ে যায় তার বাসিন্দার গহীনের কৃষ্ণবোধ !
*
চোখটা খুলে বালিশের পাশে রাখা সেলফোনে সময়টা দেখে নেই, রাত ২টা বেজে ১৮। বুঝতে পারছি, ভেতরের অজানা এক অস্থিরতাই অসময়ে ঘুমটা ভাঙালো।
পেছনের বাসার পাঁচতলা ছাদে রাখা সুবিশাল চৌবাচ্চা উপচে ক্রমাগত পানি ঝরছে। ঘড়ির কাঁটার প্রতি উদাসীন কেয়ারটেকারের বদান্যতায় মধ্যরাতে শুনে যাচ্ছি ঝিরঝির জলসঙ্গীত। যেন ভূপৃষ্ঠের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সব বেদনার তরলায়িত বর্ষণ শেষ না হলে থামবে না এ সঙ্গীত।
আর গলির মুখে এলাকার অঘোষিত প্রহরীগুলোর সমস্বরে চিৎকার। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলো কি? নাকি শুধুমাত্র সতর্ক করিয়ে দেয়া। মেইনরোডটায় শোনা যায় মালবোঝাই অথবা মালবিহীন ট্রাকের গমগমে কণ্ঠস্বর।
জলসঙ্গীত চলছে এখনো ।
*
নৈঃশব্দেরও যে একটা সুর আছে, জানা ছিল না। কংক্রিট জঙ্গলে বসে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনবো, এমনটা আশা করিনি কখনো। কিন্তু নৈঃশব্দের এই সুরটা অনেকটা ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের মতই শোনাচ্ছে, ক্ষীণ একটা সুর। হঠাৎ দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে ওঠে। আর পাশের রাস্তায় কখনো সখনো শোনা যাচ্ছে মধ্যরাতের নিঃসংগ কোনও রিক্সার টুংটাং বেলের শব্দ। অথবা কোথাও থেকে থেকে বেজে ওঠে রাতপ্রহরীর হুইসেল।
আবার নিস্তব্ধতা। সুর শোনা যায় এই স্তব্দ সময়ের।
৬ হাত দূরত্ব বজায় রাখা পশ্চিমের বাসার বারান্দাটার বাতিটা জ্বলে উঠলো হঠাৎ। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য জেগেছেন প্রাতঃ প্রার্থনার উদ্দেশ্যে। আর নিভে গেল দক্ষিণের দোতলার ঘরটার বাতি। হয়ত ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত মানুষটির এখন নিদ্রা যাবার সময়।
রাত শেষ হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে এক এক করে আজানের ধ্বনি। পাশের রাস্তাটায় এখন নিঃসংগ রিক্সার সঙ্গী একটি-দুটি সি,এন,জিও। রাতপ্রহরীর হুইসেল বেজে ওঠে আবারও। হয়ত আজকের জন্য এটাই তার শেষ হুইসেল। এরপর আসবে অন্য কেউ, দিনের আলোতে।
এক এক করে জেগে উঠছে এক একটি ঘর। জাগছে শহর।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৪:৫২