আমরা ৯০'স কিডস রা যখন শৈশব বা কৈশোরে গান শুনতাম, তখনো সিডির প্রচলন তেমন হয়নি। ক্যাসেট প্লেয়ারেই বেশিরভাগের হাতেখড়ি আমাদের। পালা করে ক্যাসেট কেনা, নতুন অ্যালবাম কবে আসবে তার জন্যে বসে থাকা আর বিকেলের অবসরে কিংবা রাতের আড়ালে ক্যাসেট প্লেয়ারটা নিয়ে বসে পড়া। মায়ের দিকের ফ্যামিলি সংস্কৃতি অনুরাগী ছিলো। মাও গানের ব্যাপারে সর্বভূক ছিলেন বলা যায়। বেশিরভাগ দিনেই আমার সাথে বসে পড়তেন গান শুনতে। আমি যেটা করতাম, লিরিক আগে থেকে জেনে নেয়ার চেষ্টা করতাম, যাতে কোন সংকোচপূর্ণ লিরিক আম্মুর সামনে বেজে না ওঠে। আমরা তখন একটু বেশি রক্ষণশীল ছিলাম হয়তোবা, প্রেম ভালোবাসার কথাও একটু ডিরেক্টলি বললে সংকোচ হতো বাবা মার সামনে শুনতে। তাই কোন ক্যাসেটের ছবিটবি যদি একটু রিভিলিং হতো, (যেগুলো ইংরেজী গানের অ্যালবাম গুলোতে প্রায়ই পাওয়া যেত) সেটা আমরা কেটে শুরু পেছনে সং লিস্টটাই রেখে দিতাম। এভাবেই চলত গান শোনা। প্রাইভেটলি কমই শুনেছি গান। সিডি যখন আসলো, সিডি ম্যান যখন একটা পেলাম তার আগ পর্যন্ত আসলে তেমন একটা হেডফোনটোন দিয়ে গান শোনা হয়নি সেভাবে। মাঝে মাঝে মনে হতো- আচ্ছা ক্যাসেট দেখেই যদি বুঝে ফেলা যেত ভেতরে গানগুলো ক্যামন, তাহলে সেগুলো সেভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে শোনা যেন সামনাসামনি না শুনে! পরে দেখলাম- আসলে এমন একটা সিস্টেম আছে। বেশ অনেকদিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে!
সেই সিস্টেমের নাম হচ্ছে প্যারেন্টাল অ্যাডভাইজরি লেবেল বা PAL. যারা নিয়মিত সিডি কিনে গান শুনতেন তারা নিশ্চয়ই এই স্টিকারটার সাথে পরিচিত! এটাই PAL. আজ চলুন জেনে ফেলি এই সাইন বা স্টিকারের পেছনের গল্প!
আমেরিকান একটা সংস্থা আছে, রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা (RIAA), এরাই প্রথমে এরকম লেবেল প্রচলন করে। লিরিকের কন্টেন্টে প্রোফানিটি বা অবসিন কথাবার্থা থাকলে বাবা-মা যেন নিজেদের শিশুদের সেগুলো শোনা থেকে বিরত রাখতে পারেন, সেরকম চিন্তা থেকেই এর প্রচলন করে RIAA.
প্যারেন্টস মিউজিক রিসোর্স সেন্টার (PMRC) নামের একটি সংস্থা ফর্মড হয় ১৯৮৫ সালে। এর পরপরই তারা ১৫ টি গানের একটা লিস্ট প্রকাশ করে, যেগুলোর লিরিকে প্রোফানিটি বা ভালগার কন্টেন্ট খুঁজে পায় তারা। RIAA লেবেলিং এর আইডিয়া দেয়, কিন্তু PMRC সেটা খুব একটা পছন্দ করেনি। সমঝোতায় আসতে না পেরে ১৯৮৫ এর ১৯ সেপ্টেম্বরে ইউএস সিনেট কমিটি অন কমার্স, সায়েন্স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন এর একটা হিয়ারিং এ এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এই সেই হিয়ারিং এর ভিভিওঃ (মোট তিনটা পার্ট)
হিয়ারিং এ ফ্রাঙ্ক জাপা, জন ডেনভারের মত গুণী শিল্পীরা টেস্টিফাই করেন এই মর্মে যে কোন সেন্সরশীপ বা লেবেলিং এর প্রয়োজন আদৌ নেই। হিয়ারিং এর মাস দুয়েক পর অর্গানাইজেশন দুটি সমঝোতায় আসে যে এখন থেকে অ্যালবাম কভারে Explicit Lyrics: Parental Advisory কথাটা ব্যবহার করা হবে যখন প্রয়োজন।
প্রথম যে গানটার প্রতি ভালগার ল্যাঙ্গুয়েঞ্জ ব্যবহাররের এলিগেশন আসে, সেই গানটার নাম ডারলিং নিকি- শিল্পী ছিলেন প্রিন্স। গানটায় মাস্টারবেশনের মতো কন্টেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিলো অবলীলায়। লেবেল ছিলো বলে গান শুনবেন না তা কি হয়! এই সেই গানঃ
১৯৯০ সালে আমরা এখনযে সাদাকালো লোগোটি দেখি সেটার প্রচলন ঘটে। প্রথম যে অ্যালবাম এ এই লেবেল যুক্ত হয় সেটা হচ্ছে Banned in the USA যা 2 Live Crew নামের হিপহপ গ্রুপের অ্যালবাম ছিলো।
মে ১৯৯২ এর মাঝে ২২৫ এরো বেশি অ্যালবাম এ এই লেবেল বসে যায়। এই লেবেল সামান্য পরিবর্তন করে এক্সপ্লিসিট কন্টেন্ট কথাটা ব্যাবহার করা হতে থাকে ১৯৯৬ থেকে এবং এভাবেই ২০০২ পর্যন্ত চলে। ২০০২ সালে Bertelsmann Music Group এবং তাদের সাথে এফিলিয়েটেড রেকর্ড লেবেল গুলো নতুন ধরণের ওয়ার্নিং সিস্টেম চালু করে "strong language", "violent content", or "sexual content" এই ধরণের শব্দ ব্যবহার করার মাধ্যমে।
বর্তমানে অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিসে গান শোনা এবং ক্লাউড সার্ভিস থেকে গান কেনা খুবই জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ায় ২০১১ সাল থেকে অনললাইনেও এই লেবেল ব্যবহার করা শুরু করা হয়।
একটা কমন প্র্যাক্টিস হচ্ছে, যেসব গান বা অ্যালবাম এই লেবেল পেয়ে যায়, তারা মেইনস্ট্রিম মার্কেটের জন্যে সেই গানগুলোর ক্লিন ভার্শনও রিলিজ করে যেখানে কোন প্রোফানিটি বা ভালগার কথাবার্থা থাকেনা। কখনো সেন্সর করে দেয়া হয় আর কখনোবা ওই জায়গায় লিরিক নতুন করে লেখা হয়ে থাকে।
আমার জানামতে বাংলাদেশের মিউজিক সিনে এই লেবেল ব্যবহার করার নজির নেই। অসমাপ্ত ১ অ্যালবাম এ অর্থহীন মজা করে ব্যবহার করেছিলো যাতে লেখা ছিলো- "প্যারেন্টাল অ্যাডভাইজরিঃ অ্যাডিক্টিভ কন্টেন্ট"
এই লেবেল আপনার গান শোনার অভ্যাসে কোন পরিবর্তন এনেছে কি? জানাতে পারেন মন্তব্যে।
কোথা থেকে এলো- টাইপ একটা সিরিজ শুরু করতে চাচ্ছি। এই লেখাটা সেই সিরিজের প্রথম লেখাও ধরে নেয়া যেতে পারে। আপনাদের উৎসাহ পেলে অবশ্যই নিয়মিত পোস্ট করার চেষ্টা থাকবে।
ফেসবুকে এই ভিডিওটা দেখলাম প্রজেক্ট নাইটফলের। ভিডিওটা পোস্টের সাথে কিছুটা রিলেটেড। সময় পেলে দেখে মতামত জানাতে পারেনঃ
প্রজেক্ট নাইটফল - we killed MUSIC
শুভরাত!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৫২