ভূমিকা:
জাতির মন কীভাবে বুঝা যায়? রাজনৈতিক দলের নেতারা মাঠের বক্তৃতায় এরকম একটা ধারণা দেন যে জাতির নাড়ির স্পন্দন তাদের আঙুলের ডগায়। এসব বক্তৃতায় যাদের আস্থা নেই তারা মনে করেন নিজের মতকেই জাতির মত হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন রাজনৈতিক নেতারা। সমাজবিজ্ঞানীরাও তত্ত্ব-উপাত্তের পরিসংখ্যান সাজিয়ে নানা মাপজোঁক করেন। তবে এর বেশিরভাগই তারা করেন ঘটনা ঘটার অনেক পরে। অর্থাত্ রোগী মারা যাওয়ার পরই মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ডাক্তারের। ভবিষ্যতের গতি-প্রকৃতি বুঝা যায় এরকম একটা সামাজিক জ্যোতিষশাস্ত্রের অভাব এক্ষেত্রে আমরা বোধ করতে পারি, যা ব্যথা সারাতে না পারলেও মলমের কাজ করতে পারতো। কিন্তু ঠাট্টার কথা বাদ দিলেও, স্বীকার করতে হয় জাতির মন বুঝতে নানা অনুমানের হাত ধরা ছাড়া উপায় নাই। যদি কোনো যাদু-পদ্ধতিতে জানতে পারতাম জাতির মনোভাব তবে কি সহজেই না আমরা বলতে পারতাম জাতি এখন কী চায়।
এক লাইনের প্রশ্ন আর তিনটা মালটিপল চয়েস দিয়ে দৈনিক পত্রিকারা হরদম অপিনিয়ন পল চালায়। কিন্তু এরকম জনমত যাচাই করে শাসনতন্ত্রের সংকটের মত বিশাল বিষয়ে জনগণের মনোভাব বুঝা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা অনিবার্য প্রশ্ন হলো, কী ভাবছে জাতি - বর্তমান শাসন-সংকটে? এই সাধারণ প্রশ্নটাও পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে যায়, কারণ পাল্টা একটা প্রশ্ন তোলা যায়, আদৌ কি এটা কোনো সংকট জাতির কাছে?
অনেকেই প্রায়ই ইঙ্গিত করেন যে, রাজনীতি নিয়ে জাতির কোনো মাথাব্যথা নেই। সমস্যা ও সংকটে জাতির আপাত: নিষ্ক্রিয়তায় অভিমান করে আমরা জাতিত্বেই দোষারোপ করি। জাতি হিসেবে বাঙালির বিবেক-বুদ্ধি-আবেগ-স্মৃতি গতি-প্রকৃতি নিয়ে নানারকম ঠাট্টা করে বাঙালি নিজেই। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন বাঙালির চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে এসে সেনাশাসনের পক্ষে তালি বাজায় । হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, বাঙালির স্মৃতিশক্তি গোল্ড ফিশের মতই খুবই ক্ষণস্থায়ী। ‘কী চাইলাম আর কী পাইলাম’- এর হিসাবে সে গড়মিল লাগায় যেকোনো সময়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে তাই আগে স্মরণ করা দরকার আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
প্রেক্ষাপট:
নব্বইয়ের এরশাদ সরকারের পতনের পর নতুন করে গণতন্ত্র পাওয়া বাংলাদেশ দেখেছে তিন-তিনটি সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকার। ক্ষমতার অদল-বদলও হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে। প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রের পথে এই পথচলাটা আবার একটা সুবাতাস এনেছিল রাষ্ট্রের জীবনে। তবে শাসনব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি, নির্বাচন বা সংসদীয় কার্যক্রম ত্রুটি বা বাধামুক্ত ছিল না, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ দায়িত্বশীল ছিল না। তারপরও বোদ্ধা মহলে আশা ছিল ধীরে ধীরে দেশে গণতন্ত্র শিশু রূপ থেকে প্রাপ্তবয়স্কতা পাবে যথাসময়েই। ২০০৬ সালে সর্বশেষ ক্ষমতাবদলের সময় এসে দেশের গণতন্ত্র নতুন সংকটে পড়ে।
কোনো দলীয় সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন আয়োজন করতে দিলে সে নির্বাচন অবাধ হয় না, এই ধারণা জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার ১৯৯০ এর প্রতিরোধেই। সংবিধান সংশোধন করে তাই এসেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা। কিন্তু বিরোধী দল দাবী তুলে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারা-উপধারার নানা ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার নতুন কৌশল তৈরি করেছে। বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে নিজেদের পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বানানোর পরিকল্পনা, নির্বাচন কমিশনার পদে বিতর্কিত লোক নিয়োগ, প্রশাসনকে নিজের পক্ষের লোক দিয়ে সাজানো, ইত্যাদি যুক্তি দেখায় বিরোধী দল তাদের দাবীর পক্ষে। কিন্তু বিরোধী দলের এসব দাবীকে অগ্রাহ্য করে সরকারী দল তাদের পরিকল্পনা বহাল রাখে। এরই এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি একইসাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানও হয়ে যান। বিরোধী দল রাষ্ট্রপতির এই পদগ্রহণকে সাংবিধানিক ক্যু হিসেবে চিহ্নিত করলেও পরিস্থিতি মেনে নেন। কিন্তু যখন বাকী উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ না করে রাষ্ট্রপতি তার দলের সমর্থনে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন তখন চারজন নির্দলীয় উপদেষ্টার পদত্যাগের মাধ্যমে বিরোধীদলের দাবীর বাস্তবতাই প্রতিধ্বনিত হয়। নতুন নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রপতি এটা সামাল দিলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি ঘটে না।
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলেও নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও অন্যান্য দাবীপূরণ না হওয়ায় নির্বাচনের প্রার্থিতাপত্র প্রত্যাহার করে নেয় বিরোধীজোটের রাজনীতিকরা। নির্বাচন হওয়াটা তখন ছিল একটা প্রহসন মঞ্চস্থ হওয়া মাত্র। সংবিধান ও শাসন-সংকটের এই টানাপোড়েনের মাঝে রাষ্ট্রপতিকে তার মূলপদে ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আবির্ভূত হয় দশ সদস্যের একটি সরকার। সংবিধান-অসমর্থিত হলেও একেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেই চিহ্নিত করা হয়। নানা সূ্ত্রের দাবী ও বাস্তব উদাহরণ এটাই প্রমাণ করে যে, নতুন এই সরকারের শক্তির খুঁটি হচ্ছে সেনাবাহিনী।
দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে মৌলিক অধিকার স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। মিডিয়া সেই খড়গে পড়লেও একদিনের মাথায় তারা দেনদরবার করে শর্তসাপেক্ষে নিজেদের প্রকাশনা অব্যাহত রাখার সুযোগ পান। মিডিয়ার একটা অংশের প্রাথমিক সমর্থনও পায় এই সরকার। কিছু দলছুট রাজনৈতিক নেতা, এনজিও হর্তাকর্তা এবং কিছু অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (বুদ্ধিজীবি বা সুশীল সমাজের ব্যানারে) বর্তমান সরকারের ক্ষমতাগ্রহণকে জায়েজ বলে ঘোষণা দেন। রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও অর্থহীন নির্বাচন থেকে দেশ রক্ষা পাওয়ায় সাধারণ নাগরিকও স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেন।
কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না নতুন সরকারের মধ্যে। জাতীয় সরকার গঠনের একটা গুজব শোনা যায়। নোবেল পাওয়া এনজিও কর্তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, কিন্তু সে দল যথার্থ জনসমর্থন পাবে না এরকম আশংকায় আঁতুড় ঘরেই মৃত্যুবরণ করে। বিকল্প রাজনৈতিক দল তৈরির ধারণার পর বা পাশাপাশি শোনা যায় মাইনাস-টু তত্ত্ব। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের একটা ধারণা হঠাত্ দল ও দলের বাইরে প্রবলভাবে আলোচিত হতে থাকে। এদিকে দুর্নীতির দায়ে প্রধানত: রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আটক ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ঘটনা ঘটতে থাকে। রাজনীতির ছাতার নীচে বিভিন্ন নেতাদের দুর্নীতির বয়ান দেখে সাধারণভাবে দেশবাসী আতংকিতই হয়ে উঠেন।
দুর্নীতি বিরোধী অভিযান বিপুল প্রশংসাও পায়। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সময়ক্ষেপন, দুর্নীতিবাজদের ধরার ক্ষেত্রে দৈ্বতনীতি, রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে হস্তক্ষেপ, বিশেষ দলের নেতাদের প্রতি ছাড়, নানা রকম ষড়যন্ত্রের গুজব ইত্যাদি কারণে নতুন সরকারের প্রতি জনগণের উচ্ছাসে ভাটা পড়তে শুরু করেছে।
নির্বাচন কমিশন আগামী ২০০৮-এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তৈরি করেছে। কিন্তু যা নিয়ে এত গন্ডগোল, সেই নির্ভুল ভোটার তালিকার বিষয়ে তাদের অগ্রগতি খুব ধীর। চারদলীয় জোট সরকারের নিয়োগ দেয়া বিতর্কিত নির্বাচন কর্মকর্তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দেখা যাচ্ছে অহেতুক বিলম্ব। তাছাড়া পত্র-পত্রিকার ভাষ্যের অর্ধেকও যদি সত্য হয় তবে এরকম একটা ধারণা জনমনে আছে যে ২০০৮-এর পরেও যাতে মূল দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না আসতে পারে সেরকম একটা হিসাবের ছক কাটছে বর্তমান সরকার। কোনো সন্দেহ নাই এ অত্যন্ত গুরুতর ষড়যন্ত্রের সন্দেহ।
নব্বই পরবর্তী সময়ে সৈ্বরশাসক ও সৈ্বরশাসনের সুবিধাভোগীরা যেমন ছিল ব্যাকফুটে এখন দেশে গণতন্ত্র আনা দলগুলোর নেতা-নেত্রীদেরও একই অবস্থা। দুর্নীতিতে চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশে এখন রাজনীতিই দুর্নীতির সমার্থক। দেশে জরুরি অবস্থা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে সংবিধানের সময়সীমা। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতি আর অপ্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকারের হাতে শাসনভার থাকায় অনুমান করা দুরুহ নয় যে সবচে বিপদের মুখে আছে গণতন্ত্র । দেশ ও জাতির জন্য এ এক ঘোর সংকটের সময়।
এই ক্রান্তিকালে যখন মৌলিক অধিকার স্থগিত তখন প্রথমেই যে প্রশ্নটি তুলতে হয় তা হলো, কেমন আছে দেশ ও দেশের জনগণ? এই নবতর সংকটে কী ভাবছেন জনগণ, কীভাবে তারা দেখছেন এই পটপরিবর্তনকে, কীভাবে মূল্যায়ন করছেন তারা অতীত-বর্তমান আর কেমন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বা আতংক দেখছেন তারা। নি:সন্দেহে জটিল ও দুরুহ প্রশ্ন এগুলো। কিন্তু যত জটিল শোনাক এসব প্রশ্ন, যত কঠিন হোক এসবের উত্তর সন্ধান, যত ভুলের আশংকা থাকুক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে; যথার্থ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছাড়া জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই।
(আসুন এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিজেরাই বের হই। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নয়া প্রেসক্রিপশন আসার আগে আমাদের কিছুটা প্রস্তুতি তৈরি হোক।)
গবেষণার রূপরেখা:
তিনটি বিশেষ অবস্থা ও ধারণাকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করার পর ধাপে ধাপে আমরা সিদ্ধান্ত নেয়ার মত জায়গায় পৌঁছাতে পারি। দেশ পরিচালনা নিয়ে এখন যে ধারণা, ভাবনা-চিন্তার কথা বলা হচ্ছে এবং এসব ধারণার বিপরীত যেসব ধারণা বিরুদ্ধ যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এই দুই ধারার ভাবনারই একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যায়। করে দেখা যেতে পারে এই দুইপক্ষের ভাবনা থেকে বিভিন্ন সূত্র নিয়ে আমরা নতুন একটা সম্মিলিত ভাবনধারা তৈরি করতে পারি কিনা। তবে এই দুই ভাবনাধারা বিশ্লেষণের আগে আমাদেরকে শাসনকার্যের সংকটের রূপটাকে চিহ্নিত করতে হবে। অর্থাত্ সংকট সম্পর্কে জনগণের মনোভাবটাও বুঝা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ কী ছিলো তা নিয়ে আমরা এখনও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করি। সুতরাং এগারো জানুয়ারির আগে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের সংঘাতের মূলে কী সংকট ছিল তা স্পষ্ট করা দরকার। দেশ হিসেবে তখন আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং কোনদিকে যেতে চাইছিলাম।
ক্ষমতাসীন দল অবশ্যই ছিল স্ট্যাটাস-ক্যুর পক্ষে, যেরকম চলছে সেরকম চলুক। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষের দাবীতে ছিল নানারকম পরিবর্তন,যেসব পরিবর্তন তাদের ভাষায় নির্বাচনের জন্য লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে।
বিরোধীপক্ষের দাবীর মধ্যে মূল তিনটি বিষয় ছিলোঃ
১. নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানো।
২. জাল ভোটার বাদ দিয়ে একটি সংশোধিত ভোটার তালিকা তৈরি করা।
৩. সরকার ও সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতির বিচার শুরু করা।
(কিন্তু এই দাবীগুলোই তো আর সংকট নয়। কি কারনে ক্ষমতা হস্তান্তরে একটা গভীর সংকট ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল বলে আপনি মনে করেন? আপনার মনের কথা বা ধারণাটাই মন্তব্যে দিন। সেগুলো যোগ করলে হয়তো প্রথম পর্বের কাজটা শেষ হয়ে যাবে।)