পুরো অনলাইন কমিউনিটিতে ঝড় উঠেছিলো ইদানিং ধর্ষণের ঘটনাগুলো নিয়ে । আমরা দিল্লীর মেয়েটাকে নিয়ে অনেক হৈ চৈ তারপর টাঙ্গাইলে মাধ্যমিক শ্রেনীতে পড়া একটি মেয়ে অথবা ডাঃ সাজিয়া আফরিনের কথাও বলা যায় নইলে সাভারের ধর্ষন বা কয়েকদিন আগের ক্লাস ফাইভের মেয়েটার কথা ।
আমি প্রতিটা দিন দেখছি, আর আমি ঠিক জানিনা এই তালিকায় কবে আমার নামটাও যুক্ত হবে । আমি ইদানিং বের হলে আমার মা বারবার ফোন করে । দামিনী মেয়েটা কোমায় থাকাকালীন অবস্থায় ২বার হার্ট এট্যাক করেছিল, আপনি কি চিন্তা করতে পারেন কত ভয়ংকর একটা স্মৃতি যা তাকে কোমায় থাকা অবস্থায় ও রেহাই দেয় নাই?আমার চোখে পানি এসে পড়েছে এবং আমি আমার বন্ধুকে বলছিলাম যে তোমার সামনে কেউ আমাকে এভাবে ধর্ষণ করে ফেলে রাখলে ১৩পর আমিও মরে যেতাম এটা দিল্লীর দামিনী না হয়ে ঢাকার দূর্বা ও হতে পারতো ।
এবার আসি আমার আসল রূপে । আমার এই বিষয়ক একটা স্ট্যাটাসে আছি, যেখানে আমি নোংরা স্ল্যাং ব্যবহার করেছি এবং আমি কিছুটা পরিমার্জিত করে স্ট্যাটাসের পুরো ব্যাপারটার অংশ নিয়ে কথা বলবো । আর মূল স্ট্যাটাসটা প্রথম কমেন্টে থাকবে ।
ধর্ষন করা কোন মানুষকে আমি ভদ্র ভাষায় কিছু বলতে আগ্রহী নই তবুও যেহেতু এখানে প্রচুর মানুষ পড়বে তাদের কথা ভেবেই ।
কয়দিন আগে একজন বিশিষ্ট স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে, এইযে এত রেপ হচ্ছে তার মূল কারণ মেয়েদের পোশাক বা শরীর দেখিয়ে বেড়ানো । ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠিন আইন প্রণয়নে কিছুই হবেনা বরং মা-বোনকে বলতে হবে ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করতে তাহলে ধর্ষন কমে যাবে, তারা নিরাপদে থাকবে । সবচে বড় ব্যাপার এসব মডেল বানানো বন্ধ রাখতে হবে ।
সে যে বললো মা বোন কে ইসলামী শিক্ষা দিতে, ঠিক আছে দিলাম । কিন্তু কয়েকদিন আগে যে মারমা মেয়েটা ধর্ষণ হলো সে তো মুসলিম না তার মানে সে ইসলামী শিক্ষা পাবেনা তারমানে মুসলিম বাদে সকল মেয়েদের যারা ইসলামী শিক্ষা পায় নাই তাদের ধর্ষণ করার অধিকার আছে ছেলেদের?
বাংলাদেশে যে অন্যধর্মের মানুষ আর আদিবাসী থাকে তাদের গুরত্ব কি নাই?
বাংলাদেশে আমরা প্রায়ই দেখি স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েগুলোকে রেইপ করছে (ধর্ষন শব্দটি আর না ব্যবহার করি), মেয়েগুলোকে রেইপ করে খুন করছে বা মেয়েগুলা আত্মহত্যা করছে । এই যে এতগুলো রেপ কেইস আপনি কি মনে করেন যে এগুলোর মূল কারণ শুধু শরীর দেখিয়ে বেড়ানো? আমার মনে আছে, আমি যখন সিক্সসেভেনে পড়ি আমার মা আর বোন আমাকে যাত্রাবাড়ী বা গুলিস্তান এলাকায় খুব আগলে আনতো । বাসে উঠার সময় বা পহেলা বৈশাখের ভীড় যেটাই হোক খুব সাবধানে আনতো । আমি ব্যাপারটা জানতাম না, টের পেলাম একদিন যখন যাত্রাবাড়ীতে একটা লোক আমার গায়ে হাত দেয় । আমি এতটা অবাক হয়েছি যে কাউকে বুঝাতে পারবোনা, আমি কেঁদেছিলাম । আমার বোন আমাকে শিখিয়েছিল এরকম কেউ কিছু করলে রাস্তায় কিভাবে পিটাতে হয় ।
বেশিরভাগ মেয়ে লজ্জার কারণে চুপ করে থাকে, কিছু বলেনা । আমি এরকম পরিস্থিতিতে বিশ্বাস করতাম না যে লজ্জাই নারীর ভূষণ, আমি পিটাতাম যত পারতাম পিটাতাম । এমনো হয়েছে যে মারতে গিয়ে হাত কেটে গেছে, কিন্তু আমি থামতাম না কারণ আমি জানতাম আমিই ঠিক । এসব ব্যাপারে সাপোর্ট তো পাইনি বরং চারপাশের মানুষ জড়ো হয়ে গায়ে হাত দিতে চাইতো, তেড়ে এসে বলতো গায়ে হাত লাগছে তো কী হইছে?
তখন মনেহত রাস্তাঘাটে মেয়েদের শরীর জাতীয় সম্পদ যে যখন ইচ্ছে যেভাবে খুশি হাতানোর অধিকার রাখে । আমার কাছে যেটা মনেহয় যেসব ছেলেরা দেখেনা তাদের সামনে নগ্ন হয়ে দাড়িয়ে থাকুক কোন মেয়ে তবুও তাকাবে না । কিন্তু যারা আসলেই অসুস্থ মানসিকতার তারা যেভাবেই হোক ঘরের মা,বোন অথবা মেয়ে তার শরীরের গঠন নিয়েও চিন্তা করবে ।
আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের এত এত রেপ কেসের প্রধাণ কারণ শুধু মাত্র পোশাক?তাহলে কেনো বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে গুলো রেপ হচ্ছে?
যাইহোক, আমি মানুষের বিভিন্ন মত দেখেছি ধর্ষণের স্বপক্ষে বা পোশাক নিয়ে । আমি নিচে একটা একটা করে বলছি ।
মত ১ : যারা বলতেছে শিশু আর বোরখা পরিহিতরা কেন রেপ হইছে তাদের উত্তর হল তোমাদের মতো নেংটিরা তাদের ক্ষিধা বাড়ায় আর তারা ক্ষিধা মেটানোর জন্য কাউকে না পেয়ে ওদের ধরে । কি করার বল? তোমরা তো ধর্ম পালন ও করতে দেওনা আবার নেংটাও হইতে চাও। নেংটা হওয়ার প্রতি তোমাদের কেন দুর্বার আকর্ষন!
মত ১ এর উত্তর আমি দিয়েছিলাম, আপনি যখন পর্ণ দেখে উত্তেজিত হন তারমানে আপনি আপনার বাসায় মা বোন যাকেই সামনে পান তার উপরেই চড়াও হন বুঝলাম ।
মত ২: বোরখা না পড়লে যত মেয়ে আছে সব মেয়েকে রেইপ করাই উচিত, ঐসব ** আছেই *** জন্য । মত ২ এর উত্তর আমি আসলে খুঁজে পাইনি । বাংলাদেশে যেসব মেয়েরা বোরখা পড়েনা তাদের রেইপ করার অধিকার আছে একথাটা একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষই বলতে পারে ।হয়তো তার ঘরের প্রত্যেকটা নারীসদস্য বোরখা পড়ে!
মত ৩: এক মেয়ে বাসে ওঠার সময় এক কন্ডাক্টর তার গায়ে হাত দিলো । মেয়েটা কিছু না বলে হাসিমুখে মেনে নিলো । সব দোষ মেয়েদের । মেয়েরাই রেপ করার সুযোগ দেয় ।
মত ৩ এর উত্তর দিয়েছিলাম, একটা মেয়ে মেনে নিয়েছি বলে তাই নয় সব মেয়েরা তাই করবে । ভীড়ের মাঝে কেউ দেখেছেন যে কত মেয়ে নিজেদের প্রটেক্ট করার জন্য ব্যাগ বুকে নিয়ে হাটে ।
মত ৪: আপনারা এমন ড্রেস পড়েন তাই আমরা রেপ করি । পাতলা জামা পড়া সব মেয়েরে রেপ করা উচিত ।
মত ৪এর উত্তর ছিল, ছোট বেলায় বাচ্চাদের গরমের জন্য পাতলা জামা পড়ানো হয় । তারমানে পাতলা জামা পড়ে বলে সেই বাচ্চাগুলোকেও আপনারা রেইপ করার অধিকার রাখেন?
মত ৫: বয়ফ্রেণ্ডের লগে শুইলে দোষ নাই কেউ রেপ করলে দোষ!
মত ৫এর উত্তরে বলেছি, লাভ মেকিং আর রেপের সংজ্ঞা এক নয় ।
সবচে হাস্যকর ব্যাপার সবাই মেয়েদের পর্দা করতে বলছে,বোরখা পড়তে বলছে । কিন্তু এত ধর্মের দোহাই দিয়ে যে বলছেন পর্দা করার কথা, ধর্মে তো বলা আছে ছেলেদের দৃষ্টি নত রাখতে (সূরা নূর: আয়াত ৩১-৩২) সব ক্ষেত্রে কেনো মেয়েটার উপরেই চাপিয়ে দেয়া হবে?বোরখা হিজাব করেও কি ডক্টর সাজিয়া রক্ষা পেয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সবাই উইকি থেকে রেপের পরিসংখ্যান তুলে দেয় ।
অন্য দেশের সামাজিক সমস্যার সাথে তুলনা করতে করতে নিজের দেশের সমস্যাকে সমস্যা বলে মনেই হয়না । নিজের দেশকে আমেরিকার সাথে তুলনা করে শান্তি পাচ্ছি, "ওয়াও! ঐ দেশে আমাদের দেশের চে বেশি অপরাধ হয় । উই আর লাকি!"
কিন্তু আমেরিকা দেশটা আয়তনে যত বড় বাংলাদেশে একটা ছোট দেশ সেই তুলনায় অপরাধ অনেক বেশি ।
সারাজীবন অন্যের দেশের সাথে নিজের তুলনা করছি বলেই আজ এই অবস্থা, সবসময় খারাপটা নিয়েই তুলনা করি ।কিছু বললেই এসে পড়ে একটা পরিসংখ্যান নিয়ে, দেখেন দেখেন ঐ দেশে আমাদের চে কত খুন,ধর্ষন হয় ।
হ্যাঁ আরো অনেকে যুক্তি দেখায় মিষ্টি খুলে রাখলে মাছি তো বসবেই । এখন আপনি জোর করে দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেতে যান দোকান ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে । একটা মেয়ে পোশাক ঠিকভাবে পড়ছে কি না পড়ছে না তার মানে এই না যে আপনি তাকে ধর্ষণের অধিকার রাখেন ।
ঠিক আছে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক কোন মেয়ে চললে ধর্ষণ কম হবে ।কিন্তু যারা মুসলামান নয় তাদের কি হবে?আমার পরিচিত এমন অনেকে আছে যারা মাদ্রাসায় হুজুর দ্বারা রেইপ হয় । অবশ্য ছেলেরাও হয় । আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, কয়েকজন ছাড়া কেউ অতটা লজ্জিত নয় যে তাদের জাতভাইরা এই কাজ করে বেড়াচ্ছে,বরং তারা অহংকার বোধ করছে এই কারণে এবং বেশ জোর দিয়েই বলছে যে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে ।
গতকালের একটি ঘটনা বলি, আমি ফুচকা খেতে একা বের হয়েছি এলাকায় । এম্নি এলাকার আশেপাশে কোথাও যাইনা, এলাকায় বিশাল ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে । আমি কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি কোন প্রকার বিকৃতি না করে,
"ইসলাম একমাত্র শান্তির ধর্ম অন্য কোন ধর্ম শান্তির না, অন্য ধর্ম ছোটলোকের ধর্ম । বলেন ঠিক কিনা?"
"কয়েকদিন আগে যে ইণ্ডিয়ায় ধর্ষন হইছে ভারতে যদি হিন্দু থেকে সবাই মুসলমান হত তাহলে মেয়েটা ধর্ষন হতো না"
"বাসে যদি মেয়েটা হিজাব বোরখা পড়তো তাইলে আল্লাহর কসম সেই মেয়েকে কেউ ধর্ষন করতো না! কেন করতো না?কারণ সে আল্লাহর পথে আছে হেদায়েতের পথে আছে। রাস্তায় যে ইভটিজিং হয় ধর্ষন হয় তার কারণ বোরখা না পড়া । রাস্তায় দাড়িয়ে মানববন্ধন করে কোন লাভ নাই, আছে ভাই? নাই নাই নাই! "
আমার মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল এই কথা শুনে । একে তো অন্য ধর্মকে ছোট করছে, তার উপর মেয়েদের পোশাককে দায়ী করছে আবার বলছে ইভটিজিং বিরোধী মানববন্ধনে কাজ হবেনা বলছে ।
সত্যের পূজারী নামক এক আইডি উত্তর দিলো যে, "গতকালও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণের অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে মসজিদের ইমাম। টাইঙ্গাইলের ছাত্রী, ফরিদপুরের নবম শ্রেণির ছাত্রী এবং মারমা মেয়েটি সহ প্রতিদিন ঘটিত প্রতিটি ধর্ষণ কী ইন্ডিয়ার মালাউনরা আইসা কইরা যায় নাকি? রাত্রে ঘর থেকে বের করে যে ধর্ষণ করা হয়, তাতেও কী বোরকা-হিজাবের জন্য নাকি?
এইসব শুয়োরগুলিকেই আগে গুলি কইরা মারা দরকার।"
আমি আসলে ইদানিং ফেবুর বা অনলাইন কমিউনিটির এসব বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ (?) দেখে খুব হতভম্ব । ফেসবুকে একদিকে আমার বাবা সাপোর্ট দিচ্ছে অন্যদিকে মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে যে দেশের অবস্থা খুব খারাপ আমি যেনো এত এটা নিয়ে কথা না বলি কারণ বাসার সবাই বাইরে কাজ করে আমাকে রেপ করে ফেলে রাখলে আমার কিছু করার নেই । আমি ভেবে দেখলাম আসলেই কিছু করার নেই আমার, আমি অসহায় । কারণ আমার শরীর ছিড়েখুড়ে খাওয়ার পর সমাজ আমাকে আবার ছিড়ে খাবে । ধর্ষিতা হিসেবে কোথাও সম্মান তো দূরের কথা কেউ বন্ধু অথবা সঙ্গী হিসেবেও মেনে নিতে পারবেনা, আমি টিকতে পারবো না!
যখন গতকাল হুজুরের কথা শুনলাম যে মানববন্ধনে কিছু হবেনা তখন আমি ঠিক করলাম যে আমি মানববন্ধনে যাবো । প্রত্যেকটা দিন পরীক্ষা বা যাই থাকুক আমি একটা দিন হলেও ফেবুর চিল্লানি বন্ধ করে পথে এসে দাড়াবো ।
আমার একটা ২বছরের ভাগ্নী আছে, আমার একটা মেয়ে বাচ্চার শখ আমি চাইনা ওরা এরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়ুক, পত্রিকায় দেখুক ওর মত কাউকে কিছু নরপশু ছিড়ে খাচ্ছে!
রেইপ হওয়া একটা মেয়েরে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বিলাপ করার আগে
আসুন রাস্তায় দাড়াই!
আমরা প্রতিবাদ করে দেখায় দেই আমরা শুধু নীল ব্যানারের জুকারবার্গের কমিউনিটিতেই না, বা এতশত ব্লগে নয় আমরা রাস্তায় ও প্রতিবাদ করতে পারি কারণ সেই সত্সাহস আছে আমাদের!
আপনারা নিজেরা যে যেভাবে পারেন প্রতিবাদ করুন, নিজেরা দরকার হলে ইভেন্ট তৈরি করুন । মানুষকে আসতে আহবান জানান ।
সামনের ১১তারিখ আমরা পথে দাড়াবো চাইলে আপনিও আমাদের সামিল হন, আমরা দাড়াচ্ছি পথে,
তবে শুধু ধর্ষিত মেয়েগুলোর জন্য নয়,
সোচ্চার হোন । ফেলানীর জন্য । ময়নার জন্য । সোনাবরুর জন্য ।
সোচ্চার হোন । কল্পনার জন্য । ডাঃ সাজিয়ার জন্য । বিশ্বজিতের জন্য ।
সোচ্চার হোন । সাগরের জন্য । রুনীর জন্য । আগুনে পুড়ে মরা শ্রমিকগুলোর জন্য ।
একদিনের জন্য হলেও ফেসবুকের অনলাইন দুনিয়া থেকে বাস্তবের অফলাইনে চলে আসুন ।
জয়েন আস । স্প্রেড আস ।
বিস্তারিত এই লিঙ্কে
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৫৭