এই করিসটা কি?
- কিছুনা । ফেসবুকে তোর ছবি দেখি নতুন আপ্লোড করছিস যেগুলা ।
- হুমম্, আমাকে সুন্দর লাগছেনা ছবিতে?
- নাহ্, পেত্নীর মত লাগছে একদম । কিন্তু তোর চোখগুলা আসলেই টানে । তুই সবসময় কাজল দিস?
- হু আমার চোখে কাজল দেয়া ফরজ । যেদিন দেখবি আমার চোখে কাজল নাই তাইলে বুঝবি একটা গরমিল হইছে ।
- মারহাবা আমার কাজলা বান্ধবী ।
- চুপ কর । এই সৌম্য, কবিতা শুনবি?
- শোনা ।
-ওকে ফাইন,ওয়েট ।
তুমি লহ নাই ভালবাসিবার দায়
দুহাতে শুধুই কুড়িয়েছো ঝরা ফুল
কৃষ্ণচূড়ার তলে বসে আমি একা
বুনিয়াছি প্রেম ঘৃণা বুনিবার ছলে
-সুন্দর, চিত্রা দোস্ত আমার,ইতু নক করছে পরে কথা বলি,বাই ।
চ্যাট মেসেজটা পড়ে চিত্রা ল্যাপটপটা পাশে রেখে বুকশেল্ফের কাছে দাড়ালো ।লাল মলাটের বইটার ১৮৬ পৃষ্ঠা বের করে পড়তে লাগলো
"অনেক দূরের মানুষকে ভাবি কাছে,
এমন কিছুটা অপরাধ আজো আছে ;
বুকের পাশের সত্যকে ভাবি, নেই ।"
২.
সৌম্য খুব অবাক হয়ে চিত্রার হাওয়াই মিঠাই খাওয়া দেখছে । বাচ্চাদের মত হাতমুখ মাখিয়ে খাচ্ছে,নিষ্পাপ লাগছে খুব । আজ সৌম্যর সিলেটে যাওয়ার কথা ১৫দিনের জন্য, প্রধান কারণ ইতু আর এম্নিতে আত্মীয় স্বজনের বাসায় ঘোরাঘুরি আর কি । ইতুর সাথে ২মাস পর দেখা হবে, তাই একটু এক্সাইটেড । মাঝে মাঝে সৌম্য আফসোস করে লং ডিসট্যান্স প্রেমের জন্য,কেন যে ইতু সিলেট থাকে !
চিত্রা পাশে এসে বসলো,চিত্রার চুলগুলো খোলা, তবুও ওর মাঝে কিসের যেনো একটা অভাব সৌম্য ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা । সৌম্য টিস্যুটা বাড়িয়ে দিল চিত্রার দিকে,চিত্রা মুখ মুছতে মুছতে বললো,
- তোর ট্রেন কত লেট করবে?
- ক্যান তোর কি বিরক্ত লাগছে চিত্রা? চাইলে আরো কয়েকটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দেই ।
- দরকার নাই, ১৫টা দিন ইতুর সাথে খুব ভালো কাটবে তাইনা?
- দোস্ত প্লিজ,এক্সাইটমেন্টের ঠেলায় আমি মইরাই যাব, আর মনে করায় দিসনা ।
- ওকে ফাইন, তোর ট্রেন আসছে এবার যেতে পারিস । এই বলে চিত্রা হাসলো ।
সৌম্য ট্রেনে আয়েশ করে বসার একটু পরেই ছেড়ে দিল ট্রেনটা । ওর ফোনের মেসেজটোন বেজে উঠলো । চিত্রা মেসেজ দিয়েছে...
"দুটি গোলাপই তুমি দিয়ে বসে আছো ,
আমার কবরে তুমি কোন গোলাপটা দিবে? "
হঠাত্ সৌম্য একটা ব্যাপার ভেবে ধাক্কা খেলো, চিত্রার চোখে আজ কাজল ছিলোনা । সেই কারণে আজ ওকে এতটা অন্যরকম লাগছিলো । ও দ্রুত কল দিল, সুইচড্ অফ । ভেতরটা অস্থিরতায় ভরে গেলো..... আসলেই কি কিছু গরমিল হয়েছে?
৩.
ধীরপায়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল । ল্যাপটপটায় প্রিয় গানটা ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাড়িয়ে চোখে গাঢ় করে কাজল টানলো । কিছুক্ষণ পর চোখের জলে কাজল ছড়িয়ে গেলো চিত্রার । ল্যাপটপে তখনো বেজেই চলছে....
And the bright emptiness
In a room full of it
Is a cruel mistress
I feel this unrest
That nest all hollowness
For I have nowhere to go in the cold
And I'm so lonely
There's a better place than this
Emptiness.......
৪.
জার্নি করে এসেই সৌম্য বিছানায় পড়ে দিয়েছে লম্বা ঘুম । ইতুর সাথে এ কয়েকটা দিন অসাধারণ কেটেছে ওর, ও অনেক খুশি ।
সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর মা এসে সৌম্যকে একটা পার্সেল দিয়ে গেলো । পার্সেল দেখে কিছুটা অবাক কারণ ওর কাছে এসব পাঠানোর কেউ নেই । একমগ কফি নিয়ে ধীরে ধীরে প্যাকেটটা খুলতে লাগলো । প্যাকেট থেকে বের হয়ে আসলো লাল মলাটের একটি বই । নির্মলেন্দু গুণের প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা । বইটা দেখে সৌম্য বেশ অবাক হলো কারণ ও কবিতাটবিতা খুব একটা পড়ে না । চেস্ট অব ড্রয়ারে বইটা রাখতে যাবে বইয়ের ফাক থেকে ভাজ করা কাগজটা মেঝেতে পড়লো । তুলে নিয়ে পড়া শুরু করলো......
"সৌম্য,
মৌসুমী ভৌমিকের ঐ গানটা শুনেছিস?
আমার কিছু কথা ছিল, তোমায় বলার কেবল তোমায়
যেই না আমি ঠোট নেড়েছি,সেই কথাটা তলিয়ে গেলো.....
তোর সামনে আসলে বরাবরই এই অবস্থা হয় । সৌম্য, আমি সবকথা খুব সহজে বলতে পারি তবুও কেনো জানি তোকে ভালবাসি কথাটা বলা হয়নি । তুই অবাক হয়ে যাবি জানি কিন্তু আমি ভালবাসতে বড্ড ভয় পেতাম । সেই কোন ছেলেবেলায় শুনেছি বামপাশে থাকা হৃদয়ে এক ছোট্ট বিবর জানার পর মনে হয়েছিল কাউকে ভালবাসার সম্পূর্ণ অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলেছি । মনে হত,ঐ ছোট ছিদ্র দিয়ে কারো প্রতি অপরিমেয় ভালবাসাও চুইয়ে পড়ে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে । তবুও এক শীতের রাতে তোর হাত ধরে রিকশায় পাশাপাশি আসতে আসতে তোকে সাহস করে ভালোবেসে ফেললাম । কেনো এমন হল বলতো?আমি তো কখনো তা চাইনি ।
প্রতিদিন তোকে কবিতা দিয়ে বলতাম তোকে আমি ভীষন ভালোবাসি, তুই সেগুলো নিছক কবিতা ভেবে উড়িয়ে দিলি অথচ প্রতিটা শব্দে আমার অনুভূতি জড়িয়ে ছিল । আমি হয়তো ক্ষুদ্র হৃদয়ের সাহস নিয়ে তোকে বলতাম সবই, কিন্তু তোর সমস্ত সত্তা জুড়ে তখন ইতু । তোকে তখন একটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম মনে আছে?
আমার মাঝে আপন যে জন সে- ই সঁপেছে অন্যেতে মন।
তোমায় কভু চাইনা ভুলে তাই ।
তোমার মাঝে যেটুকু নাই সেটুকু চাই.....
আমি বিশ্বাস করতাম তুই আমার চোখে তাকালে স্পষ্ট বুঝতে পারবি আমি তোকে কতটা ভালবাসি সৌম্য । কিন্তু সবকিছু তোর চোখ থেকে এড়িয়ে গেছে এমনকি আমাদের শেষ দেখাতেও তুই আমাকে বুঝিসনাই ।
চলে যাচ্ছি, অপারেশন অনেক আগেই হওয়ার কথা এবার সব কনফার্ম হলো । আমিও নিশ্চিত ছিলাম অনেক ব্যাপারে যে তুই আমার হবিনা,আমি ফিরবো না এসব । যাক গে, তুই ইতুর সাথে দেখা করার ব্যাপারে এতটাই এক্সাইটেড ছিলি যে তোকে জানাইনি আর । সবকিছু গুছিয়ে চলে যাওয়া অথবা তোর কাছ থেকে পলায়ন । তুই নিশ্চয়ই 'পলাতকার প্রতি' কবিতাটা আমাকে উত্সর্গ করবি না?
লিখতে ক্লান্ত লাগছে, সৌম্য আমি ক্ষণজন্মা তাই আমি তোকে আমার বলে দাবি করিনি কখনো । সত্যি বলছি তোকে ভালোবেসে এক পূর্ণতা পেয়েছি আমি, জানি আর ফিরে আসবোনা ।একটা কবিতা বলি,
'এই নাম এত প্রিয় হবে,
এত কান্নাময় হবে, কে জানতো?
এই জন্ম এত পূর্ণ হবে,
এত প্রিয়ময় হবে, কে জানতো?'
সৌম্য,সৌম্য,সৌম্য,সৌম্য,সৌম্য,সৌম্য ভীষন ভালবাসি তোকে ভীষন.....
তোরই
- চিত্রা "
চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে বইটা খুলে কবিতা চোখে পড়লো,
'ভুলগুলিকে নিজের ভাবি,তাই ভুলিনা,
বেদনা পাই তোমার পরবাসে...'
সৌম্য মাথা নিচু করে বসে রইলো চুপচাপ ।