somewhere in... blog

কেউ আর চিঠি দেয় না

২৯ শে জুন, ২০১০ সকাল ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কেউ আর চিঠি দেয় না। এখন কেউ আর চিঠি দেয় না। আগে প্রতি সপ্তাহে একটা করে বিশাল চিঠি আসত। একটা খামের মধ্যেই ১০-১২টা চিঠি থাকত। চিঠি লিখত আব্বু, চিঠি লিখত আম্মু, লিখত আপি...আর আমার ১৪ গুস্টি। হোস্টলে চিঠি আসত সকালের দিকে, তখন আমরা থাকতাম স্কুলে। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরেই খোঁজ নিতাম কোন চিঠি আসছে কিনা। বেশীর ভাগ দিনই নিরাশ হতাম। খারাপ লাগত...খুব খারাপ লাগত যখন দেখতাম বাসার চিঠি পেয়ে অন্যদের হাস্যোজ্বল মুখ। আজকে মনে হয় চিঠি পোস্ট করতে ভুলে গেসে...কালকে নিশ্চয়ই আসবে।
নিজের অজান্তেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে তীব্র অভিমান এসে বুকে ভর করত। ভুলে গেছে...সবাই ভুলে গেছে আমাকে। আম্মু ও শেষ পর্যন্ত ভুলে গেল??

কোন কারন নাই এই মন খারাপ করার। ২দিন আগেই না একটা চিঠি আসল? বাসার সবাই না আমাকে চিঠি দিল? সেই পুরানো বার বার পড়া চিঠি টাই আবার খুলে পড়তাম। পড়তে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে উঠত বাসার ছবি। কে কি করতেসে তা কল্পনা করার চেষ্টা করতাম। ভাইয়ারা কি করতেসে এখন?? উঠানে ক্রিকেট খেলতেসে?? দাদুর ঘরের জানালার কাঁচ গুলো কি আস্ত আছে এখনো? আপি কি করতেসে?? আমার জন্য কি আপি কান্না করতেসে?? ঠিক আছে করুক কান্না, বাসায় থাকলে তো শুধু বকা খাওয়াইত আব্বুর কাছে।।একদম ঠিক আছে, এখন বুঝুক কেমন লাগে আমাকে ছাড়া থাকতে। আচ্ছা আম্মু কি এখনো আমার আসার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে?? কল্পনা করতে করতেই একসময় স্বপ্নের দুনিয়ায় হারিয়ে যাই।

আব্বুর চিঠি গুলো সবসময় একরকম... উপদেশ আর প্রচ্ছন্ন ধমক দিয়ে একদম ঠাসা থাকত...আমার আব্বু ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না, চিঠিতেও তার ব্যতীক্রম হইত না। এইটা করবা, ঐটা করবা না। রেজাল্ট যেন কিছুতেই খারাপ না হয়। অনেক কষ্ট করে, অনেক আশা নিয়ে তোমাকে এখানে ভর্তি করাইসি। আর থাকত লেখা পড়ার কথা...বাংলা হাতের লেখা প্র্যাকটিস কর তো ঠিক মত? প্রতিদিন দুপুরে ৫টা করে অংক করে রাখবা...bla bla bla….হায়রে কপাল...হোস্টেলে আইসা ও শান্তি নাই। তবুও আব্বুর চিঠি পড়তে খুবই ভালো লাগত। কেননা তখন আমি বিদ্রোহ করা শিখে গেছি।

আম্মুর চিঠি গুলো হত খুব মজার আর খাওয়া-দাওয়া ময়...চিঠি তে আগা-গোড়া শুধু খাওয়ার কথাই থাকত। খাওয়ার কি খুব কষ্ট হয় রে? স্কুলে যাওয়ার আগে নাস্তা করে যাস তো বাবা? দুপুরে কি কি খেতে দেয় রে?? তুই তো মাছ খাস না...তাইলে কিভাবে থাকবি? ডেইলি দুধ খাস তো?? দুধ না খেলে খেলার শক্তি পাবি কি করে? মনে রাখিস...তোকে অনেক বড় হতে হবে, অনেক বড়। আচ্ছা শুন, কোন কাপড় জামা তোর ধোয়ার দরকার নাই। একটা ব্যাগে ভরে রেখে দে, আব্বু দেখা করতে গেলে দিয়ে দিস। এইবার পেরেন্টস ডে তে অনেক মজার মজার রান্না করে নিয়ে আসব...। তুই একদম কান্নাকাটি করিস না। তুই কান্নাকাটি করলে, আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাব।

আর আপি...ও ছিল আমার বিবিসি ওয়ার্ল্ড রেডিও। বাসার কি অবস্থা, কে কেমন আছে, সবাই কি কি করে, তাউমাউ-স্যান্ডি-সিজার কেমন আছে, কাক্কু কত বড় মাছ ধরসে, কে কয়টা বক শিকার করল, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আব্বু আপিকে কিভাবে টর্চার করতেসে, তার কোন বান্ধবী আমাকে খুব মিস করতেসে, কার সাথে তার ঝগড়া লাগল...আপির চিঠি টা পড়লেই বাসার ছবি স্পষ্ট দেখতে পারতাম।মন তখন আরও খারাপ হয়ে যাইত।

একজনের চিঠির কথা খুব বেশী মনে পড়তেসে আজকে। তখন মাত্র হোস্টেলে উঠসি। একদিন স্কুল থেকে ফিরতেই আসাদ ভাই (আমাদের কেয়ারটেকার) একটা হলুদ রঙের খাম দিল। আমি খুবই খুশী হয়ে খাম খুলতেই একদম তাজ্জব বনে গেলাম। আররে এই টা তো বাসা থেকে আসে নাই। আরও অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখি এটা সোনিয়া মারিয়ার চিঠি (আমার ক্লাস-টু এর বান্ধবী)। ৫ পাতার বিশাল এক চিঠি। চিঠি পড়ে আমি হাসতে হাসতে শেষ। অভিযোগ, অনু্যোগ আর অভিমানে ভরা এক কিশোরীর চিঠি। “...তুমি কেমন আছো? আমার কথা মনে পড়ে তোমার? তোমার কথা কিন্তু আমার খুব মনে পড়ে। আমার একটা পেন্সিল তুমি এখনো ফেরত দাও নাই শয়তান। তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলা? জানো, আক্তারী টিচার কে এখন আর ভয় পাই না আমি।...আমাকে চিঠি লিখবে তো? না লিখলে কিন্তু তোমার সাথে আড়ি আড়ি আড়ি...তিন আড়ি। আর কোন দিন তোমার সাথে কথা বলব না…” এই চিঠির উত্তর দেয়ার অনেকবার উদ্যোগ নেয়ার পরেও একমাত্র অলসতার কারনে চিঠি টা আর শেষ করা হয় নাই। হয়ত এক চাপা অভিমানেই আমাকে আর সেও চিঠি লিখে নাই। চিরদিনের জন্য আড়ি হয়ে গেছে...এটা কি প্রেম পত্র ছিল?? কি জানি...

চিঠি পড়তে যতটা মজা লাগত, লিখতে কিন্তু ততটা লাগত না। কিছু লিখতে নিলেই রাজ্যের অলসতা হাতে এসে ভর করত। জীবনের প্রথম চিঠি টা লিখেছিলাম আব্বু কে। ক্লাস থ্রি এর হাউসের ফুটবল টিমে সিলেক্ট হওয়ার খুশিতে আব্বুকে চিঠি লিখসিলাম। অনেক খুশি ছিলাম সেদিন।

আমি মাসে ১টা চিঠি লিখতাম কিনা সন্দেহ আছে। প্রথম লাইন লিখলেই আর দ্বিতীয় লাইন লিখার ইচ্ছা থাকত না। আব্বু চিঠি লিখার জন্য একটা প্যাড কিনে দিসিলো। এক্সময় সেই প্যাড টাও শেষ হয়ে গেল। চিঠি লিখে শেষ হয় নাই, শেষ হইসে অংকের রাফ করে। বাসায় চিঠি লিখার জন্যে আমি একটা template বানায় নিসিলাম। ফ্রি টাইম পেলে একসাথে ৪-৫টা চিঠি লিখে ফেলতাম। সব চিঠি তেই এক কথা ঘুরাইয়ে ফিরায়ে লিখতাম...
“ ...আমি ভাল আছি। তোমরা কেমন আছো? বাসার সবাই ভাল তো? আমি ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করি। লেখাপড়া ভালমত চলছে। আমার জন্য চিন্তা করো না। আসার সময় আমার জন্য নতুন টিনটিন আর চাচা চৌধুরী নিয়ে আসবা...”
এই চিঠি টাও সময়মত পোষ্ট করা হত না। আম্মু মনে হয় আমার চিঠির জন্য চাতক পাখির মনে চেয়ে থাকত। কিন্তু তখন আমার সময় কই???

স্কুলে বাংলা আর ইংলিশ ক্লাসে চিঠি লিখতে হইত। টাকা চেয়ে পিতার কাছে পুত্রের চিঠি, write a letter to your father asking money …তখন চরম বিরক্ত লাগত। ঐ চিঠি আবার বাসায় পোস্ট ও করত।

চিঠির ক্ষেত্রে একটা মজার জিনিস হইল বেয়ারিং (Bearing)চিঠি। এই চিঠি পাঠাতে টাকা লাগে না। আব্বু শিখাইসিল- তোর কাছে যদি স্ট্যাম্প লাগানো খাম না থেকে, তাহলে একটা সাদা খামে চিঠি ভরে যাকে পাঠাবি তার নাম ঠিকানা লিখে খামের উপরে Bearing লিখে দিবি। তাহলেই সে চিঠি পায়ে যাবে। আর যায় কই...পেপারে যত ঠিকানা পাইতাম, খাতার সাদা কাগজ দিয়ে খাম বানায় পেপারের কাগজ Bearing লিখে পোস্ট করে দিতাম। বাসায় চিঠি লিখার সময় পাইতাম না, কিন্তু এইসব বান্দ্রামির জন্য ছিল অঢেল সময়...

এখন অনেক বড় হয়ে গেছি সাথে সাথে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। এখন সবাই sms, email, chatting করে। এখন তো ক্লাস ৫-৬ এর পোলাপান হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কত সহজ হয়ে গেছে এখন যোগাযোগ।

অনেক দিন পর আজকে ঘর গুছাতে যেয়ে পুরানো চিঠি গুলো পেয়ে গেলাম। এক বসায় সব পড়ে ফেললাম। খুব হাসি পাইল, কত্ত immatured ছিলাম আগে। আবার খারাপ ও লাগল যখন উপলব্ধি করলাম- এখন আর কেউ আমাকে চিঠি লিখে না।



সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১০:০৪
৩৩টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কার্যক্রম বন্ধ, কিন্তু দল বহাল: তাহলে ফ্যাসিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলা হচ্ছে কিভাবে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৩ ই মে, ২০২৫ সকাল ৯:১১

কার্যক্রম বন্ধ, কিন্তু দল বহাল: তাহলে ফ্যাসিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলা হচ্ছে কিভাবে?

ছবিটি তৈরি করা হয়েছে DALL·E দ্বারা—OpenAI-এর ইমেজ জেনারেশন মডেল।

বাল (Bangladesh Awami League = BAL), অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

জার্মানিতে নাৎসি দল বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৩ ই মে, ২০২৫ সকাল ৯:৪৭

জার্মানিতে নাৎসি দল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ....

জার্মানিতে যেভাব নাৎসি দল নিষিদ্ধ হয়েছিলঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর নাৎসি দল নিষিদ্ধ করা হয়। মিত্রবাহিনী নাৎসিবাদ নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় দলটিকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফ্যাসিস্টদের পরে উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১৩ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:২৯

আমাদের ধর্মে যারা উগ্রপন্থা সমর্থন করেন, তারা বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, আমাদের নবীজীর যুদ্ধ এবং যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যতবাণীকে টেনে আনেন। ইসলামের শত্রুরাও এতে লাই পেয়ে যান। কিন্তু, নবীজির বেশির... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-১১ (চলো বসি নদীর পাড়ে আজ)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


ভাসবে অথৈ নদীর জলে, অথবা বসবে নদীর কিনারে
দেখবে সূর্য ডোবা?
যেখানে এলোমেলো হাওয়া বয়,
বসবে আমায় নিয়ে একদিন, খোলা আকাশের নিচে?

এত হাউকাউ, এত চাহিদার ব্যাপ্তি ভাল্লাগে না,
কিছু নির্ভেজাল সময় আমায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিল্পী মমতাজ কিভাবে দশমাস আত্নগোপনে ছিলেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই মে, ২০২৫ রাত ৮:৩৩


'ফাইট্যা যায় বুকটা ফাইট্যা যায়' খ্যাত সংগীত শিল্পী গতকাল রাতে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। শিল্পী মমতাজ ফোক সংগীতের জন্য গ্রামে গঞ্জে বেশ নাম করেছিলেন। শিল্পী মমতাজ কে সবাই চিনে মূলত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×