আল্লাহ তায়ালার রহমতে আমি গত দশ বছরে কমপক্ষে ১২ বার চাকরীর ইণ্টারভিউতে বসেছি এবং আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমতে আমার প্রায় সব কয়টা চাকরী হয়েছে। 'প্রায়' বললাম এ কারণে একবার একটা চাকরীতে ইণ্টারভিউতেই রিজেক্ট হয়েছিলাম। ফালতু এক কারণে, বলল - You are not looking smart. কিন্তু তারপরও তারা আমাকে অন্য একটা পোস্টের জন্য অফার করেছিল। আমি বলেছিলাম, যে পোস্টের জন্য এপ্লাই করেছি সেটা হলে আছি, নইলে নাই। আমার সিভিতে একসময় শার্ট পরিহিত ছবি দিতাম। আল্লাহর রহমতে তখনও ইণ্টারভিউয়ের আমন্ত্রণ পেতে সমস্যা হয়নি। এখন সুন্নতি লেবাসেও (টুপি, পাগরী, সাদা জামা) সমস্যা হয় না। ইণ্টারভিউ বোর্ডে সানগ্লাস, গেঞ্জি পরে গিয়েও চাকরী হয়েছে। আবার সুন্নতি লেবাসে গিয়েও চাকরী হয়েছে। একবার দই খেতে দিল। খাওয়ার সময় সে দই উল্টে গিয়ে পড়ল পাঞ্জাবীতে। কিন্তু এতে চাকরী হওয়া আটকায়নি। সাথে করে সিভি নিয়ে গিয়েছিলাম। সিভি দেখল না। বলল, কাজ করতে থাক। ওগুলো পরে দিলেও চলবে। অথচ ওটা কিন্তু কোন সাধারণ প্রতিষ্ঠান ছিল না। আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পন্ন বিরাট প্রতিষ্ঠান ছিল।
আল্লাহর রহমতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেছি। যে কয়দিন ভাল লেগেছে সে কয়দিনই করেছি। যখনই বনিবনা হয় নাই, মনের ওপর চাপ পরেছে চাকরী থেকে অব্যহতি নিতে একমুহূর্ত দেরী করিনি। এক চাকরীতে কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম তারা মসজিদে গিয়ে নামায পড়লে ভালচোখে দেখে না। বললাম, আমাকে মসজিদে নামায পড়তে যেতে দিতে হবে। MD স্যার বলল, আমাদের এখানে নিয়মিত জামাত হয়। আমি বললাম, এটাতো নামাযের রুম না, টিভির রুম, ওয়েটিং রুম। টিভি বন্ধ করে জামাত হয়, জামাত শেষে টিভি ছাড়া হয়। এমন জায়গায় নামায পড়ি না। বলল, আমাদের কিছু করার নাই। আমি বললাম, আমিও তাহলে নাই! আমারও কিছু করার নাই। এই যে রিজাইন লেটার।
২।
একবার চিল্লায় গিয়েছি রংপুর। ছোট একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতাম। ছুটি নিয়ে গিয়েছি। ওমা! চিল্লায় যাওয়ার কিছুদিন পরে দেখি প্রতিষ্ঠান থেকে ফোন করে। বলে, স্যার আসেন। আমাদের বহু কাজ। আমি বললাম, এসব কি বলেন! আমিতো ছুটি নিয়ে আসলাম। তারপরও দেখি বিরক্ত করতেছে। আমি বললাম, দেখেন ভাই, আমি সারা পৃথিবীর উম্মতের একটা ফিকির নিয়ে এসেছি। এখন আপনার কাজ আমার কাছে বড় না। আমি আপনার প্রতিষ্ঠানে আর চাকরী করব না। পরে চিল্লা থেকে ফিরে আসার পর আমাকে অসংখ্যবার চাকরীটা করার অনুরোধ করছে। আমি ঘরে বসে ছিলাম। তাও রাজী হইনি। বলেছি, চিল্লায় গিয়ে যে চাকরী ছেড়েছি, চিল্লা থেকে ফিরে এসে সে চাকরী ধরা সম্ভব নয়। আর এত বড় বড় নার্সিংয়ের ছাত্রী পড়ানোর কাজ আমি আর করব না। সে বলে, ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কাপড় দিয়ে পার্টিশন করে দেব। আপনি তাদের মুখ দেখবেন না। আমি বললাম, যাই বলেন ভাই, আমি আর এ চাকরী করব না।
৩।
ঘরে বসে রইলাম। চিল্লা থেকে শিখে এসেছি, আল্লাহ তায়ালা খাওয়ান, আল্লাহ তায়ালা পরান, আল্লাহ তায়ালা পালেন। আল্লাহ তায়ালা মাধ্যম দিয়েও পালতে পারেন, মাধ্যম ছাড়াও পালতে পারেন। হযরত ইবরাহীম য়ালাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা আগুনের মধ্যে পেলেছেন। হযরত ইউনুস য়ালাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা মাছের পেটে পেলেছেন। লোহার ছুড়ির নীচে হযরত ইসমাইল য়ালাইহিস সালামকে হেফাজত করেছেন। হযরত মুসা য়ালাইহিস সালামের ক্বওমের লাখ লাখ লোককে চল্লিশ বছর মান্না সালওয়া খাওয়ায়েছেন। সাগরের মধ্যে পথ করে দিয়েছেন। আমার মনের মধ্যে কথাগুলো গভীরভাবে বসে গিয়েছিল। আমি আর চাকরী খুঁজি না।
পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখি না, ইণ্টারনেটও চালাই না। আমার এক কথা, আমাকে আল্লাহ তায়ালা পালবেন। আমরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত। একটা কুকুরকেও আল্লাহ তায়ালা পালেন। এত বড় বড় সাগর আল্লাহ তায়ালা বানিয়ে রেখেছেন যার সৈকতেই কোটি কোটি টন বালি আল্লাহ তায়ালা রাখছেন। কোন মানুষকেতো কোনদিন দেখলাম না, এক বস্তা বালি দিতে - যে আল্লাহ! তোমার সাগর সৈকত গড়ার জন্য আমি এক বস্তা বালি দিলাম। এক বালতি পানি সাগরে দিয়ে বলতে যে আল্লাহ! তোমার সাগরে এক বালতি পানি কম ছিল, আমি দিয়ে দিলাম। তো আমার মত এক গুনাহগার বান্দাকে পালতে আল্লাহ তায়ালার আর কি লাগে! অবশেষে মাস না পেরুতেই চাকরী পেলাম। মিরপুর শিশু হাসপাতালে। জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান স্যার ইণ্টারভিউ নিলেন। ইণ্টারভিউ বোর্ডে আরো ছিলেন বাংলাদেশে পেডিয়াট্রিক সার্জারীর অগ্রপথিক ডাঃ এ এফ এম মাসুদ স্যার। আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমতে আমার চেয়ে বেশী একাডেমিক যোগ্যতাসম্পন্ন অনেককে বাদ দিয়ে স্যাররা আমাকেই চয়েজ করলেন। সে চাকরীটা অনেকদিন করেছিলাম। ডিউটি টাইমের পর পুরো সময় রিল্যাক্স। আমি আরো রিল্যাক্স চাইলাম। অতঃপর নানা যোগ-বিয়োগ পরামর্শ করে শিশু সার্জারী বাদ দিয়ে এনেস্থেসিয়া ট্রেনিং শুরু করলাম।
৪।
বিয়ের পর হুট করে সাগরতীরের চাকরীটা ছেড়ে দিলাম। রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে একটা ইণ্টারন্যাশনাল সংস্থার বাংলাদেশী সদস্য হয়ে কাজ করতাম। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে টেকনাফ বীচে চলে যেতাম। ছুটির দিন সকাল থেকেই বীচে হাঁটাহাটি করতাম, ঝিনুক ও প্রবাল কুড়োতাম, স্টার ফিশ দেখতাম। আর সন্ধ্যার পর নির্জন বীচে চাঁদের আলোতে সাগরের শুভ্র ফেনা অবলোকন করতাম। কখনো কখনো বীচের ধার দিয়ে দৌড়াতাম। বিয়ের পর মনে হল সাগরের সৌন্দর্য্য বৃথা। আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরী অর্থহীন। আমাকে বৌয়ের কাছে চলে যেতে হবে।
এক বিকেলে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের কাছে রিজাইন পূর্ববর্তী এক মাসের নোটিশ দিলাম। বিদেশীরা চাকরী ছেড়ে দেয়া লোকদের সন্দেহের চোখে দেখে। পরের দিন আমাকে ডেকে বলল, তোমার আর এক মাস কাজের দরকার নেই। এক মাসের বেতন তোমাকে অগ্রীম দিয়ে দেই। এটা নিয়ে বিদেয় হও। আমি খুশি মনে বিদেয় হলাম। পরদিন সকালে বার্মিজ মার্কেট থেকে বৌয়ের জন্য পাউডার স্নো কিনে বাসে উঠে ঢাকায় চলে এলাম। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই আমার দুনিয়া বিমুখতার জন্য খুশি হয়েছিলেন।
ঢাকায় এসে মহা-উৎসাহে একটা চেম্বার দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিছুটা সফল যে হইনি তা নয়। তবে মাত্র ৯ দিনের মাথায়ই একটা ফোন এল - "স্যার চাকরী করবেন? চাকরী করতে চাইলে আগামীকাল সিভি নিয়ে মুহাম্মদপুরের পরিচর্য্যায় আইসেন।" আমি বললাম, আপনি কে? বলল, আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার মা-কে চিনি। আণ্টি আমাকে আপনার একটা চাকরীর কথা বলছিলেন। আমি পরিচর্য্যার কর্মচারী। পরেরদিন গেলাম। ইণ্টারভিউ নিলেন ঢাকার স্বনামধন্য স্কীন স্পেশালিস্ট ডাঃ পারওয়েজ সালমান চৌধুরী ও তার একজন বন্ধু ও পার্টনার। সানগ্লাস ও গেঞ্জী পড়ে ইণ্টারভিউ বোর্ডে গেলাম। স্যার আমাকে চাকরী হওয়ার কথা দিলেন। আমার একটু পরেই ইণ্টারভিউ বোর্ডে ঢুকেছে স্যারের এক বন্ধুর ছেলে। আমাকে কথা দেয়ায় আর তাকে নেয়া হয়নি। ঐ চাকরীটাও অনেকদিন করেছিলাম। অনেকদিন মানে বেশ কয়েক মাস। স্যার আমাকে শেষ পর্যন্ত ভাল জানতেন। ওখানে থাকা অবস্থায়ই টেকনাফের ছেড়ে দেয়ার চাকরীর ঢাকা অফিসে যোগ দেই। পরিচর্য্যার চাকরীটা আমার আরেক বন্ধুকে হস্তান্তর করে দেই।
বিদেশী সংস্থাটির (MSF) সাথে ২০০৭ সালে ঢাকার বন্যায় ডায়রিয়া ট্রিটমেণ্ট সেণ্টারে কাজ করি। সিডর পরবর্তী ধ্বংসস্তূপে চিকিৎসা দেই, কম্বল ও সাবান বিতরণ করি। ওখান থেকে ফিরে নিপসমে এমপিএইচ - ইপিডেমিওলজি কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই। এমপিএইচ শেষ করে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আর্সেনিক রিসার্চ প্রজেক্টে রিসার্চ মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরী করি। তারপর ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত একটি সংস্থায় (CIPR,B) শিশুদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষনা প্রকল্পে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর পোস্টে কাজ করি। ছয়মাস কাজ করার পর চিল্লায় চলে যাই। চিল্লা থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রবায়োলজি বিভাগে এমফিলে ভর্তি হই। দু' মাস ক্লাস করে হাঁপিয়ে ওঠি। আর কণ্টিনিউ করা হয়নি কোর্সটা। এরপর ভিসা সেণ্টার নামে একটা প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম ডাক্তারী করি। কয়েক মাস পর ভিসা সেণ্টারের পরিচালক বলে আমার কাজকর্ম ওদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। এ কয়মাসে চুক্তি অনুযায়ী ভিসা সেণ্টারে GRE ও IELTS কোচিং বিনে পয়সায় করি। এরপর ইবনে সিনা মেডিক্যালে টিচিং এ ঢুকি। সেখান থেকে মিরপুর শিশু হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক সার্জারীতে। এরপর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে এনেস্থেসিয়া ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেই এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনেস্থেসিওলজি ও আইসিইউ বিভাগে।
তবে আল্লাহ তায়ালার রহমতে যখন থেকে দ্বীনের বুঝ এসেছে তখন থেকে কোথাও নামাযের জন্য ছাড় দেইনি। দ্বীনের বুঝ আসার পূর্বেও আল্লাহ তায়ালা আমাকে সাহায্য করেছেন, দ্বীনের বুঝ আসার পরেও সাহায্য করেছেন। আমার এ ঘটনা থেকে যদি কেউ কিছু শিখতে চান তাহলে বলব,
আল্লাহ তায়ালার ভয়ের চেয়ে আল্লাহর বান্দাদের ভয় অন্তরে কখনো বেশী রাখবেন না। যদি আপনি আল্লাহ তায়ালাকে অসন্তুষ্ট করে তার বান্দাদের সন্তুষ্ট করতে চান - তাহলে অচিরেই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিবেন। আর যদি আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তার বান্দাদের অসন্তুষ্ট করতে হয় - তবে তাই করুন। কারণ তখন আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে আপনার প্রতি সন্তুষ্ট করে দিবেন। রিযিকের পেরেশানী করবেন না। কারণ দুনিয়ায় রিযিক থাকা অবস্থায় আপনি মরবেন না। আর আপনার রিযিক অন্য কেউ খেয়েও ফেলবে না। আপনার জন্য যা বরাদ্দ আছে তা-ই পাবেন। চেষ্টা করলেও বেশী হবে না। দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকে বেশী প্রাধান্য দিবেন। একঘণ্টা দুনিয়াবী কাজ করলে সোয়া একঘণ্টা দ্বীন শিখবেন। আপনি যদি আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের জন্য ঝামেলা মুক্ত হোন তাহলে আল্লাহ তায়ালা আপনার অন্তরকে প্রাচুর্য্য দিয়ে ভরে দিবেন ও আপনার অভাব দূর করে দিবেন। আর যদি তা না করেন, তাহলে আপনার দু'হাতকে ব্যস্ততায় ভরে দিবেন ও আপনার অভাব কখনোই দূর করবেন না। আপনি যদি আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল করেন, তাহলে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তেমনভাবে রিযিকের ব্যবস্থা করে দিবেন যেভাবে পাখীদেরকে রিযিক দিয়ে থাকেন। পাখীরাতো সকাল বেলায় খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ঘরে ফিরে।
____________________
ডাঃ জহির
২৪ মে, ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ সকাল ১১:৫৭