ভালবাসা হল ক্যান্সার প্রভৃতি terminal illness এর মত। ক্যান্সার এর রুগি জানে তার হাতে কয়েকটা দিন মাত্র সময় আছে, তাও সে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে হলেও শেষ কটা দিন টিকে থাকতে চায়। মানুষও তেমনি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে জেনেও ধরে রাখতে চায়, ভালবাসার আশা ছেড়ে দিতে পারেনা।
সব ভালবাসার সম্পর্কে দুজন দুজনকে সমান ভালবাসে না, একজন একটু বেশি দেয়, অন্যজন একটু বেশি নেয়। কিন্তু দুটো মানুষ যখন একসাথে থাকে, তখন একটু যত্ন, একটু কম্প্রমাইস চাওয়া কি খুব বেশি হয়ে যায়?
ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, দুটো রিটেনের মাঝে একদিন বন্ধ, সেদিনই তার আমার সাথে দেখা করতে মন চাইল, সকল অনুরোধ, বিনয় তার জেদের কাছে হার মানল, তার যুক্তি,"আমারও তো পরীক্ষা...” ফলাফল, পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন ডেটিং, রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়তে বসা, এবং আবিষ্কার করা, সে একটা সাজেশন পেয়েছে, সেটাই পড়ছে, কিন্তু আমাকে দিতে ভুলে গেছে/ভেবেছে আমি অন্য কারও কাছ থেকে পেয়েছি/ যখন কথা হবে তখন দিবে।
শুধু এখানেই শেষ না, ওর মাথা ব্যথা, নিজে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয়েও কথা বলছি, পরদিন আমার যে জ্বর এটাই সে ভুলে গেছে। কিংবা, ওর পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, ওকে সান্ত্বনা দিতে যেয়ে আমার নিজের পরীক্ষাটা খারাপ হয়ে গেল, আমি ফেল করলাম, ও পাস করল। এখানেই শেষ নয়, সেই ফেলের সাপ্লিমেন্টারী দিতে যেয়ে যে কষ্ট ভোগ করেছি, তা বর্ণনার অতীত। তারও মধ্যে সময় করে ওর অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে দেখতে গেছি, ভাইভা দিতে ঢোকার আগ মুহূর্তে ফোন করেছি, খোঁজ নিয়েছি, ও আমার ভাইভার কথা একবার জিজ্ঞাসাও করেনি।
ভাবছেন, এটা তো চরম স্বার্থপরতা, এরকম মানুষের সাথে কে থাকে? উত্তর হবে, আমি। যতই আমাকে মনের দিক থেকে দুর্বল, আত্মসম্মানহীন আর নির্লজ্জ বলুন না কেন, আমি জানি আমার মত আরও অনেক মানুষ আছে, যাদের কাছে ভালবাসার আরেক নাম কষ্ট।
সম্পর্কের শুরুতেই একটা শর্ত ছিল, ভাগ্যে থাকলে আমরা বিয়ে করব, একসাথে থাকব, ভাগ্যে না থাকলে তুমি আমি কিছুই করতে পারব না। ( কথাটা নিষ্ঠুর হলেও সত্যি) কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কের কথা কেউ জানতে পারবে না। আমি কিভাবে এই অদ্ভুত শর্তে রাজি হলাম, সেটা আরেক গল্প, আপাতত শুধু এটাই বলি, তিন বছর ধরে এভাবেই আছি। একই প্রতিষ্ঠানে পড়ি, কেউ কারও সাথে কথা বলিনা। বাইরে দেখা করি খুব সাবধানে(!!) অনেক সময়, চার-পাঁচ মাসও দেখা হয়না।
আমি অতি সাধারণ, সিদেসাধা একটা মেয়ে, দেখতে মোটামুটি, পড়ালেখায় মোটামুটি, কথাবার্তা আর চালচলনে এত চুপচাপ যে ক্লাসের অর্ধেক মানুষ আমাকে চেনেই না। অপরপক্ষে, সে পপুলার ফিগার, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুরোটা সময় বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র, জুনিয়র, ক্ষেত্রবিশেষে প্রফেসর এবং নিজের পরিবারের জন্য তাকে ব্যয় করতে হয়। এর মধ্যে আমার জন্য সময় কই!
আমি ক্লাস শেষে বাসায় এসে ফোনের অপেক্ষায় থাকি, ফোন আসেনা, বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা, অবশেষে রাত ১২;৩০ থেকে ১;০০ টায় তার সময় হয়। যদি ভাবেন আমি কেন অপেক্ষা করি? নিজে ফোন দিলেই তো পারি। পারি, তবে হয় তা রিসিভ করা হবেনা, না হলে রিসিভ করেই রেখে দেয়া হবে যেহেতু সে বিজি, না হলে ওয়েটিং থাকবে। তারপর রাত ১ টায় ওর ক্লান্ত/অসুস্থ/ ব্যস্ত গলা ফোনের ভেতর ভেসে আসে, দ্রৌ, আজ বেশি কথা বলবনা, তাড়াতাড়ি রেখে দিব। আমারও সকাল ৭টার ক্লাস ধরার তাড়া থাকে, তাই আর কথা বাড়াই না।
রেখে দিলেও আমার ঘুম আসেনা, সারাদিন ধরে যত কথা জমাই ওকে বলব বলে, সব মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, মাঝে মাঝে কল্পনায় ওর সাথে কথা বলি...
মাঝে মাঝে ভাবি সব ঠিক হয়ে যাবে, মাঝে মাঝে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই, তখন হয় ও নিজেই ফোন দিয়ে আমার রাগ ভাঙায় (এতটুকুই যথেষ্ট আমার মন গলাতে) যদি তাও প্রয়োজনবোধ না করে, তখন আমিই আবার কল দেই।
তবে ভাবছি, সব ছেড়ে দেব, আসলেই ছেড়ে দেব... মানুষ এতটুকুই সহ্য করতে পারে, এখান থেকে, এই লেখা থেকেই হয়তো তার শুরু হবে। হয়তো পারব, না পারলে নিজের দুর্বলতার দায় নিজেই বইব।