somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চার্বাক দর্শন : বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন ... ( ঋণ করে হলেও ঘি খাও , এই নীতিতে বিশ্বাসী যাঁরা )

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভারতীয় দর্শনসমূহের মধ্যে একমাত্র চার্বাকই বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন । এই মতবাদ অনুসারে অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা এবং মন , প্রাণ , চৈতন্য প্রভৃতি জগতের সব বস্তুই জড়
পদার্থ হতে তৈরী । এই মতের অনুসারীরা আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না ।

চার্বাক দর্শন সম্পর্কে প্রামানিক কোন গ্রন্হ (Authentic book) না পাওয়া গেলেও এই দর্শন যে একটি অতি প্রাচীন মতবাদ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই । কারণ বেদে , রামায়ন-মহাভারত এবং বৌদ্ধ দর্শনের স্হানে স্হানে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায় । তাছাড়া ভারতের অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় এই চার্বাক দর্শনের মত খন্ডন করতে গিয়ে যে ব্যাখা দিয়েছেন সেখান থেকেও চার্বাক দর্শন এবং এর প্রাচীনত্বের প্রমান পাওয়া যায় । চার্বাক দর্শনের সিদ্ধান্তগুলি দর্শনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত না হলেও জড়বাদ একটি বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ বলে চার্বাক দর্শন
ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্হান দখল করে আছে । এমনকি পাশ্চাত্য দর্শনের উপর এর প্রভাব প্রতীয়মান হয় । এছাড়া উনবিংশ শতকের প্রত্যক্ষবাদ (Positivism) প্রভৃতি অনেক দার্শনিক মতবাদের উপর চার্বাক দর্শনের প্রভাব দেখা যায় । ইপিকারাস (Epicurus) এর সুখবাদের (Hedonism) সাথে চার্বাক দর্শন এর অনেক মিল আছে ।


চার্বাক দর্শনের মূল গ্রন্হ এখনো পাওয়া যায়নি বলে চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে , এ সম্পর্কে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় । কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে চার্বাক এক ঋষি ছিলেন ; তিনিই চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা । আবার কারো মতে চর্ব ধাতু থেকেই চার্বাক শব্দটির উৎপত্তি । চর্ব ধাতুর অর্থ চর্বণ বা খাওয়া । এই দর্শন খাওয়া দাওয়াকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করে । তাই এ দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন । আর একদলের মতে চা্বাক শব্দের অর্থ চারু+বাক্ , অর্থাৎ মধুর কথা । এই দর্শনের কথাগুলো খুবই মধুর , যেমন-ঋণ করে হলেও ঘি খাও , যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো । ( ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ , যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ ) ।

আবার কারো মতে অসুরগনকে ধ্বংস করবার জন্য লোক-পুত্র বৃহস্পতি অসুরদের মধ্যে এই ভোগমূলক বা জড়বাদী দর্শনের প্রচলন করেছিলেন । চার্বাক শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন বা যিিই এর প্রতিষ্ঠাতা হোক না কেন চার্বাক দর্শন বলতে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনকেই বুঝায় । সাধারন মানুষের কাম্য হলো জাগতিক সুখভোগ , এই দর্শনের মতেও জীবনের চরম লক্ষ্য সুখভোগ । সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাধারন লোকের চিন্তা ও ভাবধারা এই দর্শন তুলে ধরেছে । এ কারনে এ দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন ।



চার্বাক দর্শনের মতে প্রত্যক্ষই (Perception) একমাত্র প্রমান অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় । চার্বাক দর্শন অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরুপে গ্রহন করে নাই । অনুমান (Inference) ও শব্দের (Testimony) দ্বারা কোন নিঃসন্দিগ্ধ ও যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না । চার্বাকপন্থীরা বলেন যা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ লব্ধ নয় তা বিশ্বাসযোগ্য নয় । যে বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা যায় বা অনুভব করা যায় , একমাত্র সে বস্তুরই অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় ।



চার্বাকগণ বলেন , ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা জড়জগৎকে প্রত্যক্ষ করি । এই জড়জগত ক্ষিতি (Earth) অপ (Water) তেজ (Fire) মরুৎ (Air) এই চার ভূতের দ্বারাই গঠিৎ । চার্বাকগণের মতে চন্দ্র , সূর্য , গ্রহ , নক্ষত্র , বৃক্ষ , লতা সহ জগতের যাবতীয় বস্তু , এমনকি মানব দেহও এই চারি ভূতের সমন্বয়ে গঠিত এবং তাহাদের বিয়োগের ফলে বিনষ্ট হয় । চার্বাকগণ চেতনার (Consciousness) অস্তিত্ব স্বীকার করেন ; কারন চেতনা দেহের ধর্ম এবং ইন্দ্রিয়গ্রহ্য । এখন প্রশ্ন হলো ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ এই চারি ভূতের কোনটিতেই যখন চেতনা নাই , তবে এই চারি ভূতের সংমিশ্রনে সৃষ্ট দেহে চেতনা আসবে কেমন করে ?

“অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমিবার্য্যনলানিলা

চতুর্ভ্য: খলুর্ভূতেভ্যশ্চৈতন্যমুপজায়তে।“



এর উত্তরে চার্বাক গণ বলেন , উক্ত চারিভূতের কোনটিতেই চেতনারুপ না থাকলেও চারিভূতের নির্দিষ্ট পরিমান সংমিশ্রনের ফলে এইগুনটি তৈরি হতে পারে । যেমন – পান , সুপারি ও চুন এই তিনটি বস্তুর ভিতর কোনটিরই লাল রং নেই । তবু এই তিনটি বস্তুকে একসাথে চর্বন করলে লাল রং দেখা যায় । তাঁহার বলেন , দেহ ছাড়া চেতনারুপ গুনের ভিন্ন সত্তা নাই । এবং দেহ ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে চেতনা গুনটি নষ্ট হয়ে যায় । তাঁদের মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা । দেহ ছাড়া আত্মার কোন সত্তা নাই এবং অভৌতিক আত্মা বলেও কিছু নাই । অর্থাৎ আত্মা ও দেহ অভিন্ন ; দেহ বিনষ্ট হলে আত্মাও বিনষ্ট হয় । সুতরাং চার্বাকদের মতে আত্মার অমরতার প্রশ্ন অবান্তর ।


মানুষের বর্তমান জীবনই একমাত্র জীবন । পরজন্ম বলে কোন কিছু চার্বাকগণ বিশ্বাস করেন না । কারন পরজন্মের অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই । সুতরাং মৃতুর পরেও মানুষকে তার কুকর্মের জন্য দুঃখভোগ এবং সুকাজের জন্য মানুষ সুখভোগ করবে – এইসকল কথা তাঁদের মতে অর্থহীন ।
“পরলোকিনোহ ভাব-পরলোকাভাব: ।“


ভগবানের কাহিনী পৌরনিক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয় । সুতরাং পরজন্মে সুখভোগের জন্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য তাঁর পূজা অর্চনা করা বোকামী মাত্র । তাঁরা বলেন ধূর্ত পুরোহিতদের বিশ্বাস কতরা মানুষের উচিত নয় ; কারন পুরোহিতগণ নিজেদের জীবিকা অর্জনের জন্য ঈশ্বরের পূজা করার জন্য মানুষকে প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত করে । মৃত ব্যাক্তির শ্রাদ্ধকৃত্যাদির কোনো ফলই নেই, ইহা শুধু ব্রাক্ষণদের রোজগারের পথ।

“ততশ্চ জীবনোপায়ো ব্রাক্ষনৈর্বিহিতস্থিত।“

মৃতানাং প্রেতকার্য্যানি নত্বন্যদ্বিদ্যতে ক্কচিৎ।।“


চার্বাক আরও বলেছেন ভন্ড, ধুর্ত, নিশাচর তারাই বেদের কর্তা।

“ত্রয়োবেদস্য কর্ত্তারো ভন্ডধুর্ত নিশাচরা:।“

বেদও এই প্রতারক পুরোহিতদের সৃষ্টি । সুতরাং চার্বাকগণের মতে বেদকে বিশ্বাস করা মানুষের উচিত নয় ।
জড়বাদী চার্বাকদের মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমান এবং যাহা প্রত্যক্ষগোচর নয় তাহার অস্তিত্ব নাই । যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষগোচর নয় , সেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না । তাঁরা আরো বলেন , ক্ষিতি , অপ , তেজ ও মরুত্ এই চার রকমের জড় উপাদানের স্বাভাবিক পরিনতিই হলো জগৎ , অর্থাৎ চতুর্ভূতের স্বাভাবিক মিশ্রণের ফলেই জগতের সৃষ্টি হয়েছে । তাই জগত স্রষ্টারুপী ঈশ্বরের অনুমান করার কোন প্রয়োজন নাই ।


ভারতীয় দার্শনিকগণের মধ্যে অনেকেই আত্মার মুক্তি বা মোক্ষ লাভকে মানব জীবনের পরম কল্যান তথা চরম লক্ষ্য বলে অভিহিত করেছেন । কিন্তু চার্বাকগণ বলেন , আত্মারই যেখানে কোন সত্তা নাই সেখানে আত্মার মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর মাত্র । তাঁদের মতে ইন্দ্রিয়-সুখই মানুষের পরম কল্যান । তাই এই ইন্দ্রিয়-সুখই তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত । চার্বাকগণ আরো বলেন , অতীত চলে গেছে , ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত , কেবল বর্তমান মানুষের আয়ত্বে আছে । সুতরাং বর্তমান জীবনে মানুষ যে উপায়েই হোক , যত বেশি সুখ করতে পারে তা করা উচিত । দুঃখমিশ্রিত বলে বা অন্য কোন কারনে বর্তমান সুখকে বিসর্জন দেয়া মানুষের পক্ষে মূর্খতা ।



আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় দর্শন হিসেবে চার্বাক মতের বিশেষ কোন মূল্য নাই এবং এই মত সর্বাংশে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় । কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এই মত একেবারে মূল্যহীনও নয় এবং তেমন নিন্দনীয়ও নয় । চার্বাক দর্শন কুসংষ্কার , অন্ধবিশ্বাস ও অর্থহীন প্রচলিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে । এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষে নির্বিচার দর্শনের ভিত্তি উৎপাটিত করে সবিচার দর্শনের ভিত্তি রচনা করেছে । এই দর্শন সাধারন মানুষকে আত্ম-নির্ভরতার পথ দেখিয়েছে । দর্শনে যে অবিচারিত তত্ব ও মতের স্হান নেই চার্বাক দর্শন তা পতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছে । স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রকে চার্বাক দর্শন কঠোর আঘাত করেছে । এখানেই এ দর্শনের সার্থকতা ।


তথ্যসূত্র:
ভারতীয় দর্শন - অর্জুনবিকাশ চৌধুরী
ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন - ড রমেন্দ্রনাথ ঘোষ
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৩৯
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এলেম কি? এ বিষয়ে বান্দার দায়িত্ব কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৫ ভোর ৬:১০




সূরাঃ ৬২ জুমুআ, ২ নং আয়াতের অনুবাদ।
২। তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আবৃত করে তাঁর আয়াত সমূহ; তাদেরকে পবিত্র করে এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প- ৯৪

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৮ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:০১



নাম তার তারা বিবি।
বয়স ৭৭ বছর। বয়সের ভাড়ে কিছুটা কুঁজো হয়ে গেছেন। সামনের পাটির দাঁত গুলো নেই। খেতে তার বেগ পেতে হয়। আমি তাকে খালা বলে ডাকি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়ি বুনো ফল-রক্তগোটা ভক্ষন

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০৮ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:০৫

পাহাড়ি বুনো ফল রক্তগোটা এর রয়েছে বিভিন্ন নাম-রক্তগোটা, রক্ত ফল, রক্তআঙ্গুরী, রক্তফোটা, রক্তজবা পাহাড়িরা আবার বিভিন্ন নামে ডাকে। এর ইংরেজী নাম ব্লাড ফ্রুট।











প্রতি বছর... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেষমেষ লুইচ্চা হামিদও পালিয়ে গেলো!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:০৩



৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন হয় ফেসিস্ট হাসিনা ও তার দল আম্লিগের। এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছে দলটির চোরচোট্টা নেতাকর্মীরা। অনেক চোরচোট্টা দেশ ছাড়লেও এতদিন দেশেই ছিলো আম্লিগ সরকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অপারেশন সিঁদুরে নিহত আইসি ৮১৪ বিমান অপহরণের সঙ্গে, জইশ জঙ্গি মাসুদের ভাই রউফ আজ়হার:

লিখেছেন ঊণকৌটী, ০৮ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৩১

অপারেশন সিঁদুরে নিহত আইসি ৮১৪ বিমান অপহরণের সঙ্গে যুক্ত, জইশ জঙ্গি মাসুদের ভাই রউফ আজ়হার: ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আব্দুল-সহ পাঁচ জঙ্গি আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণ করেছিল। মাসুদ আজ়হার আলভি-সহ তিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×