আমি আমার অগ্রজের কথা বলছি,
আমি আমাদের স্বাধীনতার কথা বলছি,
আমি একটি ত্যাগের কথা বলবো,
আমি এক বেদনার কথা লিখবো।
যে বেদনার কথা লেখা হয়নি কোনো ইতিহাসে,
যে ত্যাগের কথা জানেনা বড় মানুষেরা,
যে ব্যাথা এই চুয়াল্লিশ বছরের প্রতিটি দিন,ক্ষন মূহুর্ত-
কুরে কুরে খেয়েছে আমার মাকে,
ষাটোর্ধ চোখে ছানি পড়ে গেছে তার,
আমার অগ্রজের জন্য কেঁদে কেঁদে,
চোখ বুজেছেন আমার দাদী
আমার অগ্রজের শার্ট বুকে করে পাগলীনি হয়ে,
গত চুয়াল্লিশ বছর উনি উন্মাদ ছিলেন।
উনার হাত থেকেই তো ছুটে গিয়েছিলো সেদিন
ছোট্ট একরত্তি আড়াই বছরের একটি শিশুর হাত।
সে দুঃস্বপ্নে মৃত্যুর আগের দিনটি পর্যন্ত
তিনি ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠেছেন।
আমরা তার চিৎকারে, তার কান্নায়, আর কান দিতাম না।
সংসারে সবার কত কি কাজ,
একই দুঃখ নিয়ে পড়ে থাকা কোনো অশীতিপর বৃদ্ধার
পাগলামী নিয়ে পড়ে থাকলে কি কারো চলবে?
১৯৭১ এর ৬ই ডিসেম্বর, দুপচাঁচিয়া গ্রাম,
চারদিকে গোলাগুলি, আর্ত চিৎকার
রাতের আঁধারে অতর্কিত আক্রমনে,
গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিলেন
একদল ছেলে, বুড়ো নারী ও শিশু,
প্রানভয়, আতংক, কেঁপে উঠেছিলো পৃত্থী
আমার মা, চাঁচী দাদী, সকলেই ছিলেন সে দলে
মায়ের কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া
আমার চব্বিশ দিনের বোন আর দাদীর হাঁতে
আমার আড়াই বছরের ভাই-
ছোট্ট দু,পায়ে জোর ছিলো না বেশি তার
তবুও সে দৌড়াচ্ছিলো প্রানভয়ে অথবা
কোনো অজানা আশঙ্কায়, আতংকে-
আর সকলের সাথে, দাদীর হাতটি ধরে-
হঠাৎ আঁধারের করাল গ্রাস,
ছোট্ট মুঠিটি বিছিন্ন হলো,
কুটিল অন্ধকার, মুহুর্মুহু গুলি বর্ষন, আতংকিত জনতা
আমার ছোট্ট ভাইটির আতংকিত চিৎকার
বিলীন করে দিলো সে আঁধার।
আমার অগ্রজের নাম নেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়,
আমার অগ্রজের নাম লেখা হয়নি কোনো ইতিহাসে,
আমার অগ্রজের এই ত্যাগ কেউ কখনও বলেনি কোনো জনসভায়,
আমার মায়ের চাঁপা বেদনার কথা, অব্যাক্ত শোক কেউ কখনও জানেনি,
আমার পাগলীনি, উন্মাদিনী দাদীর অবিরল চোখের জল
ধরে রেখেছে শুধু ঐ রুক্ষ মাটি, শুষে নিয়েছে তার শুষ্ক বুকে,
স্বাধীন,সার্বভৌম আমার বাংলাদেশের মাটি।
হয়তো সে আজও হাঁটছে এ মাটির বুকে,
স্বজনহীন, স্নেহহীন, বন্ধনহীন, একাকী,
নয়তো ঘুমিয়ে আছে চির নিদ্রায়, চির সুখে,
মমতাময়ী ধরিত্রীর চির শীতল বুকে।
আমরা কেউ জানিনা তার খবর
জানবোনা কোনোদিন-
শুধু জানি এ স্বাধীনতায় তার, আছে এক অবদান,
ক্ষুদ্র নয়,অনেক বড়, ষোল কোটী মানুষের স্বাধীনতার হাসিতে
লুকিয়ে থাকে আমার অগ্রজ।
আর আমার কান্নায়!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:২৯