শফিক ও তার একটি নিদ্রাহীন রাত-
রাত প্রায় দু'টো বাজতে চলেছে। অসহ্য মাথাব্যাথা ও অস্থিরতায় কেঁটেছে আজ সারা সন্ধ্যা। এতটা অসুস্থ্য লাগছিলো যে শেষ পর্যন্ত রাত এগারোটা নাগাদ ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হলো। মিনিট পনেরো তন্দ্রাছন্ন কাঁটবার পর ঘুম পাকাপাকি ভাবেই চটে গেলো। সন্ধ্যা থেকেই এই অসহ্য মানষিক অস্থিরতায় ভুগছি আমি। আর এই অস্থিরতা শুরু হয়েছে আজ সন্ধ্যায় রেদোয়ানের বাড়িতে যাবার পর হতে।
রেদোয়ান আমার কলিগ কাম বর্তমানের সবচাইতে প্রিয় সহচর। ইউ.এস.এ থেকে ফিরে এই অফিসে জবটা নেবার প্রথম দিন থেকে এ ছ'সাত মাসে তার সাথে সখ্যতা এমন একটা পর্যায়ে পৌছেচে যে আজ যখন সে আমাকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করলো আমি না করতে পারলাম না। এখন মনে হচ্ছে না যাওয়াটাই ভালো ছিলো। আমি ইউ.এস.এ ছেড়েছিই সেখানকার কিছু দুঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে। এ কয়েকমাসে নিজের দেশের শৈশবের পরিচিতিময় স্থানগুলোতে পরিচিত হচ্ছি ফের ধীরে ধীরে।একটু ছুটি পেলেই ছুটে গেছি আমার নাড়ির টানে। আমার শৈশবের গ্রাম, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি। দূর্ভাগ্যক্রমে আপনজন বলতে আমার কেউই নেই সেখানে আর । তারপরও পাড়াপড়শী বা আত্মীয়ের অধিক অনাত্মীয়দের সাদর আথিতেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি বার বার।
কিন্তু আমার আজকের এই অস্থিরতার কারণ যে কেউ শুনলে আমাকে বিকৃত মানষিকতার রোগী বলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাকে ধিক্কার দেবে । থুথু দেবে আমার মুখে। কিন্তু আমি অসহায়। আমার এই অস্থিরতার কারণ যে মানবীটি তার বয়স অন্তত ৪৫ এর কোঠা পেরিয়েছে। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা যার ছেলের কলিগ আমি। আমি জানি এমন কাউকে দেখে আমার মানষিক অস্থিরতার এ কাহিনী কোনো সুস্থ্য মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া সম্ভব না। বাট আই এ্যাম হেল্পলেস। রেদোয়ান জামিলের মাকে দেখবার পর থেকেই আমার এ অস্থিরতার শুরু। আমার এ অধঃপাতের কথা ভেবে হয়তো সবাই অবাক হবে। কিন্তু আমি অসহায় । আমি হেল্পলেস। কি করবো আমি জানিনা।
আজ যখন রেদোয়ান জামিলের বাসায় গেলাম। ড্রইংরুমে বসে গল্প করবার কিছুক্ষনের মাঝেই রুমে ঢুকলেন রেদোয়ানের মা। তাকে দেখা মাত্র আমার চোখের সামনে পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো। আমি স্থির বসে রইলাম। আমি তাকে স্বাভাবিক ভদ্রতা বা সৌজন্যতা বশত সালাম জানাতেও ভুলে গেলাম। রেদোয়ান পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তার মায়ের সাথে। প্রতিত্তরে আমি কি বলেছিলাম জানা নেই। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম প্রতিমার মত সেই মুখটির দিকে। রেদোয়ান এবং তার মা বেশ বিস্মিত হয়েছেন। এমন অদ্ভুত আচরণে যে কারো বিস্মিত হবারই কথা।
আমার এ ২৮ বছর বয়সে আমার দেখা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর মুখ। তার হাঁটা, চলা, বসার ভঙ্গিটি পর্যন্ত আমি অবাক হয়ে গিলছিলাম। ভদ্রমহিলা নিশ্চয় ব্যাপারটি লক্ষ্য করে বেশ বিব্রতও বোধ করেছেন। তিনি আমাকে বেশ কিছু প্রশ্নও করছিলেন কিন্তু আমি ছিলাম নির্বাক। রুচিশীল, মার্জিত, ঠিক সেই হাসি যা দেখে আমি হার্টবিট ড্রপ করি কয়েকটা। ঠিক তখন থেকেই আমার অস্থিরতার শুরু । উফ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি কি? নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছি। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। কিছু খেতেও পারিনি ঠিক মত। আমার অস্থিরতা দেখে উনিও বলছিলেন, আপনার মনে হয় শরীর খারাপ করেছে। আপনাকে কি একটু লেবু শরবৎ করে দেবো? কিন্তু আমার মুখে কোনো কথা আসছিলো না । আমি কিছুই বলতে পারিনি।
সারাটা রাতই বুঝি নিদ্রাহীন যাবে আজ। আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। কাকে জানাবো এই অস্থিরতা ? কে বুঝবে আমাকে?
সুদীপার হঠাৎ বদলে যাওয়া দিনগুলো-
নতুন করে এক উৎপাত শুরু হয়েছে জীবনে। দিন নেই, রাত নেই, সকাল, সন্ধ্যা, ভোরে ব্লাঙ্ক কলের অত্যাচার। যখন তখন রিং বেঁজে ওঠে, রিসিভ করলে অপর প্রান্তে নীরবতা। প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিলেও কিছু দিন আগে হঠাৎ শুরু হলো নতুন উৎপাত। টেক্সটে কবিতা আসা। তাও স্বরচিত কবিতা। এ যদি টিন এইজ বয়সে হত তবুও একটা কথা ছিলো। কিন্তু এই ৪৬ বছরের মধ্যবয়সী জীবনে কেউ যদি হঠাৎ টেক্সটে কবিতা পাওয়া শুরু করে তো ব্যাপারটা মোটেও নিজের কাছে তো বটেই ছেলেমেয়ে বা পরিবারের কাছেও শোভনীয় নয়।
সুদীপা জামিল একটা মেয়েদের স্কুলে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল পদে জব করছেন আজ প্রায় ১৮টি বছর। এই পদে থেকে এই বয়সে ফোনে যখন তখন কবিতা টেক্সট পাওয়া বা অফিস রুমে কোনো কলিগের সামনে এইভাবে ঘন ঘন ব্লাঙ্ক কল আসাটা যে কতখানি বিব্রতকর তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। না পেরে টেক্সটের উত্তরে বার বার জানতে চেয়েছেনও তিনি, কি চায় এই ব্যাক্তি? কেনো অযথা বার বার তাকে বিরক্ত করা হচ্ছে? সে কি জানে তার বয়স? তার সামাজিক অবস্থান বা পদ মর্যাদা? তার পারিবারিক অবস্থা?
সেদিন খাবার টেবিলে তিনি ছেলে রেদোয়ানের সাথে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। ছুটির দিন বলে মা ছেলে একসাথে সেদিন বেশ একটু বেলা করেই খেতে বসেছিলেন তারা । খেতে খেতে বোধ হয় ১০/১২ বার কল এলো তার ফোনে। এরপর টেক্সট। রেদোয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইলো? সুদীপা জামিল সব তাকে খুলে বলতেই বিস্মিত হলো সে। এতদিন তাকে জানানো হয়নি বলে একটু রাগও করলো সে।
সেই ২২ বছর বয়সে দু বছরের সন্তানকে বুকে করে একলা একলা এতটা পথ হেঁটেছেন তিনি। কখনও এতটুকু আঁচড় লাগতে দেননি সন্তানের গাঁয়ে। রেদোয়ান তার বড় আদরের সন্তান। ওর মুখ চেয়ে তিনি কাঁটিয়ে দিয়েছেন এতগুলো বছর। দ্বিতীয়বার গাঁটছড়া বাঁধেননি হাজারও প্রস্তাব আসা সত্বেও। আত্মীয় অনাত্মীয়দের মাঝে রোষানল, ক্ষোভাবল, লোভাতুর বা দয়া দাক্ষিন্যের নানা পথ পাড়ি দিয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছেন তিনি। শুধু স্কুলের চাকুরীটিকে সম্বল করে আর স্বামীর এই একমাত্র আশ্রয়স্থল বাড়িটিতে মাথা গুঁজে কাটিয়ে দিয়েছেন এতগুলো বছর। আজ সন্তান লেখাপড়া শিখে বড় হয়েছে। মালটিন্যাশনাল কোম্পানীতে ভালো চাকুরী করছে সে। সত্যি বলতে তার জীবনে আর বেশি কিছু চাওয়া পাওয়ার ছিলোনা। নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রবে কাঁটছিলো তার দিন গুলি।
রেদোয়ান ও একটি স্তম্ভিত দিন-
কল- ট্রাকিং এর রিপোর্টটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রেদোয়ান। কিছুদিন আগে মায়ের কাছে বার বার ব্লাংক কলের অনুযোগ শুনে ফোন অফিসে যোগাযোগ করেছিলো রেদোয়ান। কিন্তু আজ রিপোর্টটা হাতে পাবার পর স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো সে। মাকে কি করে বলবে সে ? তারই কলিগ যাকে সে বড় ভায়ের মত শ্রদ্ধা করেছে, ছেলেবেলায় বাবা মা হারানোর বেদনা ভাগ করে নিতে চেয়েছে। সেই মানুষটিকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আতিথেয়তা এবং মায়ের সাথে পরিচয়ের এই প্রতিদান। ছি ছি। নিজের উপরই ঘেন্না হচ্ছে তার।
মনে পড়ে কৌশলে শফিক হাসানের তার বাসার টিএনটি নাম্বার ও মায়ের নাম্বার হাতিয়ে নেবার ঘটনাগুলো। তবে কি সে মানষিক বিকার গ্রস্থ? পৃথিবীতে কেউ নেই রেদোয়ানের এই এক মা ছাড়া। ছোটবেলায় বাবাকে হারাবার পর যে মা তাকে শত ঝড়ঝ্ঞ্ঝা উপেক্ষা করে বুকে করে মানুষ করেছেন আর সেই মাকেই কিনা তারই কলিগ এই নরপশুটা ব্লাংক কল দিয়ে যাচ্ছে? একের পর এক বিরহী, প্রেমাকাঙ্খী কবিতা পাঠাচ্ছে? কিন্তু কেনো? কি কারণে? কোনো জবাব খুঁজে পায়না সে।
কোনো কিছুই আর ভাবতে পারেনা সে। ইচ্ছে হয়, তিন ডেস্ক পরে ভদ্রতার অবতার সেজে বসে থাকা শফিক হাসানের সামনে গিয়ে সোজা তার কলার টেনে ধরতে। সভ্যতা ভব্যতা ভুলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে। নেমক হারাম, বেঈমান যাকে নিজের ভাই জ্ঞানে বাড়িতে নিয়ে গেছি সেই তুই দিনে চব্বিশবার আমার মাকেই ব্লাংক কল দিস? কেনো ? কি জন্য? নিস্বার্থ ভালোবাসার এই প্রতিদান? অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে ইচ্ছে হয় তার। শুধু অফিস বলে আজ এই মুহুর্তে বেঁচে গেলো শফিক হাসান। কিন্তু শফিক হাসান তোমার রক্ষা নেই। এই বিকৃত রুচির প্রতিদান তাকে দিতেই হবে। মনে মনে ক্রোধোন্মাদ হয়ে ওঠে রেদোয়ান।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে সব খুলে বলে। মা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। এ লজ্জা তো শুধু তার মায়ের কাছে সন্তানের লজ্জা নয়। এ যে সন্তানের কাছে মায়েরও লজ্জা। রেদোয়ান ভাবছে সেই এই অপরাধের জন্য দায়ী। সে উঠে দাঁড়ায়। তাকে শত বাঁধা সত্বেও আটকাতে পারেন না মা । রেদোয়ান শফিক হাসানের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।
সুদীপা জামিলের একটি রাত-
রেদোয়ানের মা সুদীপা জামিল বসে আছেন ইজিচেয়ারে। ঘুমাননি তিনি। সন্তানের সামনে দৌর্বল্য প্রকাশ না করলেও গভীর নিশীথে অঝর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। ক্লাস টেনে পড়বার সময় বিয়ে হয়েছিলো তার। এত অল্প বয়সে বিয়ে হবার কারণই ছিলো তার অসাধারণ রূপ। রেদোয়ানের বাবা রায়হান জামিল মারা যান যখন, তখন রেদোয়ানের বয়স দুই। সেই থেকেই তিনি একাই লড়েছেন প্রতিকুল পারিপার্শ্বিকতার সাথে। এতগুলো দিন তিনি যে লড়াই করেছেন আজ সন্তানের সামনে সন্তানেরই কলিগের কাছে এই পরাজয়, এই লজ্জা। নিজেকে ধ্বংশ করে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার। তার এই সৌন্দর্য্য, এই রূপই ছেলের কাছে এই বয়সেও তার লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।নিদারুণ লজ্জায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
গভীর নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আবারও বেঁজে ওঠে ফোন।
চমকে ওঠেন সুদীপা। স্ক্রিনে সেই নাম্বার। ভীষন অবাক হন। এতকিছুর পরেও বিশেষ করে আজ সন্ধ্যায় রেদোয়ান শফিক হাসানের বাড়িতে গিয়ে এত ঘটনা ঘটাবার পরেও কি করে এই লোক আবার ফোন দেয় তাকে! বিস্ময় জাগে তার চোখে।কাঁপা হাতে ফোনটা অন করেন তিনি।
ও পাশ থেকে শফিক হাসানের কম্পিত কন্ঠ।
- প্লিজ ফোনটা রেখে দেবেন না। ঘৃনা করবেন না আমাকে। আমার কথাগুলো শুনুন। তারপর যা খুশি বলবেন। যা ইচ্ছা করবেন। আপনি যা বলবেন তাই মেনে নেবো আমি।
বিস্ময়ে আর ভয়ে কন্ঠ রোধ হয়ে যায় সুদীপার। এই ছেলে তার থেকে অন্তত ১৫/১৬ বছরের ছোট হবে। কি করে সে বলে তাকে এসব কথা!
শফিক বলে চলে, আমি খুব দুঃখিত যে বার বার কাপুরুষের মত ব্লাঙ্ক কল দিয়ে আপনাকে বিরক্ত করেছি আমি। আপনাকে টেক্সট পাঠিয়েছি। আসলে সেদিন আপনাকে দেখার পর থেকে আমি এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সারারাত অস্থিরতায় ঘুম হয়নি আমার। আমার পৃথিবী হঠাৎ থমকে গিয়েছিলো আপনাকে দেখার পর থেকে। আমি এতটাই অস্থির ছিলাম। কি করবো না করবো বুঝতে পারছিলাম না যার পরিপ্রেক্ষিতে একটা সময় আপনার সাথে যোগাযোগের বা আপনার কন্ঠ শুনবার জন্য আমি অস্থির হয়ে পড়ি ও এই পন্থা অবলম্বন করি। আমি আমার এ হীন পন্থার জন্য সত্যিই দুঃখিত।
সুদীপা হিম হয়ে থাকেন। এসব কি বলছে এই ছেলে । কিছুই মাথাতে ঢোকেনা তার। নির্লিপ্তের মতন কেবলি শুনে যান শফিকের কথা।
শফিক বলে, দেখুন আমি খুব ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি। হারানোটা এক এক করে নয়। দুজনকে একইসাথে একই সময়ে রোড এক্সিডেন্টে হারানোটা সে বয়সের একটা ছেলের জন্য কতখানি মারাত্মক, কতখানি বেদনাদায়ক, সে নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারেন।
সুদীপা কথা বলে না । সে শুধুই দ্বিধাগ্রস্ত হয়। শংকা জাগে বুকে। কি বলতে চায় এ ছেলে তাকে?
শফিক বলে, বাবা মাকে হারাবার পর আমি চলে যাই ইউ.এস.এ । আমার চাচা চাচীর কাছে। উনারা নিসন্তান থাকায় আমাকে পুত্রজ্ঞানে মানুষ করতে তাদের কোনো বাঁধা ছিলোনা। বড় আদরে মানুষ করেছেন তারা আমাকে। আমি বরাবর শান্ত, ভদ্র ও পরিশ্রমী স্বভাবের হওয়ায় পড়ালেখা ও খেলাধুলায় ভালো করেছি বরাবর। অসাধারণ রেজাল্ট করেছি, কম্পিউটার সায়েন্সে যখন আমার পড়ালেখা প্রায় শেষ। তখনই পরিচয় হলো একটি বাঙ্গালী মেয়ের সাথে। মেয়েটি আমার একই ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছিলো। ক্যাফেতে প্রথমে তার সাথে পরিচয়। তারপর মন দেওয়া নেওয়া। আমি অন্তর্মুখী স্বভাবের হওয়ায় ঐ দেশের মেয়েদের কখনও ভালো লাগেনি আমার, ভালোবাসা তো দূরে কথা। কিন্তু শেহনীলার অসাধারণ সৌন্দর্য্য ও উচ্ছলতা এড়াতে পারলাম না আমি । আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। ও ছিলো আমার চোখে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী। সৌন্দর্য্যের ভাস্কর্য্য প্রতীমা।
শেহনীলা নামটি শুনবার সাথে সাথে পাথর হয়ে গেলেন সুদীপা। রেদোয়ান বলে চললো,আমাদের গত ডিসেম্বরে বিয়ে হবার কথা ছিলো। কিন্তু স্নোফলের মাঝে কার এক্সিডেন্টে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় শেহনীলার। ও ছিলো অসম্ভব রকম চঞ্চল এক প্রজাপতি। আমার চঞ্চল প্রজাপতিটির মৃত মুখটি যখন দেখি আমি, তার সেই সৌন্দর্য্যের কিছুই আর অবশিষ্ট ছিলোনা। তখন সে পরিনত হয়েছিলো থেতলানো একটি জড় মাংসপিন্ডে।
সুদীপা ফুঁপিয়ে ওঠেন। শফিক হাসান বলে চলেন, সেদিন আপনার বাসায় আপনাকে যখন দেখি, আমি বিস্মিত হয়ে যাই। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই হাসি। তেমনি কপালের উপরের চুলের ঢেউ খেলানো অংশটুকু। আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারাই।বার বার ফোন দিয়ে আপনার কনঠস্বর শুনতে চেয়েছি। আমি হিতাহিত হারিয়ে যা কিছু করেছি তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার অপরাধের ক্ষমা হয় না। আমি সত্যি দুঃখিত আমার এই অপরিপক্ক মানষিকতা ও কার্য্যকলাপে। আমি রেদোয়ানকে কথা দিয়েছি। যে লজ্জায় তাকে পড়তে হলো এই আমারই কারণে, সেই আমি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবো। আমি সত্যি দুঃখিত। আমার অনিচ্ছাকৃত অপরাধের ক্ষমা হয়না।
সুদীপা, শফিক, রেদোয়ান ও শেহনীলা এবং অতঃপর-
খুব ভোরবেলা সুদীপাদের ড্রইং রুমে মুখোমুখি বসে আছেন তারা। সুদীপার অনুরোধে, শেষ পর্যন্ত আবারও তার সাথে দেখা করতে রাজী হয়েছেন শফিক হাসান। সুদীপা বলছেন, রেদোয়ান আমি আজ যখন তোমাকে তোমার অজানা কিছু কথা বলবো। এ কথা শোনার পর হয়তো আমাকে ক্ষমা করতে পারবেনা তুমি। তবুও আমাকে বলতেই হবে। তোমার বয়স যখন দুই, তখন তোমার বাবা মারা যান। আমার গর্ভে তখন আরও একটি অনাগত সন্তান, যার কথা কখনও আমি তোমাকে বলিনি।
রেদওয়ান চমকে ওঠে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। সুদীপা বলে চলে, তোমার বাবা মারা যাবার সাতদিন পরেই জন্ম হয় তার। আমি এই সদ্যজাত শিশু এবং দু বছরের ছোট্ট তোমাকে নিয়ে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। নিজেদের পছন্দে কোর্ট ম্যারেজ করায় দুই ফ্যামিলীর সাথেই আমরা ছিলাম যোগাযোগ বিছিন্ন। তখন এগিয়ে আসেন পরিচিত এক অনাত্নীয়। স্কুলের চাকুরীর উপর ভরষা না করে আমি ঐ অনাত্মীয় পরিচিত দম্পতিকে আমার সেই দ্বিতীয় সন্তানটিকে লিখে পড়ে দেই।
ব্যাপারটা কতখানি নিষ্ঠুর ও অমানবিক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । কিন্তু বিশ্বাস কর বাবা আমি তোর আর তোর বোনটির সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রতি রাতে তার কথা ভেবে ব্যাথায় আমার বুক ভেঙ্গে গেছে কিন্তু সে ব্যাথার এতটুকু অংশও আমি তোকে বহন করতে দেবোনা বলে এ কথা আমি চিরদিন গোপন রেখেছি। আত্মীয় স্বজনের যোগাযোগ না থাকায় রেদোয়ান তুইও কখনও জানতে পাসনি। তোর একটা ফুটফুটে বোন ছিলো এই পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে। কেউ না জানলেও প্রতি মাসে ঐ পালক বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ হত আমার। প্রতি বছর তারা ছবি পাঠাতেন শেহনীলার। আমার পরীর মত মেয়েটি দিনে দিনে স্বর্গের অপ্সরী হয়ে উঠেছিলো। গত উইন্টারে যখন তার এক্সিডেনট হয় তখন ভীষন ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। তবুও তুই কষ্ট পাবি আমাকে অপরাধী জানবি তাই তোকে জানতে দেইনি সে কথা।
আমার সোনামনি। বেঁচে থাকতে যে মা বা ভাই এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি সে, মৃত্যুর পরে তার ভালোবাসার মানুষটির চোখ দিয়ে সে ছুঁয়ে গেছে তার মাকে। তার প্রিয় ভায়ের সান্নিধ্যে ডেকে এনেছে তার প্রিয়তম মানুষটিকে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুদীপা জামিল।
স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন রেদোয়ান আর শফিক হাসান। সান্তনার ভাষা জানা নেই আজ তাদের কারোরই।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:০৮